ব্যাপকভাবে বর্জন করা নির্বাচন বাংলাদেশের ভবিষ্যত সম্পর্কে কী বলে
মূলত প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ৭ই জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় ফিরেছেন। নির্বাচনের ফল বিস্ময়কর ছিল না। কিন্তু নির্বাচনকে ঘিরে যেসব ঘটনা ঘটেছে এবং যে ফাটলগুলো দেখা দিয়েছে তা বলে দিবে সামনের সপ্তাহ ও মাসগুলোতে বাংলাদেশের ওপর কী প্রভাব ফেলবে। বিভিন্ন কারণে এই নির্বাচন আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এর মধ্যে আছে ভূরাজনৈতিক লড়াই। এর একদিকে আছে পশ্চিমা দেশগুলো (বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র) এবং অন্যদিকে আছে ভারত, চীন, রাশিয়া। প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি সহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন বর্জন করেছে। অন্যদিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা। শেখ হাসিনাকে ‘এশিয়ার আয়রন লেডি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ চাইতে বাধ্য হয়েছে বাংলাদেশ। এমন অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে গণতন্ত্র থেকে পিছিয়ে পড়ার রেকর্ডই নির্বাচনকে ঘিরে এবং নির্বাচনের অব্যবহিত পরে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কেন্দ্রীয় আলোচনার বিষয় হয়েছে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার বিজয়ও একই রকম একপক্ষীয় ছিল। কারণ, তাকে এবং তার দলকে জয় এনে দিতে ক্ষমতাসীন দল, বেসামরিক প্রশাসন এবং আইন প্রয়োগকারী এজেন্সিগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করেছে। এ বছর নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দল শেখ হাসিনার পদত্যাগ, নির্বাচন তদারকির জন্য একটি নিরপেক্ষ প্রশাসন প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছে। এমন তদারকি সরকারের অধীনে ১৯৯১ এবং ২০০৮ সালে নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু বিরোধীদের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে ক্ষমতাসীনরা। উল্টো তারা নির্বাচনকে সামনে ঠেলে দিয়েছে।
২০২২ সালের গ্রীষ্মে বিরোধীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু হয়। তারপর ২০২৩ সালের ২৮শে অক্টোবর তাদের ওপর ভয়াবহ দমনপীড়ন চালানো হয়। তখন থেকে বিরোধী দলের কয়েক হাজার নেতা ও কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শাস্তি দেয়া হয়েছে কমপক্ষে ১৫০০ জনকে। বিএনপির দলীয় কার্যালয় সারাদেশে তালাবদ্ধ করে রাখে আইন প্রয়োগকারী এজেন্সিগুলো। নির্বাচনকে প্রতিযোগিতামূলক দেখাতে ক্ষমতাসীন দল বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। তারা বিএনপিকে ভাঙ্গার চেষ্টা করে। প্রতিষ্ঠা করা হয় নতুন রাজনৈতিক দল, যাতে বিএনপির নেতাদের ভাগিয়ে নেয়া যায়। তাদেরকে প্রলুব্ধ করা হয় নির্বাচনে অংশ নিতে এবং ওইসব দলে যোগ দিতে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখাতে নিজেদের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর সমর্থক এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে কমপক্ষে এক ডজন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে গণপরিবহনে, যদিও নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর ছিল।
নির্বাচনের পাঁচটি শিক্ষণীয় বিষয় নিচে দেয়া হলো-
১. নির্বাচন বাংলাদেশকে একটি একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করেছে
কোনো বিরোধী দল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকায় ফলাফল কি হবে নির্বাচনে তা আগেই পূর্বনির্ধারিত ছিল। কিন্তু এই ফলাফল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আরো ভিতরের খবর প্রকাশ করেছে। জাতীয় সংসদের সরাসরি নির্বাচনের ৩০০ আসনের মধ্যে শুধু আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছে ২২৩ আসনে। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন ৬২ আসনে। এরা সবাই আওয়ামী লীগের নেতা। এর ফলে জাতীয় সংসদে সরাসরি নির্বাচিত সদস্যরা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতি ২৮৫-৯৫ ব্যবধানে আনুগত্য প্রদর্শন করেছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগপন্থি জাতীয় পার্টি জিতেছে সাতটি আসনে। একটি করে আসনে জিতেছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল এবং বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি। নির্বাচনের অব্যবহিত আগে বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন ছেড়ে আসে কল্যাণ পার্টি। তাদেরকে সমর্থন দেয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং রাষ্ট্রযন্ত্র। এতে তারা একটি আসন পেয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোনো রকম সম্পর্ক নেই এমন স্বতন্ত্র চারজন প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় সংসদে বিদ্যমান কোনো বিরোধী পক্ষ আছে, এটা বলার মতো কিছু নয়।
এসব ফ্যাক্টরই শুধু বলে দেয় একটি দল রাষ্ট্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। তবে এর সংজ্ঞায়িত চরিত্র হলো, এর ফলে সর্বময় ক্ষমতা দেয়া হয়েছে শেখ হাসিনাকে। এমনকি দলটির সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, কে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে তার সিদ্ধান্ত দেবেন শেখ হাসিনা। বিগত দুটি জাতীয় সংসদে সরকারিভাবে বিরোধী দল ঘোষণা দেয়া হয় জাতীয় পার্টিকে। প্রধানমন্ত্রীর করুণা থেকে ঝরে পড়েছে জাতীয় পার্টি। এতে জল্পনা চলছে শেখ হাসিনা কাকে বেছে নেবেন। এটি হলো একটি ব্যক্তিকেন্দ্রীক স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা।
২. এমনকি ভোটের সংখ্যাকে আর বিশ্বাস করা যায় না
নির্বাচনকে সামনে নিয়ে ভোটার উপস্থিতির বিষয়টি ছিল অনিশ্চিত। বড় কোনো বিরোধী দল নির্বাচনে না থাকায় এবং বিরোধী দল নির্বাচন বর্জনের আহ্বান থাকায় ক্ষমতাসীন দলের প্রতি এটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটাদের আকৃষ্ট করা। ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার পর পরিস্থিতি দেখে মনে হয়, ভোট পড়বে খুবই কম। দিনের শেষের দিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল দাবি করেন, শতকরা ৪০ ভাগ ভোটার ভোট দিয়েছেন। এই ঘোষণা দেয়া হয়েছে উদ্ভটভাবে। ভোট গ্রহণ শেষে নির্বাচন কমিশনার আউয়াল প্রথমে বলেন, ভোট দিয়েছেন শতকরা ২৮ ভাগ ভোটার। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে তার এক সহকর্মীর প্ররোচণায় তিনি এই সংখ্যাকে অনেকটা বাড়িয়ে দেন।
শতকরা ৪০ ভাগকে বিশেষজ্ঞরা উদ্ভট বলছেন। সারাদিন মিডিয়াগুলো যেসব রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে তারা এই তথ্য বিশ্বাস করতে পারছেন না। কারণ, নির্বাচন কমিশনের আগের হিসাব নিকাশের সঙ্গে এই চিত্র সাংঘর্ষিক। ভোট গ্রহণ শুরুর চার ঘন্টা পরে নির্বাচন কমিশন তার রিপোর্টে বলে যে, শতকরা ১৮.৫০ ভাগ ভোট পড়েছে। কিন্তু ভোটকেন্দ্র বন্ধ হওয়ার এক ঘন্টা আগে তা রিপোর্ট করা হয় ২৬.৩৭ ভাগ। ফলে বিবৃতি অনুযায়ী শেষ এক ঘন্টায় ভোট পড়েছে শতকরা ১৪ ভাগ। মজার বিষয় হলো, তখনও নির্বাচন কমিশনের ড্যাশবোর্ডে ভোটের শতকরা হার ২৮ ভাগ দেখানো হচ্ছিল। প্রথম দিকে কমিশন শতকরা যে ২৮ ভাগ দোখিয়েছে তাও বাড়িয়ে বলা হয়েছে বলে দেখা যায়।
৩. জনগণ এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে নীরবে
ভোটাররা তাদের পা অচল রাখার মধ্য দিয়ে ভোট দিয়েছেন। ভবিষ্যতে জল্পনা হবে এই ঝুঁকিকে মাথায় রেখে তারা কেউ ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এমনকি সরকারি হিসাবে যে ভোট দেখানো হয়েছে তাতে শতকরা ৭২ ভাগ ভোটার বাসায় থাকাকে বেছে নিয়েছেন। তিনটি কারণে এই মঞ্চায়িত শো থেকে দূরে থেকেছেন বাংলাদেশিরা। প্রথমত, সরকার ডামি প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখাতে চেয়েছেন বলে মনে হয়েছে। দ্বিতীয়ত, চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কট ভোটারদেরকে ভোটদানে কম আগ্রহী করেছে। তারা মনে করেন, ক্ষমতাসীন দলের অর্থনৈতিক নীতি ভবিষ্যতে গতি আনবে না। ১৯৯১ এবং ২০০৮ সালের মধ্যে যখন বাংলাদেশে অবাধ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তখন ক্ষমতাসীনদের উৎখাতে উদগ্রীব ছিল জনগণ এবং বিরোধীদের ক্ষমতায় বসিয়েছে। তৃতীয়ত, ভোটাররা দৃশ্যত বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জনের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে। একে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে তাদের উচ্চ মাত্রায় বিরোধী মনোভাব এবং বিরোধী দলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিও ইঙ্গিত দেয়।
