Bangladesh

ফিরে দেখা ২০২৩: রিজার্ভ তলানিতে, ভেঙে চূর্ণ ঋণশৃঙ্খলা ডলার সংকটে দিশেহারা উদ্যোক্তারা

বিদায়ি বছরজুড়ে দেশে গভীর সংকট ছিল মার্কিন মুদ্রা ডলারের। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে কমতে তলানিতে নেমে আসে; যা এখনও চলমান। এতে বিপাকে পড়েন শিল্পোদ্যোক্তারা। তারা ঠিকমতো এলসি খুলতে পারেননি। আর মূল্যস্ফীতি তছনছ করে দেয় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান। একই সঙ্গে কয়েকটি ব্যাংক এবং বেশির ভাগ নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে।

ইতোমধ্যে একটি ব্যাংকের পুরোনো পর্ষদ বাতিল করে নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। তারল্য সংকট থেকে বাঁচতে উচ্চসুদে আমানত খুঁজেও পাচ্ছে না অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এসব সংকট নিরসনে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। একাধিক নীতি পরিবর্তন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি আর্থিক সংকট। এরই মধ্যে ৩৬ বছরের চাকরিজীবনে কখনোই এমন অর্থনৈতিক সংকট দেখিনি বলে মন্তব্য করেছেন খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিলাসী পণ্য আমাদানি বন্ধ করা হয়। তুলে দেওয়া হয় ঋণ বিতরণ এবং আমানত সংগ্রহে বেঁধে দেওয়া সুদহারের সীমা। নতুন করে টাকা ছাপানোও বন্ধ করা হয়েছে। তবুও তারল্য, ডলার ও রিজার্ভের সংকট কাটেনি, নিয়ন্ত্রণেও আসেনি মূল্যস্ফীতি।

ডলার সংকট : দুই বছর আগে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৪ টাকার ঘরে। ২০২২ সালের শুরুর দিকেও ছিল ৮৫ টাকা ৭০ পয়সা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ধারাবাহিকভাবে ডলারের দাম বাড়তে থাকে। ২০২৩ সালের শুরুর দিকে দাম শতক ছাড়ায়। এরপর টানা বাড়তে থাকে। বর্তমানে প্রতি ডলারের দাম প্রবাসী আয় ও রপ্তানির জন্য ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা।

আর আমদানিতে খরচ পড়বে ১১০ টাকা। যদিও এটা কল্পনাপ্রসূত একটা দর, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের চাপে বাফেদা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এর সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। বাস্তবে ১২৩ টাকার কমে কোনো ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। তবে খোলাবাজারের অবস্থা আরও ভয়াবহ। সেখানে নগদ ডলারের দাম ১৩০-১৩২ টাকায় উঠেছে। তবু ডলার পাওয়া যাচ্ছে না।

ডলার সংকট ও দর বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন, বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। এ কারণে উচ্চ মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। জিনিসপত্রের বাড়তি ব্যয় মেটাতে কষ্ট হচ্ছে মানুষের। সব মিলিয়ে এ পরিস্থিতি অর্থনীতিকে বিপদে ফেলছে। নীতিনির্ধারকরা দীর্ঘদিন ধরে, ‘অচিরেই’ এর সমাধান হবে বললেও, সেই ‘অচিরেই’ আর আসছে না। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, আগস্টে রেমিট্যান্স কমেছে ২১ শতাংশ, যা এর আগের ছয় মাসের মধ্যে সর্বনিু। এটি রিজার্ভের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে।

এমডিদের পদত্যাগ : বিভিন্ন কারণে ২০২৩ সালে পদত্যাগ করেন চারটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। যেসব প্রতিষ্ঠানে পদত্যাগের ঘটনা ঘটে সেগুলো হলো ব্যাংক এশিয়া, সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স (এসবিএসি) ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক ও আভিভা ফাইন্যান্স। তবে তাদের দায়িত্বে ফেরানোর জন্য মধ্যস্থতা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর পদ্মা ব্যাংক ও এসবিএসি ব্যাংকের এমডি দায়িত্বে ফিরলেও ব্যাংক এশিয়া ও আভিভা ফাইন্যান্সের পদত্যাগ করা এমডিরা ফেরেননি। তাই এ দুই প্রতিষ্ঠানে নতুন এমডি নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

