‘বিরোধী নেতাদের অভিযুক্ত করতে সরকার বিচার বিভাগকে ব্যবহার করছে’
মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ৬ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের উদ্বেগ
দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির আন্দোলনের মুখে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখার আহ্বান জানিয়েছে ৬টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন। আগামী ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ জাতীয় নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানে মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং নাগরিক সমাজের স্থান সংকুচিত হয়ে আসায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে তারা। গতকাল রবার্ট এ. কেনেডি হিউম্যান রাইটস-এর ওয়েবসাইটে এ বিষয়ক যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে। উদ্বেগ প্রকাশ করা সংগঠনগুলো হলো- রবার্ট এ. কেনেডি হিউম্যান রাইটস (আরএফকেএইচআর), ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট জাস্টিস প্রজেক্ট (সিপিজেপি), দ্য ইউনাইটেড এগেইনস্ট টর্চার কনসোর্টিয়াম (ইউএটিসি), এশিয়ান ফেডারেশন এগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপেয়ান্সেস (এএফএডি), এন্টি- ডেথ পেনাল্টি এশিয়া নেটওয়ার্ক (এডিপিএএন) এবং ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন এগেইনস্ট এনফোর্সড ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস (আইসিএইডি)।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিবৃতিতে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে চারটি সুপারিশ তুলে ধরেছে। তাতে বাংলাদেশের মানবাধিকার ও নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে। সুপারিশগুলো হলো- ১. প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা, নিজের স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত সততাকে যাতে সম্মান করা হয়, সুরক্ষিত রাখা হয়- তা নিশ্চিত করতে হবে। ২. অবিলম্বে এবং নিঃশর্তভাবে সব রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। খেয়ালখুশিমতো আটক অধিকারকর্মী এবং বিরোধী দলীয় সদস্যদের মুক্তি দিতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে সুষ্ঠু এবং স্বচ্ছ বিচারিক প্রক্রিয়া। ৩. ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের পূর্ণাঙ্গ এবং পক্ষপাতহীন তদন্ত করতে হবে। এর মধ্যে থাকবে মৃত্যু এবং নির্যাতনের অভিযোগগুলোও। ৪. আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ডাটা সুরক্ষা আইনের খসড়াকে পুনর্মূল্যায়ন এবং রিভাইস করতে হবে। নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও অধিকারকে সুরক্ষিত রাখতে হবে।
বিবৃতিতে বলা হয়, উপরন্তু আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানাই বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে মনিটরিং করতে এবং মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত রাখায় ব্যবস্থা নিতে।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, আগামী বছর ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং নাগরিক সমাজের জন্য স্থান সংকুচিত হওয়ায় আমরা বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি। রাজনৈতিক বিরোধীদের সমন্বিত র্যালি ও প্রতিবাদ বিক্ষোভের পর এ বছর অক্টোবরের শেষের দিক থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এসব প্রতিবাদকারী ও রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীকে দমন করতে সহিংসতা ফিরিয়ে এনেছে। এই দমনপীড়নে একজন সাংবাদিকসহ ১৭ জনকে হত্যা করা হয়েছে। বিরোধী দলের ৮২৪৯ জন নেতা আহত হয়েছেন। উপরন্তু, হবিগঞ্জ শহরের শায়েস্তানগর এলাকায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস স্মরণে আয়োজিত মানববন্ধনের সময় পুলিশ, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে কমপক্ষে ৫০ জন আহত হয়েছেন। সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ডের জরুরি ভিত্তিতে জবাবদিহিতা, একটি পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্তের প্রয়োজনীয়তা আরও জোরালো করেছে এসব ঘটনা। সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের বৈষম্যমূলক আচরণ এবং অতিমাত্রায় কাঁদানে গ্যাস, লাঠি, লাঠিপেটা, রাবার বুলেট ব্যবহার এবং একই রকম অন্যান্য ব্যবস্থার ব্যবহার উদ্বেগকে গুরুতর করে তুলেছে। পুলিশের সরঞ্জামের অপব্যবহারের বিষয়টি অবিলম্বে সমাধান প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, এসব হাতিয়ারের অযৌক্তিক ব্যবহার শুধু নাগরিকদের মৌলিক মানবাধিকারই লঙ্ঘন করে এমন নয়। একই সঙ্গে উত্তেজনাকে বৃদ্ধি করে। সৃষ্টি করে এমন একটি পরিবেশ, যা ভিন্নমতাবলম্বী, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ এবং গণতান্ত্রিক আলোচনাকে বাধাগ্রস্ত করে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করতে হবে। এর মধ্যে আছে জাতিসংঘের ‘বেসিক প্রিন্সিপালস অন দ্য ইউজ অব ফোর্স অ্যান্ড ফায়ারআর্মস বাই ল এনফোর্সমেন্ট অফিসিয়ালস’ এবং জাতিসংঘের ‘হিউম্যান রাইটস গাইডেন্স অব লেস-লেথাল উইপন্স ইন ল এনফোর্সমেন্ট’।