Bangladesh

মির্জা ফখরুল, নিপুণ রায়, আর কারা অপপ্রচারের শিকার

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রীকান্ত’–এর নায়িকা রাজলক্ষ্মী। এক বিদেশির সঙ্গে সেই নায়িকা হোটেলের পুলে নেমেছেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের এক ওটিটি প্ল্যাটফর্মে প্রচারিত ‘শ্রীকান্ত’ নামের সিরিজের একটি দৃশ্য এটি। তাতে সেই রাজলক্ষ্মী হয়েছেন সোহিনী সরকার। সম্প্রতি রাজলক্ষ্মীর ওই দৃশ্যটি আবার আলোচনায় এসেছে বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। সেখানে সোহিনী সরকার নয়, রাজলক্ষ্মীরূপে দেখা গেল বিএনপির নেত্রী নিপুণ রায়কে।

এত দিন অপতথ্য, গুজব, মিথ্যা তথ্যের বেশি কিছু নমুনা দেখা গেলেও সম্প্রতি রাজনীতির ‘ভার্চ্যুয়াল যুদ্ধে’ নতুন করে যুক্ত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) প্রয়োগ। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে কোনো একজনের মুখে অন্য কারও চেহারা বসিয়ে ছবির পাশাপাশি ভিডিও তৈরি করা হয়। অর্থাৎ ফটোশপের আরও আধুনিক ভার্সন বা সংস্করণ, যেটা ‘ডিপফেক’ নামে পরিচিত। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যত এগোচ্ছে, ডিপফেকের ব্যবহারও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য নিপুণ রায়ও সেই ডিপফেকের শিকার।

অনলাইন যাচাই ও মিডিয়া গবেষণা প্ল্যাটফর্ম ডিসমিসল্যাব জানিয়েছে, গত জুলাইয়ের শেষে ‘শ্রীকান্ত’ নামের ওয়েব সিরিজের একটি দৃশ্যে সোহিনী সরকারের চেহারায় নিপুণ রায়কে বসানো একটি রিল ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। ডিসমিসল্যাব ওই ভিডিও যাচাই করে বলেছে, এটি ডিপফেক।

এসব ছড়ানোয় রাজনৈতিক দলগুলোরও সংশ্লিষ্টতা থাকে। গুজব ও অপতথ্য রোধে সংবাদমাধ্যমগুলোকে বাড়তি গুরুত্ব দিতে হবে।

সুমন রহমান, অধ্যাপক, মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ

একই ঘটনা ঘটেছে ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবালের ক্ষেত্রে। চলতি আগস্ট মাসের শুরুতে তাঁকে ছাত্রদলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপরই তাঁর একটি ছবি নিয়ে এআই টুল ব্যবহার করে ভিডিও বানানো হয়। ডিসমিসল্যাব যাচাই করে জানিয়েছে, এটিও ডিপফেক। এ ছাড়া ফেসবুক কর্তৃপক্ষও এটি ভুয়া বলে ভিডিওটির ওপর বার্তা দিয়ে রেখেছে।

নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে অনলাইনে অপতথ্য, গুজব তত বাড়ছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক বিষয়ই সবচেয়ে বেশি। ডিসমিসল্যাবের হিসাবে গত জুলাই থেকে আগস্টের ২০ তারিখ পর্যন্ত যত মিথ্যা তথ্য ছড়িয়েছে, তার ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশই হচ্ছে রাজনীতিবিষয়ক। 

এই সময়ে ছড়ানো মিথ্যা বা অপতথ্যের মধ্যে ৬৬ দশমিক ৪ শতাংশ স্থানীয়, এর মধ্যে ৫৮ দশমিক ৫ শতাংশ রাজনৈতিক।

রাজনীতিবিদদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভুয়া তথ্য ছড়িয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে। এরপর আছেন একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। তিনি ১৪ আগস্ট মারা গেছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে যে অপতথ্যটি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে, সেটি হচ্ছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে মির্জা ফখরুল ৫০ লাখ টাকা অর্থ সহায়তা নিয়েছেন’।

সাম্প্রতিক সময়ে যে অপতথ্যটি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে, সেটি হচ্ছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে মির্জা ফখরুল ৫০ লাখ টাকা অর্থ সহায়তা নিয়েছেন’।

সাম্প্রতিক সময়ে যে অপতথ্যটি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে, সেটি হচ্ছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে মির্জা ফখরুল ৫০ লাখ টাকা অর্থ সহায়তা নিয়েছেন’। এমন এক খবরের সঙ্গে একটি ভুয়া চেকের বার্তাও ছড়িয়ে পড়েছে। একাধিক ফ্যাক্ট চেকার বা তথ্য যাচাই নিয়ে কাজ করা সংস্থা এটিকে ভুয়া বলে জানিয়েছে।

তথ্য যাচাইসংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশ করে রিউম্যার স্ক্যানার নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তারা জানিয়েছে, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ঘিরে ছড়ানো চেকটি বার কাউন্সিলের একটি প্রণোদনার চেক থেকে সম্পাদনা করা এবং এর নম্বরটি ভুল ছিল।

ডিসমিসল্যাবের গবেষণাপ্রধান মিনহাজ আমান প্রথম আলোকে বলেন, তথ্য ও অপতথ্য সমান্তরালভাবে চলে। সামনে নির্বাচন তাই অপতথ্যগুলোর অধিকাংশই রাজনীতি ঘিরে। দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যত জটিল হবে, এ ধরনের অপতথ্য তত বাড়বে। তিনি আরও বলেন, অপতথ্য ছড়ানোয় আরেকটি প্রবণতা হচ্ছে নারী রাজনীতিবিদদের লক্ষ্য বানানো। আমেরিকান এক মডেলের ইনস্টাগ্রাম ভিডিওতে এআই ব্যবহার করে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা মুখ বসিয়ে তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

তথ্য যাচাই নিয়ে কাজ করা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, এআই ব্যবহার করে ডিপফেক ভিডিও বানানোর নানা টুলস এখন হাতের নাগালে। অপতথ্য ছড়ানোর অন্যতম বড় মাধ্যম হচ্ছে ফটোকার্ড তৈরি করা। তাঁরা জানান, এটি করা ৩০ সেকেন্ডের ব্যাপার এবং খুব দ্রুত ছড়ানো সম্ভব। এর জন্য হাতের মোবাইলটিই যথেষ্ট।

দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো সংবাদের বার্তা দিয়ে ফটোকার্ড তৈরি করে প্রচার করে। সম্প্রতি সেই কার্ডগুলো সম্পাদনা করে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা বেড়েছে।

‘শ্রীকান্ত’ নামের সিরিজের একটি দৃশ্যে সোহিনী সরকারের স্থলে রাজলক্ষ্মীরূপে দেখা গেল বিএনপির নেত্রী নিপুণ রায়কে।

‘শ্রীকান্ত’ নামের সিরিজের একটি দৃশ্যে সোহিনী সরকারের স্থলে রাজলক্ষ্মীরূপে দেখা গেল বিএনপির নেত্রী নিপুণ রায়কে।

গত ২৯ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর দক্ষিণ আফ্রিকা সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। এই সংবাদ সম্মেলনের আগে একাত্তর টেলিভিশনের ফটোকার্ডের আদলে একটি ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়, যাতে লেখা ছিল, ‘পদত্যাগের ঘোষণা নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসছেন প্রধানমন্ত্রী।’

রিউমর স্ক্যানার জানিয়েছে, ‘সংবাদ সম্মেলনে আসছেন প্রধানমন্ত্রী’ শীর্ষক ফটোকার্ডের সঙ্গে ভিন্ন ফন্ট ব্যবহার করে বাকি শব্দগুলো বসিয়ে ভুয়া কার্ডটি বানানো হয়েছে।

