ফাঁস হয়ে যাচ্ছে পুলিশের ওয়াকিটকি বার্তা!
‘আলফা সেভেন স্যার। আমাদের টোলারবাগে ছাত্রলীগের একটা মিছিল বের হয়েছে। অপর প্রান্ত থেকে পুলিশের কর্মকর্তা বলছেন, বঙ্গবন্ধুর নৌকার পক্ষে হলে মিছিল করলে সমস্যা নেই। এ সময় আরেক প্রান্ত থেকে বলা হয়, সঠিক স্যার। ছাত্রলীগ নৌকার পক্ষেই। মিছিল হচ্ছে স্যার।’
সপ্তাহখানেক আগে জুলকারনাইন সায়ের নামের এক ব্যক্তি তার ফেসবুক আইডিতে এ রকম একটি পোস্ট দিয়েছেন। সাধারণত পুলিশ ওয়াকিটকি ব্যবহার করে এ ধরনের বার্তা আদান-প্রদান করে থাকে। জুলকারনাইনের ওই স্ট্যাটাসে ১ হাজার ২০০ ব্যক্তি লাইক দিয়েছেন, ৪০ জন আজেবাজে কমেন্ট করেছেন এবং পোস্টটি ৯৬ জন শেয়ার করেছেন।
২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের দিন পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় ফেসবুকে ভাইরাল হয় ওয়াকিটকিতে পুলিশের মধ্যে হওয়া আরেকটি কথোপকথন। ওই সময় পুলিশ কর্মকর্তারা সংঘর্ষের সর্বশেষ অবস্থা, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করাসহ নানা বিষয়ে বার্তা আদান-প্রদান করছিলেন।
এই দুটি ঘটনার মতো ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে পুলিশের ওয়াকিটকি থেকে তথ্য ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। আর ওই সব তথ্য সরকারবিরোধীদের কাছে চলে যাওয়ায় পুলিশও উদ্বিগ্ন। ওয়াকিটকি ছাড়াও পুলিশের অভিযান নিয়ে সরকারবিরোধীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা কিছু প্রচার করছে, যা বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছে বলে পুলিশ মনে করছে।
এ নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তর ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সদর দপ্তরসহ পুলিশের ইউনিটগুলোতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠক করেছেন।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, তথ্য ফাঁস রোধ করতে পুলিশ সদর দপ্তর বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এসব ঘটনায় পুলিশের কোনো সদস্য বা কর্মকর্তার পাশাপাশি যেসব দুর্বৃত্ত জড়িত তাদের শনাক্ত করতে পুলিশের সব কটি ইউনিট কাজ করছে। ওয়াকিটকিতে কোনো ধরনের বেফাঁস কথাবার্তা না বলার নির্দেশনা ছাড়াও সতর্কভাবে কথা বলতে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনা পেয়ে পুলিশের সব কটি ইউনিটপ্রধান ও জেলার পুলিশ সুপাররা (এসপি) আলাদাভাবে বৈঠক করেছেন। ওয়াকিটকির যেকোনো বার্তা ফাঁস বা রেকর্ড করার বিষয়ে কঠোর নজরদারি করতে লিখিত নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া দায়িত্বরত অবস্থায় আগ্নেয়াস্ত্র ও যানবাহন যাতে কোনো ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকেও নজর দিতে বলা হয়েছে। নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, যেকোনো অভিযানে যাওয়ার আগে ওয়াকিটকিতে গুরুত্বপূর্ণ কথোপকথন থেকে বিরত থাকতে হবে। জেলা ও থানা এলাকায় আসামি ধরার সময় অপরিচিত কেউ যাতে ভিডিও করতে না পারে, সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ওয়াকিটকিতে প্রকাশ্য কথা বলার কারণে পুলিশের অনেক গোপন তথ্য ফাঁস করে সরকারবিরোধীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে।
১৬ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে উপজেলা যুবদলের সদস্য সচিব কাউছার মিয়ার বাড়িতে বিশেষ অভিযান চালায় জেলা পুলিশ। কিন্তু ওই অভিযানে ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় সরকারবিরোধীরা। ভিডিওতে দেখা গেছে, অভিযানের সময় পুলিশ সদস্যরা বাড়িতে প্রবেশ করে কাউছারের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তর্কাতর্কি করছেন। এভাবে পুলিশের বেশিরভাগ অভিযান ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করে ভাবমূর্তিতে আঘাত করা হচ্ছে বলে পুলিশ মনে করছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গতকাল বলেন, ওয়াকিটকির মাধ্যমে অনেক তথ্য ফাঁস হওয়ায় বিষয়টি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ২৮ অক্টোবর থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত নানা সময়ের পুলিশের কথোপথন ফাঁস করছে। পুলিশ তদন্ত করে নিশ্চিত হয়েছে, সরকারবিরোধীরাই এসব অপকর্ম করছে। তারা তথ্যগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। যারা এসব অপকর্ম করছে তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, ঘাপটি মেরে থাকা পুলিশের কোনো সদস্য সরকারবিরোধীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে কি না, তাও তারা খতিয়ে দেখছেন। ঢাকা মহানগর পুলিশসহ (ডিএমপি) পুলিশের সব কটি ইউনিটপ্রধান ও জেলার পুলিশ সুপারদের (এসপি) কাছে বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ওয়াকিটটিতে গোপন কোনো কথা বলা রীতিমতো ভয়ংকর হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের কাছে। এ বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি।’
ডিএমপির কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ ওয়াকিটকিতে যেভাবে কথা বলে বিশ্বের কোথাও এভাবে বলা হয় না। রাস্তাঘাটে প্রকাশ্যে পুলিশ কর্মকর্তা ও অন্য সদস্যরা কথোপকথন করছেন। আর এ কারণে কোনো ধরনের গোপনীয়তা থাকে না। ওয়াকিটকি থেকে কল করা হলে সংশ্লিষ্ট জোনে ব্যবহারকারী সব পুলিশ সদস্য তা শুনতে পান।
এই কর্মকর্তারা আরও বলেন, ওয়াকিটকি নজরদারির আওতায় আনতে পারলে তথ্য পাচার হওয়ার মতো ঘটনা ঘটবে না। আর তা যদি না করা যায় তাহলে তথ্য ফাঁস হতেই থাকবে।