International

মধ্যপ্রাচ্যে কূটনীতির নতুন ভরকেন্দ্র কাতার

পারস্য উপসাগরের বুকে অবস্থিত ক্ষুদ্র দেশ কাতার। দেশটি কূটনীতির অঙ্গনে নিজস্ব অবস্থান তৈরি করছে। ফিলিস্তিনি গ্রুপ হামাস ৭ অক্টোবর ইসরাইলে সহসা হামলা চালিয়ে সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করে ও শতাধিক ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে যায়। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে ইসরাইলি ছাড়াও অন্যান্য দেশের নাগরিক ছিল। এদের মধ্যে দুই মার্কিন নাগরিককে হামাস শুক্রবার ছেড়ে দিয়েছে বলে আলজাজিরা জানিয়েছে। এ নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে আলোচনায় মধ্যস্থতা করেছে কাতার

হামাসের হামলার পর গাজায় ইসরাইল পুরো সামরিক শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর বিভিন্ন আরব দেশের মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। আরব আমিরাত ঘটনার জন্য সরাসরি হামাসকে দায়ী করেছে। দুই বছর আগে আমিরাত ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল, ভারত ও আরব আমিরাত এই চারটি দেশের মধ্যে একটি বিশেষ মৈত্রী রয়েছে। সৌদি আরব ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কাজটি করে আসছিল বছর খানেক ধরে। যুদ্ধ শুরুর পর এই চেষ্টা পরিত্যক্ত না হলেও দীর্ঘ সময়ের জন্য পিছিয়ে গেল বলে মনে হয়। সৌদি আরব সংঘাতের জন্য সরাসরি কোনো পক্ষকে দায়ী করেনি। অনেক পর্যবেক্ষকের মতে এটাই মূলত হামাসকে ইসরাইলে হামলা চালাতে উদ্বুদ্ধ করেছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও সরকারিভাবে এমন মত দিয়েছে। কিন্তু কাতার ঘটনার জন্য ইসরাইলকে দায়ী করেছে। হামাসের হাতে বন্দি ইসরাইলিদের উদ্ধারের জন্য দোহা একদম প্রাথমিকভাবে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু করে। হামাস অধিকাংশ পশ্চিমা দেশে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত। বেশির ভাগ আরব দেশেই তারা কালো তালিকাভুক্ত। কিন্তু হামাসের সঙ্গে কাতারের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। যে কারণে কাতার ঐ মধ্যস্থতার উদ্যোগটি নিয়েছিল। ইসলামপন্থি গ্রুপ হামাস ইসরাইলকে যে কেবল স্বীকৃতি দিতে নারাজ তাই নয়, তারা বরং ইসরাইলকে বিশ্ব মানচিত্র থেকে মুছে ফেলতে চায়। হামাস ২০০৭ সালের ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জিতেই গাজার দায়িত্ব নেয়। সেই থেকে ১৬ বছর যাবত্ ইসরাইল উপত্যকাটিকে বহিঃবিশ্ব থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। কেবল মিশরের রাফা সীমান্ত দিয়ে মিশরের মাধ্যমে তাদের সামান্য কিছু লেনদেন হয়। গাজায় কাতারের একটি কনস্যুলেট অফিস রয়েছে। ইসমাইল হানিয়াসহ অনেক নির্বাসিত হামাস নেতাকে কাতার আশ্রয় দিয়েছে।

হামাসের সঙ্গে সম্পর্ক কাতার যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র। ন্যাটোর বাইরে যাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ অংশীদারি সম্পর্ক রয়েছে তাদের অন্যতম কাতার। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহত্ সামরিক ঘাঁটি রয়েছে দেশটিতে। ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক জোটের যুদ্ধের সময়ে ঐ ঘাঁটি ব্যবহূত হয়। ১৯৯১ সালে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ঘাঁটি ছিল সৌদিতে। ৯০-এর দশকের আরো পরের দিকে ওয়াশিংটন ও  রিয়াদের মধ্যে এ নিয়ে সম্পর্কে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হলে বিকল্প স্থান হিসেবে কাতার বেছে নেয়। ঘাঁটিতে এক সময়ে ১০ হাজারের ওপর সৈন্য ছিল। কাতারের আমির তামিম বিন হামাদ আল সানি ১০ বছর ধরে ক্ষমতায়। ২০১৩ সালে তার পিতা হামাদ বিন খলিফা আল সানি আমিরের পদ ছেড়ে দেন। পিতামাতার চতুর্থ সন্তান ৪৩ বছর বয়সি তামিম এক রকম অভ্যুত্থান করেই ক্ষমতায় আসীন হন, অনেকে মনে করে। পরিবারের অন্য সদস্যরা যেন তাকে হটাতে না পারে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি এক্ষেত্রে তার জন্য রক্ষাকবচের ভূমিকা পালন করছে।

কাতার ইতিপূর্বেও তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শান্তি আলোচনায় মধ্যস্থতা করেছে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারে দোহার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণের পর অন্যসব মার্কিন মিত্রদের মতো কাতারও ক্রেমলিনের সমালোচনা করে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তুরস্কের মধ্যস্থতায় ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্যবাহী জাহাজের কৃষ্ণসাগর অতিক্রমণ নিয়ে সমঝোতা ভেঙে গেলে দোহা সেই আলোচনায় মধ্যস্থতা করে। মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়ে কাতারের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি চর্চায় ওয়াশিংটন এখনো পর্যন্ত বড় কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। হামাস ছাড়াও মিশরের ইসলামপন্থি দল মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গেও সম্পর্ক রয়েছে দোহার। ব্রাদারহুডের সাথে ৯০-এর দশক পর্যন্ত সৌদি আরবেরও সুসম্পর্ক ছিল। এই সম্পর্ক প্রথম হোঁচট খায় ১৯৯০ সালে কুয়েত সংকট কেন্দ্র করে সৌদি আরবে মার্কিন সামরিক উপস্থিতির পর। দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০০১ সালের ৯/১১ হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু করলে দলটির সঙ্গে রিয়াদের সম্পর্ক একদম বিচ্ছিন্ন হয়। কিন্তু কাতারের সঙ্গে এই সম্পর্ক এখনো আছে এবং একে কেন্দ্র করে রিয়াদ দোহার কয়েক বছর সম্পর্ক ছিন্ন করে কাতারের বিরুদ্ধে এক রকম অবরোধ দিয়ে রেখেছিল। ফিলিস্তিনিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কাতার সবসময়ই সোচ্চার। কাতার এখনো আশা করছে, গাজা-ইসরাইল সংঘাত অবসানে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে পারবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button