রিউমর স্ক্যানারের জ্যেষ্ঠ ফ্যাক্ট চেকার সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, তারা দিনে সাত–আটটি তথ্য যাচাই করেন। গত এক সপ্তাহে গড়ে প্রতিদিন তিনটি রজানৈতিক গুজব তাঁরা শনাক্ত করেছেন। এ ছাড়া গত দুই মাসে ৮০টি রাজনৈতিক গুজব শনাক্ত করেছে রিউম্যার স্ক্যানার।

সাজ্জাদ হোসেন বলেন, সম্প্রতি গণমাধ্যমের নামে ফটোকার্ডের মাধ্যমে ভুয়া তথ্য ছড়াচ্ছে বেশি। যে ব্যক্তি যখন আলোচনায় থাকে, তখন তাঁকে নিয়েই বিরোধী পক্ষ কোনো অপতথ্য ছড়িয়ে থাকে। দেশের প্রথম সারির গণমাধ্যমগুলোর নামে এই ভুয়া তথ্য ছড়ানো হচ্ছে বেশি।

প্রথম আলোর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পরিচালনা টিম জানিয়েছে, প্রথম আলোর নামে ফটোকার্ড দিয়ে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর বিষয়ে সতর্ক করে গত ৩১ মে থেকে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত ১৩টি ফটোকার্ড বানিয়ে প্রচার করতে হয়েছে। এই ১৩টির মধ্যে ৯টি ছিল রাজনীতিবিষয়ক।

বিশ্বের যেকোনো দেশেই নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসে, সে দেশে গুজব, ভুয়া তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা বাড়তে থাকে। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোই এসবের পৃষ্ঠপোষকতা করে। একে অন্যের বিরুদ্ধে এসব অপতথ্য ছড়ানোর প্রতিযোগিতায় নামে। চলতি বছরের ২০ মে দ্য গার্ডিয়ান তাদের প্রতিবেদনে নির্বাচন ঘিরে এআই ব্যবহার করে অপতথ্য ছড়ানোর বিষয় তুলে ধরে। আগামী বছর যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে দেশ দুটির বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, এআই দ্বারা তৈরি ছবি, বার্তা, ডিপফেক ভিডিও ভাইরাল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যেগুলো ব্যবহারকারীদের প্রভাবিত করতে পারে।

ফেসবুকে ভুয়া তথ্য ছড়ানো নিয়ে দ্য কনভারসেশন নামের একটি অলাভজনক গণমাধ্যমে গত ৩০ জুন একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের আগে ফেসবুকে পোস্ট করা প্রতি চারটি রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ছবির মধ্যে একটি ভুয়া।

ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবালের একটি ছবি নিয়ে এআই টুল ব্যবহার করে ভিডিও বানানো হয়।

ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবালের একটি ছবি নিয়ে এআই টুল ব্যবহার করে ভিডিও বানানো হয়।

যুদ্ধ, সংকটের মতো পরিস্থিতিতে গুজব অন্যতম একটি অস্ত্র বলে জানান ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগের অধ্যাপক সুমন রহমান। তিনি তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ফ্যাক্ট ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকও। তিনি বলেন, মানুষের জীবন এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেন্দ্রিক এবং দুনিয়া দেখার প্রধান জানালা এই মাধ্যম। দেশে গত পাঁচ–সাত বছরে যত সহিংসতা হয়েছে, তার পেছনে কোনো না কোনোভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অপতথ্যের প্রভাব রয়েছে।

রাজনৈতিক গুজব ও অপতথ্য বিষয়ে সুমন রহমান বলেন, এসব ছড়ানোয় রাজনৈতিক দলগুলোরও সংশ্লিষ্টতা থাকে। গুজব ও অপতথ্য রোধে সংবাদমাধ্যমগুলোকে বাড়তি গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি সরকারের নীতিনির্ধারক, নাগরিক সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও যাচাইয়ের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে কাজ করতে হবে। মানুষকেও নিজ উদ্যোগে তথ্য যাচাইয়ে অভ্যস্ত হতে হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor