Bangladesh

মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা: পুলিশ, প্রশাসন ও বিচার বিভাগে প্রভাব

বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে নিষেধাজ্ঞার আওতায় বাহিনীর কোন সদস্যরা আছেন তা তাদের জানা নেই৷ এর তেমন কোনো প্রভাব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর পড়বে না বলে দাবি তাদের৷ 

বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যক্তির ওপর মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেশের জন্য লজ্জাজনক৷ কিন্তু নির্বাচন, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মাধ্যমে এই পরিস্থিতি তৈরির জন্য সরকার ও প্রশাসনেরও দায় আছে৷ মার্কিন ভিসা নীতির পরও যদি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা না হয় তাহলে যুক্তরাষ্ট্র আরও চাপ বাড়ানোর সুযোগ পাবে৷

সদস্যদের ওপর নিষেধাজ্ঞা: পুলিশ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়া

শুক্রবার বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যক্তির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর৷ নাম উল্লেখ না করলেও নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসা ব্যক্তিরা বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের সদস্য বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে৷ এর আগে ২০২১ সালে মানবাধিকারের লঙ্ঘনের অভিযোগে ব়্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-ব়্যাব এবং বাহিনীটির সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয়৷ অতিরিক্ত হিসেবে তৎকালীন পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদের ক্ষেত্রে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়৷

নতুন করে নিষেধাজ্ঞায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উপর কী প্রভাব পড়বে তা নিয়ে আলোচনা চলছে৷ এ বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে রোববার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘‘তাদের দেশে (যুক্তরাষ্ট্র) তারা কাকে যেতে দেবেন, আর কাকে দেবেন না, সেটা তাদের ব্যাপার৷ এ ব্যাপারে আমাদের কোনো মন্তব্য নেই, বলারও কিছু নেই৷”

কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু ব্যক্তির নাম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এখন পর্যন্ত কাকে নিষিদ্ধ করেছে, সেগুলো আমরা জানি না৷’

তবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (জনসংযোগ) মো. ফারুক হোসেন বলেন, ‘‘মার্কিন ভিসা নীতি পুলিশের কাজের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না৷ পুলিশ মানবাধিকার রক্ষা করেই তাদের দায়িত্ব পালন করে৷ আইনের মধ্যে থেকেই পুলিশ দায়িত্ব পালন করে যাবে৷ নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের সময় পুলিশকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় যে দায়িত্ব দেবে পুলিশ তা যথাযথভাবে পালন করবে৷”

ভিসা নিষেধাজ্ঞায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কথা উল্লেখ করা হলেও তারা কারা সেই তথ্য পুলিশের কাছে নেই বলে জানান তিনি৷ বলেন, ‘‘কোন কোন সদস্যের বিরুদ্ধে এটা প্রয়োগ করা হয়েছে তার তালিকা কিন্তু আমরা পাইনি৷ এখন সেখানে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা থাকতে পারে৷ অন্য কোনো বাহিনীর সদস্য থাকতে পারে৷ অথবা এখন দায়িত্বরত কোনো পুলিশ কর্মকর্তা বা অন্য কোনো বাহিনীর সদস্য থাকতে পারে৷’

যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী, ভিসা নিষেধাজ্ঞা ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করা হয় না বলে জানিয়েছে বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাস৷ পুলিশের সাবেক আইজি এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নুর মোহাম্মদ বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, ‘‘পুলিশের ওপর রাজনৈতি চাপ থাকে৷ কিন্তু তাদের পেশাদারিত্ব বজায় রেখে কাজ করতে হয়৷ কিন্তু কেউ যদি এর বাইরে গিয়ে কাজ করেন তাহলে সেটা তো তার ব্যক্তিগত ব্যাপার৷ সে দায় তো তার৷”

যুক্তরাষ্ট্রে পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে নিষেধাজ্ঞা থাকা ব্যক্তিরা ও তাদের পরিবারের নিকটাত্মীয়রা দেশটিতে প্রবেশের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন৷ ফারুক হোসেন জানান, বাংলাদেশ পুলিশে দুই লাখেরও বেশি সদস্য৷ তার প্রশ্ন, ‘‘তাদের কতজন অ্যামেরিকায় যেতে চান? খুবই নগন্য সংখ্যায় অ্যামেরিকায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখে বা তাদের ছেলে-মেয়েদের পাঠানোর চিন্তা করে৷ সেই বিবেচনায় আমরা মনে করি এই ভিসা নীতির কোনো প্রভাব বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর ওপর পড়বে না৷ পুলিশ বাহিনির কাজের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না৷”

নিষেধাজ্ঞায় বিচার বিভাগও!

