Bangladesh

বাংলাদেশে বিগত তিনটি সংসদ নির্বাচনে ভারতের যে ভূমিকা ছিল

বাংলাদেশে নির্বাচনের মরশুম এলেই সেখানে যে প্রতিবেশী দেশটির প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য ‘ভূমিকা’ নিয়ে সবচেয়ে বেশি চর্চা হয়ে থাকে – তা নি:সন্দেহে ভারত। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী প্রচারণায় ‘ভারত ফ্যাক্টর’ যেমন ঘুরেফিরে আসে, তেমনি ভারত বাংলাদেশের নির্বাচনে ঠিক কী চাইছে তা নিয়েও জল্পনার অভাব থাকে না।

এবারের নির্বাচনও তার ব্যতিক্রম নয় – বস্তুত বিরোধী দল বিএনপি-র একজন শীর্ষ নেতা তো প্রকাশ্যে এমনও অভিযোগ করেছেন যে ‘দিল্লিই আসলে বাংলাদেশের নাগরিকদের (গণতান্ত্রিক) ভাগ্য ছিনিয়ে নিয়েছে।’ পরপর দুটো প্রশ্নবিদ্ধ সংসদীয় নির্বাচন করেও বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার যে একটানা পনেরো বছর ধরে ক্ষমতায় আছে, সেটাও ভারতের সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া কিছুতেই সম্ভব হত না বলে বাংলাদেশে অনেকেই বিশ্বাস করেন। প্রকাশ্যে তারা সে কথা বলেনও।

আবার উল্টোদিকে প্রভাবশালী প্রতিবেশী ভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থন যে তাদের দিকেই, ক্ষমতাসীন দল বা জোটের নেতা-মন্ত্রীদের সেটা নিয়ে বড়াই করতেও দেখা যায় প্রায়শই। অতি সম্প্রতি একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী তথা সাবেক এমপি তো জনৈক সরকারি কর্মকর্তাকে এমনও হুমকি দিয়েছেন, ‘মনে রাখতে হবে আমি শেখ হাসিনার প্রার্থী, ভারতের প্রার্থী!’ তাদের সেই টেলিফোন কথোপকথানের অডিও ফাঁস হয়ে ভাইরাল হলে তা তুমুল আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এবং এই ধরনের উদাহরণ অজস্র।

ভারত অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে কখনোই স্বীকার করে না যে প্রতিবেশী বাংলাদেশের নির্বাচনে তারা কোনও ‘ভূমিকা’ পালন করে বা আদৌ ‘হস্তক্ষেপ’ করে। বরং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অধিকার একান্তভাবেই সে দেশের নাগরিকদের – এটাই সরকারিভাবে ভারতের ঘোষিত অবস্থান। তবে দিল্লিতে একান্ত আলোচনায় সরকারি কর্মকর্তা, কূটনীতিবিদ বা বিশ্লেষকরা একটা কথা অবশ্য মেনে নেন – পৃথিবীতে সব দেশই চায় তাদের আশেপাশে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ সরকার থাকুক, আর ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। ভারতও চায় বাংলাদেশে এমন একটি সরকার আসুক, যাদের সঙ্গে তাদের কাজ করতে সুবিধে হবে এবং সম্পর্কও সহজ থাকবে।

কিন্তু ঢাকাতে একটি ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চেয়ে দিল্লি আসলে কতটা তৎপরতা দেখিয়েছে, তা নিয়ে বাংলাদেশে জল্পনা-কল্পনা কম হয়নি। সে দেশে বহু রাজনীতিবিদ ও পর্যবেক্ষকই মনে করেন – দিল্লির এই সক্রিয়তা কিছুটা হয়েছে প্রকাশ্যে, আর বেশিটাই পর্দার আড়ালে। এ প্রতিবেদনে আমরা ফিরে তাকিয়েছি ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৯ সালে বাংলাদেশের বিগত তিনটি সংসদীয় নির্বাচনে ভারতের সেই কথিত ‘ভূমিকা’র দিকে। বাংলাদেশের এই নির্বাচনগুলো নিয়ে ভারত কী অবস্থান নিয়েছিল, কী ধরনের বিবৃতি দিয়েছিল এবং নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরই বা কীভাবে, কী ধরনের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল সেগুলোই একে একে তুলে ধরা হয়েছে এখানে।

২৯ ডিসেম্বর ২০০৮

বাংলাদেশে গত তিনটি নির্বাচনের মধ্যে সবচেয়ে কম বিতর্কিত ছিল এটিই। বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ নিয়ে ৩০টি আসনে জিতেওছিল, তবে পরে তারা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় জালিয়াতির অভিযোগ তুললেও তা বিশেষ আমল পায়নি। বাংলাদেশে ওই নির্বাচনটি হয়েছিল সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে, যারা ‘ওয়ান ইলেভেনের’ মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে নির্বাচনের আগে পুরো দু’বছর দেশের সরকার পরিচালনা করেছিল।

তবে সেই সময়েই দেশের দুই প্রধান দল, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই শীর্ষ নেত্রী, যথাক্রমে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরানোরও কম চেষ্টা হয়নি। কিন্তু পরে অবশ্য তাদের নেতৃত্বেই দুই দল ভোটে লড়ে। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি নিজের আত্মজীবনীতে দাবি করেছেন, ওই দুই নেত্রীকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে তিনি নিজে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন।

ভারতে তখন মনমোহন সিংহের নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায়, আর প্রণব মুখার্জি ছিলেন তারই ক্যাবিনেটে পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বাংলাদেশে সেই নির্বাচনের ঠিক দশ মাস আগে সেনাপ্রধান, জেনারেল মইন ইউ আহমেদ রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে যান। ছ’দিনের ওই সফরে তিনি দেখা করেন মুখার্জির সঙ্গেও। ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ার্স (১৯৯৬-২০১২)’ বইতে প্রণব মুখার্জি জানিয়েছেন, হাসিনা-খালেদা সহ সব রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দেয়ার জন্য তিনি সে সময় বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের কাছে অনুরোধ জানান।

‘শেখ হাসিনা ছাড়া পেলে তাকে বরখাস্ত করে দেবেন, এটা ভেবে জেনারেল একটু উদ্বিগ্ন ছিলেন। কিন্তু আমি নিজে দায়িত্ব নিয়ে তাকে বলি, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ফিরে এলেও তার চাকরি বহাল থাকবে। এমনকি (রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির বিষয়ে) মার্কিন প্রেসিডেন্টের হস্তক্ষেপ চেয়ে আমি তার সঙ্গেও অ্যাপয়নমেন্টের ব্যবস্থা করি’, ওই বইতে লিখেছেন প্রণব মুখার্জি।

ফলে ২০০৮র নির্বাচনে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া যে শেষ পর্যন্ত লড়তে পেরেছিলেন, তার পেছনে ভারতের সক্রিয় ভূমিকার কথা নিজের বইতেই স্বীকার করে গেছেন ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। শেখ হাসিনার সঙ্গে তার পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্কও ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ, বস্তুত ‘প্রণববাবু’কে শেখ হাসিনা সম্বোধনই করতেন ‘কাকাবাবু’ বলে। এ ঘনিষ্ঠতার জোরেই তিনি জেনারেল মইন ইউ আহমেদকে শেখ হাসিনার হয়ে প্রতিশ্রুতি দিতে পেরেছিলেন, প্রণববাবুর লেখায় সেই ইঙ্গিতও ছিল।

ভারত এটাও চাইছিল যাতে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি কোনওভাবে ক্ষমতায় না-ফিরতে পারে। খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় মেয়াদে (২০০১-০৬) অনেকটা সময় ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনার ছিলেন ভিনা সিক্রি। তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, ‘এটা কোনও গোপন কথা নয় যে সে সময় দিল্লি ও ঢাকার সম্পর্ক একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল।’ ‘দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, যাতায়াত, সহযোগিতা সবই লাটে ওঠার উপক্রম হয়েছিল। ভারতের উত্তর-পূর্বের জঙ্গীরা সরাসরি মদত পাচ্ছিল। এ অবস্থাটা যে অবিলম্বে পাল্টানো দরকার তা নিয়ে দিল্লিতে কোনও দ্বিমত ছিল না।’

তবে ভিনা সিক্রি এটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য ভারতকে কিছুই করতে হয়নি – কারণ ‘বাংলাদেশের জনগণের বিপুল সমর্থনেই’ তিন-চতুর্থাংশের বেশি আসনে জিতে আওয়ামী লীগ সেবার ক্ষমতায় এসেছিল। শেখ হাসিনার বিপুল জয়লাভের পর ভারত সরকার তাকে স্বাগত জানিয়ে নির্বাচনের পর দিন (৩০ ডিসেম্বর) যে বিবৃতিটি দিয়েছিল সেটিও প্রণিধানযোগ্য।

