বাংলাদেশে প্রবেশ করতে নাফ নদীর তীরে হাজার হাজার রোহিঙ্গা
মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী ও সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর তুমুল লড়াইয়ের ফলে গ্রাম ছাড়া হচ্ছে রোহিঙ্গারা। বাংলাদেশে আসতে মিয়ানমারে নাফ নদীর তীরে আশ্রয় নিয়েছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। এপাড়ে থাকা রোহিঙ্গাদের সাথে ভিডিও কলে কথা বলে ওখানকার চলমান সঙ্ঘাতের বর্ণনা করেছে রোহিঙ্গাদের আত্নীয়-স্বজনেরা।
রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থান নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পাশাপাশি স্থানীয় সচেতন মহলও শক্ত অবস্থানের কথা জানিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাতে কড়া পাহারা বসিয়েছে, দিনেও চলছে কঠোর নজরদারি। তবু এর মধ্যেও বেশ কিছু রোহিঙ্গা গোপনে অনুপ্রবেশ করে দেশে ঢুকে পড়েছে। সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতিতে গত এক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য নাফ নদীর ওপারে এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে সীমান্তে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানিয়েছে, ঈদের পর পরই শাহপরীর দ্বীপের বিভিন্ন জায়গায় এসে আশ্রয় নিয়ে বেশ কিছু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাদের আত্নীয়-স্বজনের কাছে চলে গেছেন।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা যুবক ছৈয়দুল্লাহ বলেন, ‘এবার মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর পাশাপাশি মগদের সশস্ত্র বাহিনী আরাকান আর্মি (এএ) রাখাইনে মুসলিম সংখ্যালঘুদের ওপর চড়াও হয়েছে। সঙ্ঘাত বেড়ে যাওয়ায় তারা এপাড়ে চলে আসতে বাধ্য হচ্ছে।’
কত নম্বর ক্যাম্পে বা কোন আত্মীয়ের বাড়িতে ওঠেছেন জানতে চাইলে তিনি তা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
তিনি আরো জানান, ১৭ এপ্রিল মংডুর উত্তরের গ্রাম মাঙ্গালায় জান্তা বাহিনীর ক্যাম্পে হামলা করে আরাকান আর্মি। সংঘর্ষের একপর্যায়ে যোগ দেয় আরো একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী। ত্রিমুখী সংঘর্ষের ফল ভোগ করতে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের। একের পর এক গোলাবারুদ পড়ায় মাঙ্গালা ছেড়ে পেরাংপুর, বাজারপাড়া, শলাকা গ্রামে আশ্রয় নিচ্ছে তারা। রোহিঙ্গারা দলে দলে ছুটছেন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক রোহিঙ্গা যুবক বলেন, ‘দুই গ্রুপ যখন হামলা করে তখন তাদের গোলাবারুদ আমাদের বাড়িতে এসে পড়ে। তাই আমরা ভয়ে পালিয়ে এসেছি।’
গত মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে শাহপরীর দ্বীপ নাফ নদী-সংলগ্ন গোলাপাড়া ঝাউ বন বরাবর অনুপ্রবেশের সময় একটি রোহিঙ্গাবোঝাই নৌকা আটক করে বাংলাদেশ কোস্টগার্ড। ইঞ্জিনচালিত বড় নৌকায় ২৬ জন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছিল বাংলাদেশে। ১২ জন পুরুষ, নয়জন নারী এবং পাঁচজন শিশুসহ তিন দালালকে আটক করা হয় ও সময়।
রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ ওসমান বলেন, ‘জান্তা বাহিনী এবং আরাকান আর্মি দু’পক্ষই চায় রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করতে।’
রোহিঙ্গা সংগঠন এফডিএমএন আরসির বোর্ড সদস্য ছৈয়দ উল্লাহ বলেন, ‘আমরা বার বার তাদেরকে বলেছি এ দেশে না আসতে। প্রয়োজনে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে পালিয়ে থাকুক, তবু যেনো এপাড়ে না আসে। কারণ আমরা সাত বছরেও মিয়ানমার ফেরত যেতে পারিনি। যদি বাকিরাও চলে আসে তাহলে আরাকানে রোহিঙ্গাদের শেকড় হারিয়ে যাবে।’
স্থানীয়রা জানায়, কোনোভাবে রোহিঙ্গাদের আর এদেশে অনুপ্রবেশ করতে দেয়া ঠিক হবে না। তাই যার যার অবস্থান থেকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে প্রশাসনকে সহযোগীতা করা প্রয়োজন।
প্রশাসনের দাবি, অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবি-কোস্টগার্ডের পাশাপাশি প্রতিটি এলাকায় বাড়ানো হয়েছে নজরদারি।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প-সংলগ্ন পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘যদি রোহিঙ্গারা ঢুকে পড়ে তবে তাদেরকে ফেরত পাঠানো কঠিন হয়ে যাবে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে তারা যেনো বর্ডার অতিক্রম করতে না পারে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের উখিয়া উপজেলা সভাপতি নুর মোহাম্মদ সিকদার জানান, পুরাতন রোহিঙ্গা দালালরা এবং মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসার জন্যে কিছু স্থানীয় দালাল সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। এদের মাধ্যমে এরই মধ্যে কিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। বর্তমানে নাফ নদীর ওপাড়ের মনডিপাড়া চরে কমপক্ষে তিন হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছেন বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
শাহপরীর দ্বীপ বেড়িবাঁধ-সংলগ্ন লবণচাষি মোহাম্মদ করিম বলেন, ‘গত কয়েকদিন ধরে গভীর রাতে টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ গোলার ঝাউ বাগান এবং কচুবনিয়া দুর্গম চরে সন্দেহভাজনদের আনাগোনা দেখতে পাই আমরা। দুর্গম ও খারাপ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সেখানে যেতে ভয় পায় অনেকেই। সহজে বিজিবির সদস্যদের সেখানে টহলে যেতে দেখা যায় না।’
টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আদনান চৌধধুরী বলেন, ‘আমরা বিষয়টি প্রতিনিয়ত মনিটরিং করছি যেন কোনো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে।