বিশ্বব্যাংকের ঋণে ১১ লাখ প্রিপেইড মিটার
দ্বিগুণ দামে কেনার প্রস্তাব
২০০ টাকা মাসিক চার্জ কাটার উদ্যোগ * বিদেশে প্রশিক্ষণ, পরামর্শক ও গাড়ি কেনার প্রস্তাবে প্রশ্ন * আপত্তি জানিয়ে প্রকল্প ফেরত দিচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন
চলমান ও সমাপ্ত প্রকল্পের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ দামের প্রিপেইড মিটার কেনার প্রস্তাব দিয়েছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (টিজিটিডিসিএল)।
সেই সঙ্গে দেশে পাওয়া গেলেও ২ লাখ ২২ হাজার রেগুলেটর আমদানির কথা বলা হয়। পাশাপাশি গ্রাহকদের কাছ থেকে মিটার চার্জ বাবদ বর্তমান রেটের দ্বিগুণ আদায়, উচ্চ ব্যয়ে পরামর্শক, বিদেশ ভ্রমণ ও গাড়ি কেনার প্রস্তাব দেয় সংস্থাটি।
‘গ্যাস সেক্টর ইফিসিয়েন্সি ইমপ্রুভমেন্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট মিটিগেশন’ শীর্ষক প্রকল্পে এমন অসামঞ্জস্য ব্যয় প্রস্তাব আসে। কিন্তু আপত্তি জানিয়ে প্রকল্প ফেরত দিতে যাচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন।
এক্ষেত্রে বলা হয়, বিভিন্ন খাতের ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনা, অতিরিক্ত ব্যয়ের ব্যাখ্যা এবং ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অন্যান্য অসামঞ্জস্যতা দূর করতে হবে। ১৪ জুন অনুষ্ঠিত হয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা এবং ১২ জুলাই জারি করা হয় ওই সভার কার্যবিবরণী। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (টিজিটিডিসিএল) পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক (চলতি দায়িত্ব) প্রকৌশলী রাজীব কুমার সাহার সঙ্গে।
শনিবার তিনি বলেন, এক্ষেত্রে বেশি দাম ধরা হয়নি। কেননা এর সঙ্গে শুধু মিটার নয়, আনুষঙ্গিক অন্যান্য ব্যয়ও যুক্ত আছে। ফলে দাম বেশি মনে হয়েছে। তবে বিষয়টির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত উপমহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী ড. প্রদীপ চন্দ্র মণ্ডলের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।
প্রদীপ চন্দ্র মণ্ডল বলেন, এটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। কেননা আমরা শুধু মিটারের দাম ধরিনি। এটা হচ্ছে ইপিসি কস্ট। অর্থাৎ এর সঙ্গে কনস্ট্রাকশন ও ইনস্টলেশনসহ অন্যান্য খরচও যুক্ত আছে। শুধু মিটার ক্রয়ে ব্যয় হবে ১৭ হাজার ৫০০ টাকা।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, পরিকল্পনা কমিশনের সুপারিশ পেলে সে অনুযায়ী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডিপিপি সংশোধন করা হবে।
সূত্র জানায়, ‘গ্যাস সেক্টর ইফিসিয়েন্সি ইমপ্রুভমেন্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট মিটিগেশন’ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ১ হাজার ২০৯ কোটি, বিশ্ববাংকের ঋণ থেকে ২ হাজার ৭১৯ কোটি ১৪ লাখ এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থার তহবিল থেকে ২২ কোটি ৯ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। প্রক্রিয়াকরণ শেষে অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে ২০২৮ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন করবে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (টিজিটিডিসিএল)।
পিইসি সভার কার্যবিবরণী পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রায় দ্বিগুণ দামে ১১ লাখ প্রি-পেইড গ্যাস মিটার কেনার প্রস্তাব করা হয়। এতে অতিরিক্ত ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হবে।
এখানে প্রতিটি প্রি-পেইড মিটার কিনতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৯ হাজার ৬০০ টাকা। কিন্তু একই ধরনে অন্য একটি প্রকল্পে প্রতিটি মিটার কিনতে ব্যয় হয়েছিল ১৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি মিটারে অতিরিক্ত ব্যয় ধরা হয়েছে ১১ হাজার ৮০০ টাকা। এ ছাড়া একই ধরনের সমাপ্ত একটি প্রকল্পে প্রতিটি প্রি-পেইড মিটারের দাম ধরা হয়েছে ১২ হাজার ৯০০ টাকা।
পরিকল্পনা কমিশন থেকে বলা হয়েছে, এত বেশি দাম ধরার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে যৌক্তিক পর্যায়ে দাম ধরে ডিপিপি সংশোধন করতে হবে। সেই সঙ্গে মিটারের এরকম দামের তারতম্য কমাতে দ্রুততম সময়ে একটি স্ট্যান্ডার্ড সিস্টেম ডিজাইন এবং রেট শিডিউল তৈরির জন্য সুপারিশ দেওয়া হয়েছে।
আরও জানা যায়, প্রকল্প প্রস্তাবে ১৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ২ লাখ ২২ হাজারটি রেগুলেটর কেনার প্রস্তাব করা হয়। এ বিষয়ে পিইসি সভায় প্রশ্ন তোলা হয়। এ সময় তিতাসের পক্ষে জানানো হয়, প্রতিটি রেগুলেটর ৯ হাজার টাকা ব্যয়ে আমদানি করা হবে।
অপরদিকে চলমান প্রকল্পে এগুলো স্থানীয়ভাবে কেনা হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে নতুন প্রকল্পে রেগুলেটর আমদানি না করে দেশের বাজার থেকে সংগ্রহের সুপারিশ করা হয়েছে। ফলে এ খাতে ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে ধরতে বলা হয়। প্রকল্পে প্রস্তাবিত লিগ্যাল এক্সপেনসেস শীর্ষক অঙ্গটির প্রয়োজনীয়তা না থাকায় এটি বাদ দিতে বলা হয়েছে।
সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় মিটারের দাম হিসাবে প্রতি মাসে গ্রাহকের কাছ থেকে ২০০ টাকা করে ১০ বছরে কেটে নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু বর্তমানে প্রতি মাসে গ্রাহকের কাছ থেকে মিটার চার্জ হিসাবে ১০০ টাকা কাটা হচ্ছে। এই দ্বিগুণ চার্জের বিষয়টি যৌক্তিক পর্যায়ে কমাতে বলা হয়েছে।
পাশাপাশি প্রস্তাবিত প্রকল্পে একটি জিপ, চারটি ডাবল কেবিন পিকআপ এবং ২৫টি মোটরসাইকেল কেনার কথা বলা হয়। পিইসি সভায় বর্তমান অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা বিবেচনায় স্বল্পমেয়াদে ৩টি গাড়ি ভাড়া নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। সূত্র আরও জানায়, প্রকল্প প্রস্তাবে বিদেশ ভ্রমণ খাতে ৩ কোটি ১৭ লাখ ১৪ হাজার টাকা ধরা হয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত বিভাজন সুনির্দিষ্টভাবে চাওয়া হয়েছে।
এছাড়া প্রকল্পের পরামর্শকের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে কতজন কত মাস কাজ করবে সেটি কমিয়ে ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে কমাতে বলা হয়েছে।
প্রকল্পটি ঢাকা জেলার উত্তর সিটি করপোরেশন, সাভার ও ধামরাই উপজেলায় বাস্তবায়ন করা হবে। এছাড়া প্রকল্পভুক্ত অন্য এলাকাগুলো হলো-গাজীপুর সিটি করপোরেশন, সদর, কালিয়াকৈর, শ্রীপুর ও কালীগঞ্জেও বাস্তবায়ন করা হবে। আরও আছে টাঙ্গাইল সদর, ঘাটাইল, কালিহাতী, মির্জাপুর ও গোপালপুর, মানিকগঞ্জ সদর, সাটুরিয়া ও শিবালয়, ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন, সদর, মুক্তাগাছা, ভালুকা ও গফরগাঁও এবং জামালপুর সদর ও সরিষাবাড়ী, নেত্রকোনা সদর এবং শেরপুর সদর।