প্রণব মুখার্জির মন্ত্রণালয়ের জারি করা ওই বিবৃতিতে সে দিন বলা হয়, “ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশে সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে যেভাবে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন ঘটল, তাতে ভারত বাংলাদেশের মানুষকে অভিনন্দন জানায়।” “শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের এই ঐতিহাসিক বিজয় সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে একটি বিরাট মাইলফলক।”

‘বিপুল সংখ্যায় ভোটারদের যোগদান ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সুষ্ঠু সম্পাদন আসলে গণতন্ত্রেরই মহান জয়। বাংলাদেশের জনগণ গণতান্ত্রিক পরম্পরায় তাদের আস্থা পুনর্ব্যক্ত করেছেন এবং উন্নয়ন ও প্রগতির পক্ষে একবাক্যে রায় দিয়েছেন।’ বাংলাদেশের সদ্য-নির্বাচিত শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে কাজ করার অঙ্গীকারও করা হয়েছিল ওই বিবৃতিতে – যে কথা দিল্লি আজও অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলছে বলে বহু পর্যবেক্ষকই মনে করেন।

৫ জানুয়ারি ২০১৪

বাংলাদেশের এ নির্বাচনটিতে ভারতের তথাকথিত ‘হস্তক্ষেপ’ সম্ভবত সবচেয়ে বেশি আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে, আর তার কারণ হল নির্বাচনের ঠিক এক মাস আগে ভারতের তৎকালীন শীর্ষ কূটনীতিবিদের বিতর্কিত এক ঢাকা সফর। ভারতের তদানীন্তন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর সরকারি সফরে মাত্র চব্বিশ ঘন্টার জন্য বাংলাদেশে আসেন। ওই সংক্ষিপ্ত সফরেই তিনি একে একে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠক করেন।

সুজাতা সিং আলোচনায় বসেন বাংলাদেশের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী ও পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হকের সঙ্গেও। এছাড়াও বাংলাদেশের প্রথম সারির সব গণমাধ্যমের সম্পাদকের সঙ্গেও তার একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের সেই সফরের আগেই প্রধান বিরোধী দল বিএনপি জানিয়ে দিয়েছিল তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা জানিয়েছিল জাতীয় পার্টিও।

ভারত ও বাংলাদেশের গণমাধ্যমে তখন লেখা হয়েছিল, জাতীয় পার্টিকে চাপ দিয়ে নির্বাচনে নিয়ে আসতে এবং নির্বাচনকে একটি ‘গ্রহণযোগ্য’ চেহারা দিতেই সুজাতা সিং জেনারলে এরশাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। জাতীয় পার্টির প্রধান নিজেও সে রকমই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তবে জেনারেল এরশাদ প্রথমে সেই অনুরোধে রাজি না-হলেও পরে সরকারের চাপে নির্বাচনে আসতে বাধ্য হন এবং বিএনপি-র অনুপস্থিতিতে জাতীয় পার্টিই প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা নেয়।

৫ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখেই ঢাকাতে সাংবাদিকদের সামনে সুজাতা সিং অবশ্য দাবি করেছিলেন, যে কোনও গণতন্ত্রে বিরোধী দলের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে এবং খালেদা জিয়া ও জেনারেল এরশাদের সঙ্গে তার বৈঠক বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ভারতের ‘চলমান সংলাপ প্রক্রিয়া’রই অংশ। ঢাকায় তখনকার ভারতীয় রাষ্ট্রদূত পঙ্কজ শরণকে পাশে নিয়ে সুজাতা সিং সে দিন আরও বলেন, “ভারত যে একটি স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল বাংলাদেশকে দেখতে চায় এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সফল সম্পাদনের ওপর গুরুত্ব দেয়, আমার এই বৈঠকগুলোতে আমি সেই বিষয়টির ওপরেই জোর দিয়েছি।”

ঢাকার মিডিয়াতে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের সেই মন্তব্যের ব্যাখ্যা করা হয়েছিল এভাবে – বাংলাদেশের নির্বাচনকে ‘ইনক্লুসিভ’ বা ‘অংশগ্রহণমূলক’ দেখানোর জন্যই ভারত সক্রিয় প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। দিল্লিতে একটি নামী থিঙ্কট্যাঙ্কের সিনিয়র ফেলো ও বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ স্ম্রুতি পট্টনায়ক অবশ্য মনে করেন, সুজাতা সিংয়ের সেই সফরকে গণমাধ্যমে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। বিবিসিকে তিনি বলছিলেন, “এটা ঠিকই যে তার উদ্যোগকে অনেকেই ‘হস্তক্ষেপ’ হিসেবে দেখেছিলেন। কিন্তু আমি মনে করি ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের প্রধান লক্ষ্য ছিল ঘরের পাশে বাংলাদেশে একটি সাংবিধানিক বিপর্যয় এড়ানো।”

