মন্ত্রী-এমপি-নৌকার প্রার্থীদের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়
মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নৌকার প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নির্বাচন আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ বেশি পাওয়া যাচ্ছে বলে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্রে জানা গেছে। তাঁদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে একাধিকবার আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে।
তফসিল ঘোষণার পর বারবার নির্বাচন আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় কুমিল্লা-৬ আসনের নৌকার প্রার্থী আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার ও বরগুনা-১ আসনের নৌকার প্রার্থী ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে তলব করেছে ইসি।
গতকাল সোমবার আগারগাঁও নির্বাচন কমিশনের আইন শাখার উপসচিব আব্দুস সালাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে এই তথ্য জানা যায়।
নৌকার এই দুই প্রার্থীকে আগামী ২৭ ডিসেম্বর বিকেলে ইসিতে সশরীরে উপস্থিত হয়ে প্রার্থিতা কেন বাতিল হবে না, এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এমপি বাহাউদ্দিন বাহারের নির্বাচনী প্রচারের সময় দুজন সাংবাদিকের ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে তাঁর সমর্থকদের বিরুদ্ধে। গত ২০ ডিসেম্বর কুমিল্লা-৬ (সদর) আসনের নৌকার প্রার্থী আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের নির্দেশে তাঁর নেতাকর্মীরা দুই সাংবাদিকের ওপর হামলা চালান। বাহারের নির্বাচনী প্রচারকালে কুমিল্লা নগরীর শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামের ফটকে এই ঘটনা ঘটে।
পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে হামলার শিকার দুই সাংবাদিক হলেন একাত্তর টেলিভিশনের নিজস্ব প্রতিবেদক কাজী এনামুল হক ফারুক ও ক্যামেরাপারসন সাইদুর রহমান সোহাগ। হামলাকারীরা তাঁদের মোবাইল ফোনসেট ও লাইভ ডিভাইস ছিনিয়ে নেন। এ সময় বাহারের পিএস ক্যামেরাপারসন সোহাগকে এলোপাতাড়ি মারধর করেন। এতে প্রার্থী, তাঁর পিএস ও নেতাকর্মীরা রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা, ২০০৮-এর ১১ (ক) বিধির স্পষ্ট লঙ্ঘন করেছেন বলে অভিযোগ আনা হয়।
এই অভিযোগ তদন্তের উদ্যোগ নেয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
ইসি সূত্র জানায়, এমপি বাহাউদ্দিন বাহারের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক গঠিত তিন সদস্যের কমিটি গত রবিবার ইসিতে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে সাংবাদিকদের মারধরের ঘটনার সত্যতা পাওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে।
আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে এর আগেও শোকজ করা হয়েছে। ১৮ ডিসেম্বর বিএনপি-জামায়াতের কোনো কর্মীকে নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর পক্ষে পাওয়া গেলে তাঁদের হাত-ঠ্যাং (পা) ভেঙে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়ায় একবার এবং নগরীর ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কালিয়াজুরি পিটিআই স্কুল মাঠে উঠান বৈঠক করে আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় একই দিন দ্বিতীয়বার তাঁকে শোকজ করে নির্বাচন অনুসন্ধান কমিটি।
এ পর্যন্ত তাঁকে তিনবার শোকজ করা হয়েছে। ফলে নির্বাচনী আইন অনুযায়ী তাঁর প্রার্থিতা বাতিল হতে পারে।
ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর বিরুদ্ধে অভিযোগ, নির্বাচনী প্রচার শুরুর আগেই ৭ ডিসেম্বর সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত বরগুনা বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্স মিলনায়তনে রিটার্নিং অফিসারের অনুমতি ছাড়াই আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভায় তিনি নির্বাচনী প্রচারণামূলক বক্তব্য দেন। এর আগে তাঁর বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের আরো দুটি অভিযোগ করা হয়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের চলাচল ব্যাহত করা। অন্য অভিযোগ, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থকদের মারধর করা।
ইসির তথ্য মতে, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত ২২৮ জনকে শোকজ করা হয়েছে। অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় শতাধিক ঘটনায় জারিমানা করা হয়। এর মধ্যে নৌকার প্রার্থী ৯৭ জন। অন্যরা বেশির ভাগই স্বতন্ত্র হিসেবে অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগ নেতা। তাঁদের মধ্যে ৫৮ জন বর্তমান সংসদ সদস্য।