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো থেকে বলা হয়, উপরন্তু অক্টোবরের শেষের দিক থেকে বাংলাদেশ সরকার গণহারে এবং খেয়ালখুশি মতো কমপক্ষে ২০ হাজার মানুষকে আটক করেছে, যারা বিরোধী দলের বা বিরোধী দলের সমর্থক হিসেবে মনে করা হয়। ৮৩৪টি বানোয়াট মামলার অভিযোগে এসব গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বৈধ প্রেক্ষাপট থাকা সত্ত্বেও অব্যাহতভাবে এসব মামলায় জামিন অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। যথাযথ প্রক্রিয়ার নিশ্চয়তাকেও বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন এবং বেআইনিভাবে নিঃসঙ্গ রাখার অব্যাহত ও বিশ্বাসযোগ্য রিপোর্ট আছে। নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতনের এই অভিযোগ শুধু গত মাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আগেও একই রকম অভিযোগের রিপোর্ট করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে প্রহার, বৈদ্যুতিক শক, ওয়াটারবোর্ডিং, ইচ্ছাকৃতভাবে গুলি করে দেয়ার মতো দৃশ্য তৈরি করা- হাঁটুর নিচে গুলি করা, ভুয়া মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দৃশ্য তৈরি করা এবং জোরপূর্বক নগ্ন করা।
বিবৃতিতে বলা হয়, গণহারে বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের অভিযুক্ত করতে পর্যায়ক্রমিকভাবে বিচার বিভাগকে ব্যবহার করছে সরকার। এক্ষেত্রে তারা ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলের শক্তিধর প্রার্থীদের অযোগ্য করতে বর্ধিত সময়েও রাতে আদালতে বিচার করছে। এ বিষয়ে কয়েক মাস আগেই পরিকল্পনা করা হয়েছে। গণহারে এই আটক এবং অভিযুক্ত করার মধ্য দিয়ে শুধুমাত্র মত প্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ, স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত সততা এবং সুষ্ঠু বিচারের অধিকারকেই ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে এমন না। একই সঙ্গে পুরো পরিবারকে সীমাহীন হতাশায় ডুবিয়ে দেয়া হচ্ছে। কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই আটক ব্যক্তি তার পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস।
অতিমাত্রায় সহিংসতার ব্যবহার এবং খেয়ালখুশি মতো আটক বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের ভয়াবহ চিত্র ফুটিয়ে তোলে। জনগণ আগামী মাসে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি করছে যখন, তখন এসব নির্যাতন করা হচ্ছে। গণতন্ত্রের মৌলিক মূলনীতিকে সমুন্নত করার পরিবর্তে বাংলাদেশ সরকার সহিংস ও দমনপীড়নের মতো পদক্ষেপ ব্যবহার করছে। তাতে ভয়, উদ্বেগ এবং নাগরিকদের জন্য চরম অনিরাপদ এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা এই সহিংস দমনপীড়নের বিষয়ে তাদের উদ্বেগ শেয়ার করেছেন- ‘বাংলাদেশ যেহেতু ২০২৪ সালের শুরুর দিকে জাতীয় নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তখন রাজনৈতিক সহিংসতা, বিরোধী দলের সিনিয়র নেতাদের গ্রেপ্তার, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের কয়েক হাজারকে গণহারে খেয়ালখুশি মতো আটক, কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত শক্তির ব্যবহার, প্রতিবাদ বিক্ষোভে বিঘ্ন ঘটাতে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া, প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে আটক ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদেরকে হয়রান, ভীতি প্রদর্শন ও বেআইনি আটকের ঘটনা বৃদ্ধিতে আমরা গভীরভাবে হতাশ’।
এতে বলা হয়, আরেকটি উদ্বেগের বিষয়ক হলো খসড়া ডাটা সুরক্ষা আইন। এতে আইন প্রয়োগকারীদেরকে নাগরিকের ডাটায় বাধাহীন প্রবেশাধিকার দেয়া হয়েছে। যদি জাতীয় নিরাপত্তা, প্রতিরোধ অথবা কোনো অপরাধ শনাক্ত হয় বলে মনে হয়, তখনই তারা এটা ব্যবহার করতে পারবে। এই ক্ষমতার অপব্যবহারে ব্যাপক বিস্তৃত নজরদারি সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের। এর ফলে মানবাধিকার, বিশেষ করে ব্যক্তিগত গোপনীয় তথ্যের বিষয়ে হুমকি হয়ে উঠতে পারে। যেসব ক্ষেত্রে এসব ডাটা সংগ্রহ করা হবে এবং ডাটার সুযোগ প্রয়োজন হবে- তা পরিষ্কারভাবে সংজ্ঞায়িত করা উচিত। এসব ক্ষেত্রে সময়োপযোগী নিরপেক্ষ বিচারিক পর্যালোচনা প্রয়োজন।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের জনগণ একটি সুষ্ঠু, গণতান্ত্রিক এবং শান্তিপূর্ণ সমাজের জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে যেহেতু, তাই আমরাও বাংলাদেশের এসব মানুষের পাশে আছি। অবিলম্বে সহিংসতা, নিপীড়ন, রাজনৈতিক বিরোধীদের টার্গেট করে ভীতি প্রদর্শন অবিলম্বে বন্ধ রাখার জন্য দৃঢ়তার সঙ্গে আহ্বান জানাই।