ব্যাংকে আছে ২ লাখ প্রকল্প ১৮ কোটির
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলকে বলা হয় চায়ের রাজধানী। আধুনিক যুগেও এ অঞ্চলের চা-শ্রমিকরা পার করছেন মানবেতর জীবন। এ কারণে শ্রীমঙ্গলের ১৮টি চা বাগানের তিন হাজার শ্রমিককে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বাস্থ্যগত পরিবর্তন ঘটাতে চায় সমাজসেবা অধিদপ্তর। ‘চা সম্প্রদায়ের জন্য সচেতনতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে সরকারের এ সংস্থা। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল অ্যাডভান্সমেন্টের মাধ্যমে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু এ সংস্থাটি প্রকল্পের ২০ শতাংশ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও তাদের ব্যাংক হিসাবে মাত্র ১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা আছে বলে জানিয়েছে সমাজসেবা অধিদপ্তর। তবে চা-শ্রমিক নেতারা বলছেন, চা-শ্রমিকদের এসব অনুদান দেওয়ার চেয়ে জরুরি তাদের মজুরি বাড়ানো এবং ভূমি সমস্যার সমাধান করা। মজুরির বিষয়টি আড়াল করার জন্যই এসব অনুদানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তারা।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রস্তাবিত এ প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। চলতি বছরের জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত তিন বছরে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। মোট প্রাক্কলিত ব্যয়ের ৮০ শতাংশ সরকারের, বাকি ২০ শতাংশ বেসরকারি সংস্থাটির।
বেসরকারি সংস্থাকে প্রকল্পটি দেওয়ার যুক্তি হিসেবে অধিদপ্তর বলছে, প্রকল্পটি ‘বেসরকারি প্রচেষ্টায় আর্থসামাজিক খাতে গৃহীত প্রকল্পের সীমিত আকারে সরকারি সাহায্য প্রদান’-সংক্রান্ত সংশোধীত নীতিমালার আলোকে বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রকল্প প্রস্তাবের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ প্রকল্পের জন্য বেসরকারি সংস্থাটি ২০ শতাংশ অর্থায়ন করবে। সে হিসেবে তাদের ৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকা অর্থায়ন করার কথা। কিন্তু প্রকল্প প্রস্তাবে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মাত্র ১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের অন্য সম্পদ থেকে বাকি অর্থের ব্যবস্থা করা হবে।
জানতে চাইলে ইসা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক প্রভা রানী বাড়াইক বলেন, ব্যাংক অ্যাকাউন্টে যে অর্থ আছে, তা যথেষ্ট নয়। তবে আমাদের আরও সম্পদ আছে, আরও কর্মসূচি আছে। বিশেষ করে চা বাগান ও বিভিন্ন কর্মসূচি থেকে বাকি অর্থের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
প্রকল্প প্রস্তাবনার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রকল্পের ৭৬ শতাংশই ব্যয় হবে ৩ হাজার ১০ জন চা-শ্রমিককে অনুদানের মাধ্যমে। এ শ্রমিকদের ১৪ কোটি ২৪ লাখ টাকা অনুদান দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ ৪৭ হাজার ৩০৮ টাকা। তাছাড়া প্রকল্পের অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ৩০ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। কিন্তু কতজন মানুষকে এর মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করা হবে তার উল্লেখ করা হয়নি।
প্রকল্পের আরেকটি ব্যয়ে দেখা যায়, ৩ হাজার ৩০০ জনের সেমিনার ও কনফারেন্সের আয়োজন করা হবে। এতে ব্যয় হবে ৭০ লাখ ১২ হাজার টাকা।
প্রকল্প প্রস্তাবনার বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলতে চাইলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের কোনো কর্মকর্তা এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