গত ১৮ ডিসেম্বর থেকে নির্বাচনী প্রচার শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ৪১টি স্থানে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনা ঘটেছে।
মাঠ পর্যায় থেকে আসা তথ্য মতে, আওয়ামী লীগ দলীয় দুই প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করতে নির্বাচন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছে ইসি। তাঁরা হলেন চট্টগ্রাম-১৬ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান ও ঝিনাইদহ-১ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল হাই।
এর আগে ঝালকাঠি-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আমির হোসেন আমুর নির্বাচনী কার্যক্রমে আচরণবিধি লঙ্ঘিত হয়েছে বলে মনে করে ওই আসনের নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি। ইসিতে উপস্থিত হয়ে প্রবীণ এই সংসদ সদস্যের দেওয়া জবাবে সন্তোষ প্রকাশ করে ইসি। এর পরও তাঁকে সতর্ক থাকতে বলা হয়।
নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির পাঠানো তথ্য মতে, আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় এগিয়ে রয়েছেন মন্ত্রী-এমপি ও নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা। তাঁদের বিরুদ্ধে নির্বাচনী সহিংসতা, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থককে হত্যা, ভোটারদের হুমকি, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারে বাধাদান, সাংবাদিকদের হেনস্তা, মোটর শোভাযাত্রা ও শোডাউন, মানুষের চলাচলে বিঘ্ন ঘটানো এবং নির্বাচনী প্রচারে সরকারি যানবাহন ব্যবহারসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। এসব কারণে অনেক প্রার্থীর বিরুদ্ধে দ্বিতীয়বার শোকজ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের প্রার্থী, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, ঢাকা-১৯ আসনের প্রার্থী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান, রাজশাহী-১ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী ওমর ফারুক চৌধুরী, চট্টগ্রাম-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক, চাঁদপুর-৩ আসনের প্রার্থী ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী, মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের মৃণাল কান্তি দাস, গাজীপুর-৫ আসনের মেহের আফরোজ চুমকি, ময়মনসিংহ-৩ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সোমনাথ সাহা এবং সিলেট-৩ আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী আতিকুর রহমান।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের আইন অনুবিভাগের যুগ্ম সচিব মো. মাহবুবার রহমান সরকার বলেন, ঝিনাইদহ-১ আসনের মো. আব্দুল হাই ও চট্টগ্রাম-১৬ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য সংশ্লিষ্ট সহকারী রিটার্নিং অফিসারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কুষ্টিয়া-৪ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকের গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় নৌকার এক কর্মীকে এক দিনের কারাদণ্ড দিয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এ ছাড়া আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগে প্রার্থী, সমর্থক ও বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে শোকজ নোটিশ পাঠানো ও জরিমানা করা হচ্ছে।
নির্বাচনী সহিংসতা ও আচরণবিধি লঙ্ঘনে প্রার্থিতা বাতিলের মতো কঠোর সিদ্ধান্তে যাওয়ার আভাস দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান। তিনি বলেন, ‘যাঁরা আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। কোনো না কোনো জায়গায়, কারো না কারো প্রার্থিতা বাতিল হবে, এটুকু আভাস দিচ্ছি। কয়েকটি জায়গায় আরো কিছু কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে। সেগুলো পেলে আমরা কিছু প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করব, সে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে আপনারা তা দেখতে পাবেন।’
আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে জেল-জরিমানার পাশাপাশি প্রার্থিতা বাতিল করার ক্ষমতা রাখে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রার্থী বা রাজনৈতিক দলকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে পারে। কমিশন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা দলকে ২০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি প্রার্থিতা বাতিল করতে পারে।
নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলা হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য এই মুহূর্তে নির্বাচনী মাঠে আছেন প্রায় ৮০০ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।