বিরোধী দলগুলোকে বাদ দিয়ে কোনও নির্বাচন হলে তা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি পাবে না এবং বাংলাদেশ একটা সঙ্কটের মুখে পড়বে, যা ভারতের জন্যও কাঙ্ক্ষিত নয় – এই আশঙ্কা থেকেই দিল্লি ওই পদক্ষেপ নিয়েছিল বলে ড: পট্টনায়কের অভিমত। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত বিএনপি-বিহীন ওই নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের হিসেবে প্রায় ৪০ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পড়ে ও আওয়ামী লীগ ২৩৪টি আসনে জেতে।

ভারত মনে করছিল, বিএনপি না-এলেও জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনী ময়দানে নিয়ে আসতে পারায় এবং মোটামুটি ‘রিজনেবল’ একটা ভোট প্রদানের হার নিশ্চিত হওয়ায় বাংলাদেশের ওই নির্বাচনের স্বীকৃতি পেতে সমস্যা হবে না। নির্বাচনের দিনই ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দিন এক বিবৃতিতে জানান, “বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল একটি সাংবিধানিক প্রয়োজনীয়তা।” “সহিংসতা কখনোই এগোনোর পথ হতে পারে না। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারাকে অবশ্যই তার নিজস্ব পথে চলতে দিতে হবে”, আরও মন্তব্য করেন তিনি।

এর ঠিক এক সপ্তাহ পর আবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন শেখ হাসিনা। যে বিশ্বনেতারা তাকে সবার আগে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-ও। ১২ জানুয়ারি সন্ধ্যার দিকে শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করে তিনি অভিনন্দন জানান এবং বলেন, “বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার জন্য আমি আপনার দেশের জনসাধারণের উদ্যোগের সাফল্য কামনা করি।”

৩০ ডিসেম্বর ২০১৮

পাঁচ বছর আগের অভিজ্ঞতা থেকে ঠেকে শিখেই বা অন্য যে কোনও কারণে, বাংলাদেশের ২০১৮র নির্বাচন থেকে ভারত কিন্তু সচেতনভাবে একটা দূরত্ব বজায় রাখছিল বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই। অন্তত প্রকাশ্যে তো বটেই। নির্বাচনের ঠিক দশ দিন আগে (২০ ডিসেম্বর ২০১৮) ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রবীশ কুমার তার সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে বলেন, “বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গে বলব, এটা একান্তভাবেই সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়।”

‘বাংলাদেশ শুধু আমাদের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ও দারুণ সহযোগীই নয়, সে দেশে খুব প্রাণবন্ত একটি গণতন্ত্রও রয়েছে। আমরা বাংলাদেশে সেই গণতন্ত্রের কার্যক্রমকে সম্মান করি’, আরও জানান তিনি। তবে ভারতের এই ‘আপাত নিস্পৃহতা’র পেছনে যেটাকে সবচেয়ে বড় কারণ বলে মনে করা হচ্ছিল, তা হল বাংলাদেশের ওই নির্বাচনে বিএনপি-র অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত।

সে বারে বিএনপি তাদের সমমনা আরও কিছু দলকে সঙ্গে নিয়ে ‘ঐক্যজোট’ গঠন করে ভোটে লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আবার ওই একই সময় ভারতে বিজেপি-বিরোধী বেশ কয়েকটি দল নিজেদের মধ্যে জোট গড়ে পরবর্তী নির্বাচনে লড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, যে জোটকে হিন্দিতে বলা হচ্ছিল ‘মহাগঠবন্ধন’। ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী তখন বিবিসিকে বলেছিলেন, বাংলাদেশের ওই নির্বাচন যেহেতু অনেকটাই অংশগ্রহণমূলক হতে যাচ্ছে তাই ভারতেরও সেটা নিয়ে ‘অত মাথা ঘামানোর কোনও প্রয়োজন নে ‘!

তার মন্তব্য ছিল, “বড় পরিবর্তন বাংলাদেশে যেটা দেখতে পাচ্ছি তা হল ভারতে যেটাকে আমরা ‘মহাগঠবন্ধন’ বলি, সেই ধাঁচে ওখানেও বিরোধীদের ঐক্যফ্রন্ট আত্মপ্রকাশ করেছে।” “এখন তো আবার যুক্তফ্রন্টও চলে এসেছে। ফলে নির্বাচন সঠিক পথেই আছে মনে হচ্ছে – আর এভাবে যদি সব এগোয় তাহলে তো ২০১৪র তুলনায় সেটা সম্পূর্ণ আলাদা বলেই ধরতে হবে!”

ফলে ওই নির্বাচনের ঠিক আগে আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব তো দূরস্থান, শীর্ষ পর্যায়ের কোনও কূটনীতিবিদ বা কর্মকর্তাই প্রকাশ্যে অন্তত ঢাকা সফর করেননি। যদিও বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন কমিশনারের আমন্ত্রণে ভারতের সরকারি কর্মকর্তাদের একটি বড় দল সে দেশে গিয়ে (২৮-৩১ ডিসেম্বর, ২০১৮) পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়াটি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।

নির্বাচনের মাস দেড়েক আগে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে অবশ্য বলা হয়েছিল, “বাংলাদেশে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের নিস্পৃহ ভাব দেখানোর বিষয়টি হয়তো তাদের কৌশলে কোনও পরিবর্তন হতে পারে।” প্রকাশ্যে নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করলেও নির্বাচনে ভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থন যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের দিকেই ছিল, তা অবশ্য দিল্লিতে কোনও গোপন বিষয় ছিল না।

বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে যায়, যখন ৩০ ডিসেম্বরের ওই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। বহু জায়গায় ভোটগ্রহণ শুরুর আনেক আগেই মাঝরাতে শাসক দলের পক্ষে ভোট দেয়া হয়ে গেছে বলে জানা যায়, বিবিসি-ও সেই কারচুপির ভিডিও প্রকাশ করে। ভোটগ্রহণের দিনই মাঝপথে এই ‘মধ্যরাতের নির্বাচন’কে বয়কট করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ায় বিরোধী দল বিএনপি।

এদিকে ভোট গণনা শুরু হওয়ার পর মাঝরাত নাগাদই স্পষ্ট হয়ে যায় আওয়ামী লীগ ও মহাজোট আবার বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসছে। বস্তুত আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি-সহ তাদের শরিক দলগুলো সেবার ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩টিতেই জয়লাভ করে। নির্বাচনী অনিয়ম নিয়ে ভারতের পক্ষ থেকে কিন্তু বিন্দুমাত্র সমালোচনা করা হয়নি। ভারত থেকে যাওয়া যে ‘পর্যবেক্ষক’রা তখন বাংলাদেশে ছিলেন, তাদের রিপোর্টেও এই সব কারচুপি বা জালিয়াতির কোনও উল্লেখ ছিল না।

তবে ৩১ ডিসেম্বর সকালে দিল্লি থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ফোন আসতে একটু দেরি হচ্ছিল বলে ঢাকায় মৃদু অস্বস্তিও তৈরি হচ্ছিল। অবশেষে বাংলাদেশ সময় বেলা এগারোটা নাগাদ প্রধানমন্ত্রী মোদী ঢাকায় ফোন করে প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে অভিনন্দন জানান। দুজনের মধ্যে বেশ খানিকক্ষণ ধরে অত্যন্ত ‘বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা’ হয়েছে বলেও জানানো হয়। আওয়ামী লীগের নির্ণায়ক জয় ও শেখ হাসিনার ‘দূরদর্শী’ নেতৃত্বে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে বলেও নরেন্দ্র মোদী আশা প্রকাশ করেন।

বিশ্বনেতাদের মধ্যে নরেন্দ্র মোদীই যেহেতু প্রথম তাকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন, সে জন্য শেখ হাসিনাও তাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। পরে দিল্লিতে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “প্রতিবেশী, আঞ্চলিক উন্নয়ন ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং ভারতের ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ নীতির একটি কেন্দ্রীয় স্তম্ভ হিসেবে বাংলাদেশকে ভারত যে কতটা গুরুত্ব দেয়, প্রধানমন্ত্রী মোদী তা পুনর্ব্যক্ত করেছেন।”

তবে তখনও ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের কাছ থেকে কোনও অভিনন্দনবার্তা আসেনি – যে দলটি ও তার নেতৃত্বের সঙ্গে শেখ হাসিনার সম্পর্ক শুধু ঘনিষ্ঠ নয়, বরং পারিবারিকও বটে। আসলে কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট রাহুল গান্ধী তখন বিদেশে ছুটি কাটাচ্ছেন। ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের তদানীন্তন রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলি পার্লামেন্টে কংগ্রেসের নেতা আনন্দ শর্মাকে মোবাইলে ধরে অনুযোগ করেন, “প্রধানমন্ত্রীর ফোন অবধি চলে এল, কংগ্রেসের কাছ থেকে কোনও বার্তা পেলাম না!”