প্রস্তাবনায় সমাজসেবা অধিদপ্তর বলছে, চা বাগানের শ্রমিকরা সুনির্দিষ্ট অরক্ষিত জনগোষ্ঠী যারা সম্মান ছাড়াই জীবনযাপন করছে। জাতীয় অর্থনীতিতেও তারা অবদান রাখছে। বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া, কর্মহীন অল্পশিক্ষিত অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি থাকলেও তাদের অনেকেই এর বাইরে। তাই শ্রীমঙ্গলের ১৮টি চা বাগানের ৩ হাজার ১০ জন শ্রমিককে এ অনুদান দেওয়া হবে।
চা-শ্রমিকদের ১০ দফা আন্দোলনের সমন্বয় এসএম শুভ বলেন, ‘অনুদান দেওয়ার আগে মজুরি বাড়ানোর দাবি বাস্তবায়ন বেশি জরুরি। এ ছাড়া ভূমি সমস্যার কারণে সন্তানরা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। আসলে মজুরি বাড়ানোর প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাওয়ার জন্যই মূলত সরকার এ ধরনের প্রকল্প হাতে নিয়েছে।’
চা-শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা আবদুল্লাহ আল কাফি রতন জানান, দেশে এখন ১ লাখ ২৫ হাজার চা-শ্রমিক রয়েছেন। চা-জনগোষ্ঠী রয়েছে সাত লাখ। গত বছর তাদের যে মজুরি বৃদ্ধি করা হলো তাতে তাদের এরিয়ায় পাওয়ার কথা ৩১ হাজার টাকা করে, কিন্তু তারা পাচ্ছে ১১ হাজার টাকা। এর বিরুদ্ধে শ্রমিকদের তীব্র ক্ষোভও রয়েছে। প্রতি দুই বছর পরপর মজুরি বাড়ানোর কথা থাকলেও এখনো দেওয়া হচ্ছে ২০২১ সালের মজুরি।
স্ট্যাটিস্টিক্যাল হ্যান্ডবুক অন বাংলাদেশ টি ইন্ডাস্ট্রি বুক-২০১৯-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট চা বাগানের সংখ্যা ১৬৬টি। স্থায়ী চা-শ্রমিকের সংখ্যা ১ লাখ ২৫ হাজার ৭৪৭ জন। অস্থায়ী চা-শ্রমিকের সংখ্যা ৩৬ হাজার ৪৩৭ ও চা-জনগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা ৪ লাখ ৭২ হাজার ১২৫ জন। তবে অস্থায়ী ও বেকার চা-শ্রমিকের সংখ্যা স্থায়ী শ্রমিকের দ্বিগুণ হবে।
বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে চা-জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে সাত লাখ।
১৬৬টি বাগানের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, হবিগঞ্জের বাবান চা বাগান, পঞ্চগড়ের সাইলিলান, ডাহুক, করতোয়া ও এমএম চা বাগান, ঠাকুরগাঁওয়ের গ্রিনফিল্ড চা বাগান ও মৌলভীবাজারের হামিদিয়া বাগানে কোনো স্থায়ী চা-শ্রমিক নেই। ফলে এসব চা বাগানের শ্রমিকরা সরকারের এ তালিকা থেকে বাদ পড়বেন।
গত বছর মজুরি বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলনে নামেন চা-শ্রমিকরা। তাদের ২০ মাসের বর্ধিত বকেয়া মজুরির দাবি ছিল ৩০ হাজার টাকা। কিন্তু পরে শ্রম অধিদপ্তরের পরিপত্রে বলা হয়েছে, চা-শ্রমিকরা বকেয়া মজুরি হিসেবে জনপ্রতি ১১ হাজার টাকা করে পাবেন।
পরিপত্রে বলা হয়েছে, চা-শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধসংক্রান্ত বিষয়ে মালিক ও শ্রমিকপক্ষের সঙ্গে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান মতবিনিময় করেছেন। প্রতিমন্ত্রী তাদের বকেয়া মজুরি থেকে জনপ্রতি ১১ হাজার টাকা পরিশোধ করতে বলেন। এ অর্থ তিন কিস্তিতে পরিশোধ করা হবে বলে জানানো হয়। যার মধ্যে প্রথম কিস্তি আগামী ৭ মার্চের আগেই পরিশোধ করতে হবে। বাকি দুই কিস্তি পরিশোধের সময় চা-শ্রমিক এবং মালিকপক্ষ আলোচনা করে নির্ধারণ করবে। গত বছর ২৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ থেকে ৫০ টাকা বৃদ্ধি করে ১৭০ টাকা নির্ধারণ করে দেন।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর থেকে শ্রমিকরা বর্ধিত মজুরিসহ অন্যান্য সুবিধা পেলেও ২০২১-এর জানুয়ারি থেকে আগস্ট ২০২২ পর্যন্ত সময়ের জন্য বর্ধিত মজুরির বকেয়ার দাবি জানিয়ে আসছিলেন।