বিদেশি ঋণ : কোন পথে বাংলাদেশ
বাংলাদেশের ওপর বিদেশি ঋণের চাপ বাড়ছে। আর এখন ঋণ করে ঋণ পরিশোধের পথে হাঁটছে সরকার।
সিপিডির তথ্য বলছে, গত অর্থবছর শেষে মোট বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাত হাজার ৭৬ কোটি ডলার, যা আগের এক যুগের মধ্যে তিন গুণ বেড়েছে।
এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের জন্য সামনে সংকটঅপেক্ষা করছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিতে হবে। আর কমাতে হবে দুর্নীতি। একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে ঋণ পরিশোধ করতে হয় বিদেশি মুদ্রায়। সেজন্য বিদেশি মুদ্রা আয়ও বাড়াতে হবে। তবে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, “বাংলাদেশ কোনো খারাপ অবস্থায় নেই। ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা আছে বাংলাদেশের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত দেশ।”
বিদেশি ঋণ পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে:
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ( সিপিডি) বলছে, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ এখন দেড় লাখ টাকা। মাত্র তিন বছর আগে মাথাপিছু ঋণ ছিলো এক লাখ টাকা।
২০১৫-১৬ অর্থবছরের জিডিপির তুলনায় সাড়ে ১৫ শতাংশ বিদেশি ঋণ নেওয়া হয়েছে। প্রতিবছরই এই অনুপাত বেড়েছে। সর্বশেষ গত অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২১.৮ শতাংশে। এই অনুপাত এখনো খারাপ অবস্থায় না গেলেও ঋণ পরিশোধের সক্ষমতার ওপর পরিস্থিতি নির্ভর করে।
সিপিডির তথ্য বলছে, গত অর্থবছর শেষে মোট বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাত হাজার ৭৬ কোটি ডলার, যা আগের এক যুগের মধ্যে তিন গুণ বেড়েছে। অন্যদিকে গত অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৪৭০ কোটি ডলার শোধ করতে হয়েছে। শুধু এক বছরের ব্যবধানেই এই ঋণ পরিশোধ ১১০ কোটি ডলার বেড়েছে। এমন অবস্থায় সরকার চলতি অর্থবছরেই দাতাদের কাছ থেকে আরো এক হাজার কোটি ডলার ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ বলছে, গত জুলাই ডিসেম্বরে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ বেড়েছে প্রায় ৪৯ ভাগ। ওই ছয় মাসে বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করতে হয়েছে ১৫৬ কোটি ডলার।
আগের অর্থবছরে (২০২২-২৩) একই সময়ে যা ছিল ১০৫ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ৪৮.৮২ ভাগ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী চলতি অর্থ বছরে(২০২৩-২৪) মোট আসল ও সুদ পরিশোধ করতে হবে ৩২৮ কোটি ডলার। আগামী অর্থ বছরে যার পরিমাণ হবে ৪০০ কোটি ডলার।
এরপর এর পরিমাণ বাড়তেই থাকবে। ২০২৯-৩০ সালে যা হবে ৫১৫ কোটি ডলার।
কোন পথে বাংলাদেশ?