সিআইবি রিপোর্টিং পদ্ধতিতে পরিবর্তন : গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিভাগ হলো ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো বা সিআইবি। এটি এত গুরুত্বপূর্ণ যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দিষ্ট কর্মকর্তা ছাড়া আর কেউ এ বিভাগের কোনো বিষয় পর্যবেক্ষণ বা তথ্য পাওয়ার যোগ্য নন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা না পারলেও এতদিন তা পারত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান শাখা।

এখন থেকে ব্যাংকগুলোর শাখা অফিসও সিআইবি তথ্য পরিদর্শন ও পরিবর্তন করতে পারবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে এমন একটি সিদ্ধান্ত ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। এতে ব্যাংকারদের ওপর রাজনৈতিক চাপের শঙ্কা তৈরি হয়।

ডলার কারসাজি নিয়ে শাস্তি : বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় ডলার সংকট চলছে দীর্ঘদিন। ডলার দর নিয়ে কারসাজি করে ১০ ব্যাংক। নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দরে বিক্রির দায়ে জরিমানার মুখে পড়ে একাধিক ব্যাংক। শাস্তির মুখে পড়েন ৬ ব্যাংকের এমডি। সরিয়ে দেওয়া হয় এসব ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানদের। এসবের সুযোগে খোলাবাজারে ডলারের দাম সর্বোচ্চ ১৩২ টাকায় উঠে যায়। অন্যদিকে ডলারে বাড়তি দর রাখায় ৭ মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত এবং ১০টিকে শোকজ করা হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় একাধিক প্রতিষ্ঠানকে।

ঋণ নিয়ে আইএমএফ-এর নাটক : আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ পেতে নানা শর্ত বেঁধে দেয়। শর্ত পূরণেই আসে ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার। দ্বিতীয় কিস্তির ঋণ পেতে আরও শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। একের পর এক পরিদর্শন, পরামর্শ টিম পাঠানো হয়। ঋণ না পাওয়ার উপক্রমও তৈরি হয়। তবে রিজার্ভ ও রাজস্ব ছাড়া সব পূরণ হয় বাংলাদেশের। সব নাটকীয়তার পর ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার আসে দেশে।

একই পরিবার থেকে ব্যাংকের পরিচালক কমিয়ে আনা : একই পরিবার থেকে ব্যাংকের পরিচালক ৩ জনে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেওয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১-এর সংশোধনী অনুযায়ী, একটি ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডে একই পরিবারের সর্বোচ্চ ৪ জন সদস্য থাকতে পারবেন। ২০১৮ সালে আইনটিতে পরিবর্তন আনা হয়। চলতি বছরের ২১ জুন জাতীয় সংসদে পাশ হওয়া নতুন আইনে বলা হয়, একক পরিবারের পরিচালকের সংখ্যা ৩ জনের বেশি হতে পারবে না।

‘স্মার্ট’ পদ্ধতিতে ঠিক হবে ঋণের সুদহার : আইএমএফ-এর শর্ত ও ব্যাংকের তারল্য সংকট কাটাতে ৯ শতাংশ সুদহার তুলে আগামী দিনে ঋণের সুদহার কত হবে, তা ‘স্মার্ট’ পদ্ধতিতে ঠিক করা হয়। নতুন এ পদ্ধতি চলতি বছরের জুলাই থেকে কার্যকর হয়। ৯ শতাংশ ঋণ সুদহার তুলে দিয়ে ট্রেজারি বিল, বন্ডের ছয় মাসের গড় সুদহার (ওয়েটেড) বিবেচনা করে প্রতিমাসে একটি রেফারেন্স রেট নির্ধারণ করে দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক; এর সঙ্গে সর্বোচ্চ তিন শতাংশ সুদ যোগ করে ঋণ সুদহার নির্ধারণ করতে পারবে বাণিজ্যিক ব্যাংক।

পুরো ঋণ পরিশোধ করে শ্রীলংকা : দুই বছর আগে মুদ্রা বিনিময় চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ থেকে নেওয়া ২০০ মিলিয়ন বা ২০ কোটি ডলার ঋণের পুরোটাই পরিশোধ করেছে শ্রীলংকা।

খেলাপি ঋণের রেকর্ড : ব্যাংক খাতে চলতি বছর খেলাপি ঋণের নতুন রেকর্ড তৈরি হয়। জুন প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ এক লাফে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকায় উঠে যায়, যা বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। তখন ঋণ ছিল ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। যদিও খেলাপি ঋণের অঙ্ক নিয়ে বহু বিতর্ক আছে। বিআইবিএম-এর সাবেক মহাপরিচালক ড. মইনুল ইসলামের মতে, প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

রিজার্ভ নিয়ে লুকোচুরি : আইএমএফ-এর গণনা পদ্ধতিতে দেশের প্রকৃত রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করা হয় চলতি বছরের ১৩ জুলাই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, প্রায় সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলারের লুকোচুরি খেলা ছিল। ওইদিন আইএমএফ-এর গণনা পদ্ধতিতে দেশের রিজার্ভ ২৩.৫৭ বিলিয়ন ডলার আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে ২৯.৯৭ বিলিয়ন ডলার প্রকাশ করা হয়। এরপর রিজার্ভ অনেকখানি নেমে যায়, এমনকি তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ১৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। সব শেষ আইএমএফ-এর ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ৪০ কোটি ডলার ঋণের ওপর ভর করে দেশের রিজার্ভ কিছুটা বেড়েছে। এ দুই সংস্থার ঋণ পাওয়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৫ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার আর খরচ করার মতো রিজার্ভ অর্থাৎ (বিপিএম৬) ২০ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার হয়। যদিও নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে আকু পেমেন্ট রয়েছে। সেখানে এক বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি রিজার্ভ থেকে বের হবে।

আর্থিক হিসাবে ঘাটতির রেকর্ড : চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯৬ কোটি ডলার। গত বছরের একই সময়ে এই সূচকে ১২৭ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরে আর্থিক হিসাবের সূচকে ১ হাজার ৫৪৬ কোটি ডলারের বড় উদ্বৃত্ত ছিল। এ ঘাটতি দেখে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন।

পাঁচ শরিয়াহ ব্যাংকের লেনদেন সেবা বন্ধের উপক্রম : শরিয়াহভিত্তিক পাঁচ ব্যাংকের আর্থিক লেনদেন সেবা বন্ধের উপক্রম হয়েছে। ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের চলতি হিসাবের স্থিতি ঋণাত্মক। বারবার অবহিত করার পরও ব্যাংকগুলো উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি হিসাবের ঋণাত্মক স্থিতি সমন্বয়ের জন্য ২০ দিনের সময় বেঁধে দেয়।

ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদ বাতিল : অনিয়মের দায়ে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে নতুন পর্ষদ গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিধিবিধান লঙ্ঘন করে ঋণ অনুমোদন করা, পরিচালনা পর্ষদের ক্ষমতার অপব্যবহার, পরিচালক নির্বাচনসহ কয়েকটি কারণে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সুপারিশে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি পৃথক আদেশে এমন সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চিঠিতে বলা হয়, আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষা ও জনস্বার্থে ন্যাশনাল ব্যাংকের বিদ্যমান পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করা হলো।

Show More

7 Comments

  1. Hey very nice website!! Guy .. Beautiful .. Amazing .. I will bookmark your site and
    take the feeds also? I’m glad to seek out a lot of useful information right here within the publish,
    we want work out extra strategies in this regard, thank you for
    sharing. . . . . .

    Take a look at my web-site … vpn

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d