৪. যুক্তরাষ্ট্রের ‘হাফ-হার্টেড’ উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে
২০২২ সালের শুরু থেকে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে আসছে। বার বার তারা সতর্কতা দিয়েছে যে, এসব বিষয় যে নির্বাচনে মানা হবে না, তা গ্রহণযোগ্য হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা কয়েকবার ঢাকা সফর করেছেন। ওয়াশিংটনে এবং নিউ ইয়র্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহ বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের সঙ্গে তারা সাক্ষাৎ করেছেন। এতে শেখ হাসিনাকে রাজি করানোর চেষ্টা হয়েছে। এ চাপকে শেখ হাসিনা বর্ণনা করেছেন তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের চেষ্টা হিসেবে।
উপরন্তু, গণতন্ত্রে বাধা সৃষ্টিকারী বাংলাদেশি যেকোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়ার নীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। তারা বড় দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমস্যা সমাধানের জন্য সংলাপ আহ্বান করে। বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার এই উৎসাহকে দেখা হয প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে। এর মূলে আছে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার। ব্যাপক জল্পনা আছে যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারকে সমঝোতায় আসার জন্য টার্গেটেড নিষেধাজ্ঞা সহ শাস্তিমূলত পদক্ষেপ নিতে পারে। কিন্তু এসব কথা ও অঙ্গভঙ্গি সুনির্দিষ্ট কোনো র্কমকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নেয়া হয়নি। ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে ওয়াশিংটন সীমিত পদক্ষেপ নিয়েছে বলে মনে করা হয়। শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি ভারতের নিঃশর্ত সমর্থন প্রকাশ পেয়েছে। নির্বাচনের পরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বৃটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলে বর্ণনা করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আগে যে পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল, এই প্রতিক্রিয়া তার চেয়ে কম কিছুর ইঙ্গিত দেয়।
৫. বিরোধীদের কথা প্রমাণিত হয়েছে, কিন্তু সামনে কঠিন পথ
আরও একবার প্রমাণিত হয়েছে যে, ক্ষমতাসীনদের অধীনে একটি নির্বাচন অবাধ হওয়া সম্ভব নয়। তাই তাদের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল। নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি এটাই ইঙ্গিত দেয় যে, বিরোধীদের নির্বাচন বর্জনের ডাকে জনগণের সেন্টিমেন্টের প্রতিফলন ঘটেছে। বিরোধীরা, বিশেষ করে বিএনপি দেখিয়েছে যে, নিষ্পেষণ এবং হুমকি সত্ত্বেও তারা ঐক্যবদ্ধ আছে। নির্বাচনে তাদের অনুপস্থিতি সরকারের কূটকৌশলকে উন্মোচিত করেছে। বিএনপি এটাও দেখিয়ে দিয়েছে যে, উস্কানি সত্ত্বেও তারা অহিংস থাকতে পারে। একই সঙ্গে তাদের দাবি আদায় এবং জনগণকে রাজপথে নামাতে এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণার সময় বিএনপিকে শেখ হাসিনা যেভাবে একটি ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ বলে বর্ণনা করেছেন তা দেশের ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক নয়। এটা শুধু বিএনপির জন্যই একটি বার্তা এমন নয়, একই সঙ্গে বিরোধী দল এবং ক্ষমতাসীন দলের সমালোচকদের জন্যও একটি বার্তা।