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের(সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন,” আমাদের যে ধরনেরঅর্থনীতি তাতে আমাদের ঋণ নিতে হবে। সেটা অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যই নিতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো সেই ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা আমাদের আছে কী না। আমরা সঠিক প্রকল্পে ঋণ নিয়ে সঠিকভাবে ব্যবহার করছি কি না।”
তার কথায়,” বাংলাদেশ এমন কিছু প্রকল্পে ঋণ নিয়েছে যে সেইসব প্রকল্পের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আরেকটি বিষয় হলো দুর্নীতি। প্রকল্পের সময় বাড়িয়ে খরচ বাড়ানো হয়েছে। আরো ঋণ নেয়া হয়েছে। সেটা আবার দুর্নীতির খাতে চলে গেছে। আমাদের তো ঋণ শোধ করতে হবে ডলারে( বিদেশি মুদ্রা)। তার জন্য আমরা প্রবাসী আয় এবং রপ্তানি আয়ের ওপর অতি মাত্রায় নির্ভরশীল। বিদেশি বিনিয়োগ তো বাড়ছে না। সেটা না বাড়লে তো সমস্যা”
“আর আমরা বেশির ভাগ ঋণ নিয়েছি দ্বিপাক্ষিকভাবে( যেমন: রাশিয়া, চীন)। এই ঋণের সুদের হার বেশি। পরিশোধের সময়ও কম। আর এই ঋণে নজদারি কম থাকায় দুর্নীতিও বেশি। যারা ঋণ দেয় তারা কাঁচামাল, বিশেষজ্ঞসহ আরো অনেক কিছু তাদের দেশ থেকে নেয়ার শর্ত দেয়।”
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন,” আমরা ঋণ করে অনেকগুলো অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নিয়েছি এবং এখনো নিয়ে যাচ্ছি। এইস সব প্রকল্পে যত খরচ হওয়ার কথা তার চেয়ে অনেক বেশি খরচ করেছি। এগুলো আমরা পুঁজি লুন্ঠানের জন্য ব্যবহার করেছি। ফলে বাংলাদেশে প্রকল্পের খরচ বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ । এইসব কারণে ঋণ এখন ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক অবস্থা। ২০২৫ সাল নাগাদ ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ অনেক বেড়ে যাবে। আর ঋণ করেই আমাদের ঋণ পরিশোধ করতে হতে পারে। ”
এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সরকারের উদ্যোগের প্রশ্নে তিনি বলেন,” না, সরকারের আসলে কোনো উদ্যোগ নাই। যারা এইভাবে পুঁজি লুণ্ঠন করছে তারা সরকারের খুব ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার। তারা পুঁজি লুণ্ঠন করে দেশের বাইরে পাচার করছে। এই প্রক্রিয়াটার সঙ্গে সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব ওতপ্রোতভাবে জড়িত।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,” প্রধানমন্ত্রী বলছেন অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প না নিতে। কিন্তু কথার সাথে বাস্তবের মিল নাই। রূপপুরে আরো দুইটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য তিনি রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করছেন।”
“পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে কিন্তু সেটা কোন পর্যায়ে যাবে সেটা বলার সময় এখনো আসেনি,” বলেন এই অর্থনীতিবিদ।
“মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত দেশ”
সদ্য সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এম এ মান্নান এমপি অবশ্য মনে করেন বিদেশি ঋণ পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নাই। তিনি বলেন,” আমি পণ্ডিত ব্যক্তিদের মতো বলতে পারবনা। আমার কথা হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই মুহূর্তে বিশ্বের বৃহত্তম ঋণগ্রস্ত জাতি। সবচেয়ে বেশি ঋণ তাদের। এইভাবে খুঁজলে আরো পাওয়া যাবে। আসলে এটা কোনো বিষয় নয়। বিষয় হলো, মানুষের জীবনযাত্রা কেমন। এখানে মূল্যস্ফীতি আছে । কিন্তু আমাদের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এই ধরনের প্রবৃদ্ধির অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির চাপ থাকে।”
তার কথায়,” প্রকল্প প্রয়োজনীয় , অপ্রয়োজনীয় হতে পারে। আর এইসব প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে আমরা সেটা না বললেও সিস্টেমের করণে প্রকল্পের সময় ও খরচ বেড়েছে সেটা ঠিক। আসল কথা হলো নিয়ন্ত্রণে আছে কি না।”
কতটা নিয়ন্ত্রণে আছে জানতে চাইলে বলেন,” আমি বলব পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে। মূল্যস্ফীতি শুধু বাড়ছে না কমছেও। বাড়া কমার মধ্যে আছে। এটা ভালো দিক। কিছু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আর সমাজের কিছু মানুষের নেতিবাচক মন্তব্য ছাড়া আর সব কিছু ঠিক আছে। সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আস্থা আছে। তবে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ আরো বাড়াতে হবে। সরকার জানে কোথায় কোথায় সমস্যা আছে। সেটা সরকার ঠিক করে ফেলবে।”