পুলিশ বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিলেও প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্টরা বলছেন এ নিয়ে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি হয়েছে৷ আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ তা প্রকাশ করতে চান না৷

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে বিবৃতি সামনের দিনে বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্টদের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে যা অনেককেই অবাক করেছে৷ তবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক মনে করেন, পুলিশ যেমন রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা নেয় তেমনি আদালতও একই দোষে দুষ্ট৷

তিনি বলেন,” বিরোধী নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা৷ মৃত ব্যক্তিদের মামলায় আসামি করা হয়৷ যাদের বাদি করা হয় তারা জানেনই না যে তারা মামলার বাদি৷ তাদের কেউ বিদেশেও আছেন৷ তাহলে পুলিশ যে রাজনৈতিক পারপাজ সার্ভ করে সেটা বুঝতে তো আর অসুবিধা থাকার কথা নয়৷”

তিনি আরো বলেন, ‘‘নতুন প্রধান বিচারপতি বলেছেন, বাংলাদেশে এমন কোনো বিভাগ নাই যেখানে আস্থার সংকট নাই৷ খালেদা জিয়ার ইরেগুলারিটি-এর জন্য নিম্ন আদালতে পাঁচ বছরের কারাদন্ড হয়েছে৷ দণ্ডের পর এই ধরনের মামলায় উচ্চ আদালত জামিন দেয়৷ তাকে দেয়া হচ্ছে না৷ বিরোধী নেতা-কর্মীরা জামিন পান না৷ এখানে আদালতকে তাহলে আপনি কী বলবেন?” প্রশ্ন এই আইজীবীর৷

মানবাধিকার কর্মী নূর খান মনে করেন সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সবার ভূমিকা আছে৷ ‘‘আমরা দেখছি তারা পুরো নির্বাচনটাকে তাদের মতো করে নিয়েছে৷ তাদের একাধিকবার বলতে শোনা গেছে এই সরকারকে আমরা ক্ষমতায় এনেছি৷ তাদের কথায়ই বোঝা যায় তারা চাইলে নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে৷ আর এই সমস্যা বিচার বিভাগে থাকলে সবার আগে সেটা ঠিক করা দরকার,” বলেন তিনি৷

নির্বাচনের ওপর কী প্রভাব পড়বে?

পুলিশ, জুডিশিয়ারি, প্রশাসন যে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট তা মার্কিন ভিসা নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চিহ্নিত করা হলো বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীম উদ্দিন খান৷ 

তার মতে, ওয়াশিংটন এই ভিসা নীতি প্রয়োগ করেছে৷ এর ফলে প্রশাসনের একটি অংশ বিশেষ করে যাদের সন্তানেরা বিদেশে পড়াশোনা করেন তারা চাপ বোধ করবেন৷ তবে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের উপর তা কতটা প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন৷ বলেন, ‘‘তারা ক্ষমতাসীন হওয়ার কারণে সব কিছুকে উপেক্ষা করতে পারেন৷ তারা জনস্বার্থ উপেক্ষা করে যেনতেনভাবে নির্বাচন করে৷ তাদের এই প্রবণতা আমাদের এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপ চলে আসছে৷”

তবে সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘‘আমরা যারা চাকরিতে আছি তারা যদি যথাযথ আইনানুগভাবে দায়িত্ব পালন করি তাহলে তো আমাদের বিদেশি কোনো স্টিগমার দরকার হয় না৷ কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে কিছু খারাপ লোক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছেন, এটা সত্যি কথা৷ সেক্ষেত্রে তাদের ভিসা নীতির আওতায় এনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়েছে৷ এটা আমাদের দেশের জন্য সুন্দর বা ভালো সেটা আমি বলছি না৷ তবে এতে নির্বাচনে ইতিবাচক ফল আসবে বলে আমি মনে করি৷ এতে ওই ব্যক্তিরা ভীতসন্ত্রস্ত হবে এবং নির্বাচনের নিরপেক্ষতা বাধাগ্রস্ত করা থেকে দূরে থাকবেন বলে মনে হয়৷”

তানজিম বলেন,” যদি তারপরও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ না হয়, নিজেদের মতো করে নির্বাচন হয় তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরো সুযোগ নেবে৷ মনে রাখতে হবে এটা শুধু আমাদের অভ্যন্তরীণ  আওয়ামী লীগ-বিএনপির রাজনীতির বিষয় নয়৷ এটা এখন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত ও রাশিয়ার আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে৷ তাই দেশের স্বার্থেই আমাদের সতর্ক হওয়া দরকার৷ গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নির্বাচন এগুলো সঠিক পথে পরিচালিত হওয়া দরকার৷ ”

ওমর ফারুক বলেন, ‘‘মার্কিন ভিসা নীতির পর যদি লজ্জা থাকে তাহলে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে৷ না থাকলে আসবে না৷”

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d