International

রাশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চলের দক্ষিণাংশে অবস্থিত  বিশ্বের সবচেয়ে বড়, পুরোনো ও গভীর হ্রদ

শীতকালে জমে যাওয়া বৈকাল হ্রদের নিচে মিথেন গ্যাসের বুদবুদ

রাশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চলের দক্ষিণাংশে অবস্থিত পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন এবং গভীরতম স্বাদু পানির হ্রদ বৈকাল। রুশরা একে ওরেজো বেয়কাল বা বৈকাল নামে ডেকে থাকে। তিইউরিস্ক ভাষার আঞ্চলিক শব্দ ‘বাই-কুল’ থেকে এই হ্রদের নামকরণ হয়েছে। বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় সম্পদশালী হ্রদ। এই হ্রদকে অনেকে সাইবেরিয়ার মুক্তা নামেও ডেকে থাকেন। বৈকাল হ্রদের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে রয়েছে ইরকুটস্ক, পূর্ব অংশে রয়েছে উলান-উদে আর উত্তর প্রান্তে রয়েছে সেভেরোবাইকালস্ক। এ শহরগুলো পর্যটন স্পট। ইরকুটস্ক থেকে ওলখোন গিয়ে বৈকাল হ্রদের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। মস্কোর ভনুকোভো এবং ডোমোদেডোভো বিমানবন্দর ইরকুটস্কের ফ্লাইট ছেড়ে যায়। ইরকুটস্ক থেকে খুজির ও লিস্টভায়ঙ্কা যাওয়া যায় স্পিডবোটে করে। যারা বৈকাল হ্রদের তীরে পর্যটকের ভিড় এড়িয়ে এর আদিম সৌন্দর্য দেখতে ইচ্ছুক তাদের গ্রীষ্মের শুরুতে (১৫ মে থেকে ১০ জুন পর্যন্ত) পৌঁছানো ভালো। এই সময়ে বৈকাল সবেমাত্র নিজেকে বরফ থেকে মুক্ত করতে শুরু করে।

বৈকাল হ্রদ আর স্বচ্ছ টলমলে পানির শৈল্পিক দৃশ্য যেন সমার্থক শব্দ। এই হ্রদের পানি পৃথিবীর অন্যতম বিশুদ্ধ এবং স্বচ্ছ পানি। গ্রীষ্মকালে সাইবেরিয়ান পর্বতের বরফ সম্পূর্ণ গলে হ্রদের বুক কানায় কানায় ভরে ফেলে। তখন এর স্বচ্ছ বুক ভেদ করে ৩৯ মিটার গভীর পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়। এই স্বচ্ছতার পেছনে কলকাঠি নাড়ছে বিশুদ্ধ বরফ গলা পানি, হ্রদের বুকে থাকা প্লাঙ্কটনের ময়লা আহার করা এবং খনিজ লবণের অনুপস্থিতির মতো বেশকিছু বিষয়। প্রায় ১ হাজার ৬২০ মিটার গভীর এই হ্রদের আয়তন ৩১ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার। আয়তনের দিক দিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম স্বাদু পানির হ্রদ হিসেবেও এর সুখ্যাতি রয়েছে।
হ্রদটি স্থানীয়দের কাছে অত্যন্ত পবিত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। অনেক অঞ্চলে এই হ্রদকে ঘিরে অলৌকিক গল্পকথাও প্রচলিত রয়েছে।

বিজ্ঞানীদের মতে, প্রায় ৭ কিলোমিটার ব্যাসের এই বলয়গুলো আসলে হ্রদের উষ্ণ জলের সঙ্গে পৃষ্ঠের বরফের সংস্পর্শে গঠিত হয়েছে।

বহুকাল ধরে ইউরোপের মানুষ সাগরসদৃশ এই হ্রদের খবর জানত না। রাশিয়া এই অঞ্চলে তাদের রাজ্য সম্প্রসারিত করলে সর্বপ্রথম কুরবাত ইভনিভ নামক এক রুশ অনুসন্ধানী গবেষক ১৬৪৩ খ্রিষ্টাব্দে এই এলাকায় পৌঁছেন। বৈকালের বুকে ছোট ছোট ২৭টি দ্বীপের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব দ্বীপের বেশির ভাগই মানুষের জন্য একদম বাসযোগ্য নয়। তবে কিছু কিছু দ্বীপে মানুষের বসতি চোখে পড়ার মতো। এদের সবচেয়ে বড় দ্বীপ উলখন লম্বায় ৭২ কিলোমিটার। সেখানকার জনসংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। বৈকাল হ্রদের বিশাল অঞ্চলজুড়ে পানির জোগান দিয়ে আসছে প্রায় ৩৩০টির মতো নদী। এদের মধ্যে সেলেঙ্গা নদী এর সবচেয়ে বড় উৎস হিসেবে চিহ্নিত। হ্রদের অর্ধেকের বেশি পানি আসে এই নদী থেকে। শীতকালে হ্রদের পৃষ্ঠ পুরোটা বরফে আচ্ছাদিত হয়ে যায়। তবে মে-জুন মাসের দিকে বরফ গলে দেখা দেয় স্বচ্ছ পানির স্তর। তখন জলপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা হয় ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বৈকাল হ্রদের বুকে তখন মাঝারি আকারের ঢেউ ওঠে। হ্রদের ঢেউয়ের সর্বোচ্চ উচ্চতা মাপা হয়েছে প্রায় ৪.৬ মিটার।

বৈকাল হ্রদ জীববৈচিত্র্যের আধার। প্রায় ১ হাজার ৮০০ প্রজাতির মতো পশুপাখি এই হ্রদ অঞ্চলকে প্রাণের কোলাহলে মুখরিত করে রেখেছে। হ্রদের কাছাকাছি অঞ্চলে পাওয়া যায় শত শত প্রজাতির গাছগাছালি। এখানে প্রাপ্ত জীবদের অধিকাংশই আঞ্চলিক (এন্ডেমিক)। পৃথিবীর অন্য কোথাও এদের দেখা পাওয়া যায় না। বৈকালের জলে প্রায় ৫০ প্রজাতির মাছের নিবাস। বৈকাল হ্রদের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রাণী নেরপা। স্বাদু পানির প্রায় ১ লাখ সিল মাছের বসবাস এখানে। বিবর্তনবিজ্ঞানীদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় প্রাণী এরা। ঠিক কখন এরা সাগর থেকে স্বাদু পানিতে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে, তা উদঘাটন করতে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন গবেষকরা। শীতকালে হ্রদের পানি বরফ হয়ে পুরো আস্তরণ তৈরি হয়, তখন তার ওপর দিয়ে দিব্যি হেঁটে যাওয়া যায়।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button