আনন্দ শর্মা অনেক কষ্টে তড়িঘড়ি রাহুল গান্ধীকে খুঁজে বের করে কংগ্রেসের পক্ষ থেকেও বিবৃতি জারি করানোর ব্যবস্থা করালেন। ভারতের ‘গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি’ও অত:পর দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দেয়, “বাংলাদেশে শেখ হাসিনার এই জয় আসলে গণতন্ত্রের জয়”! শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগের প্রতি ভারতের সমর্থন যে ‘বাইপার্টিজান’ বা দলমতনির্বিশেষে – সেটাই আরও একবার প্রমাণিত হল!

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
Situs Toto
Toto Gacor
bacan4d
bacansport login
slot gacor
pasaran togel resmi
bacan4d
toto togel
slot toto
Toto slot gacor
bacan4d
slotgacor
bacan4d rtp
bacan4d
bacan4d toto
Slot Casino
bacan4d toto
slot gacor
bacan4d
bacan4d
Slot Toto
bacan4d
bacan4d login
totoslotgacor
slot gacor
TOTO GACOR
bacan4d
bacan4d slot gacor
bacan4d login
Bacan4d
bacan4d
bacan4d bonus
Toto gacor
Toto gacor
slot gacor hari ini
bacan4d toto
bacan4d toto
bacan4d
bacan4d
bacan4d
toto slot
bacan4d
bacan4d link alternatif
slot gacor bett 200
situs toto
SITUS TOTO
toto 4d
Slot Toto
Slot Toto
Slot Toto
Situs toto
Slot toto
Slot Dana
Slot Dana
Judi Bola
Judi Bola
Slot Gacor
toto slot
bacan4d toto
bacan4d akun demo slot
bacantogel
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacantoto
bacan4d
Bacan4d Login
slot demo
Bacan4d Toto
toto gacor
Slot Gacor
Live Draw
Live Draw Hk
Slot Gacor
toto slot
Bacan4d slot gacor
toto macau
toto slot
Toto Gacor
slot dana
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
Slot Dp Pulsa
Bacan4d Login
toto slot
Bacansports/a>
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
slot gacor
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
slot demo
toto slot gacor
bacansports Slot toto toto slot Slot toto Slot dana Slot toto slot maxwin slot maxwin toto slot toto slot slot dana
Toto Bola
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
bacan4d
ts77casino
situs toto
slot pulsa
bacansports
situs toto
slot toto
situs toto
slot toto
situs toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansports
slot toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
situs toto
situs toto
xx1toto
toto slot
xx1toto
xx1toto
slot qriss
Slot Toto
slot dana
situs toto
slot toto
slot dana
Situs Toto Slot Gacor
xx1toto
xx1toto
bacan4d
xx1toto
xx1toto
toto slot
situs toto slot gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
situs toto
Slot Toto
Toto Slot
Slot Gacor
Slot Gacor
Slot Gacor
slot toto
Toto Slot
slot gacor
situs togel
Toto Slot
xx1toto
bacansport
bacan4d
toto slot
situs toto
slot gacor
Toto Slot
slot maxwin
slot demo
bacan4d toto slot
bacan4d toto slot
bacan4d slot
bacan4d slot
bacan4d slot
bacansports
bacansports
bacansports
bacan4d slot
bacan4d slot
bacan4d
slot gacor
pasaran togel resmi
situs toto
bacan4d login
pasaran togel
pasaran togel
situs toto
bacan4d
bacan4d gacor
bacan4d slot
bacan4d rtp
bacan4d rtp
bacan4d slot gacor
toto slot
situs toto
bacan4d
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bandar togel
toto gacor Toto Gacor bacan4d slot toto casino slot slot gacor bacantoto totogacorslot Toto gacor bacan4d login slotgacor bacan4d bacan4d toto Slot Gacor toto 4d bacan4d toto slot bacan4d slot gacor