Bangladesh

যান্ত্রিক যুগে কৃষি ॥ বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট: জমি তৈরি থেকে ধান শুকানো সবই হচ্ছে যন্ত্রে

ফসল আবাদে বাড়ছে কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার। ফলে বদলে যাচ্ছে কৃষির দৃশ্যপট। সনাতন কৃষি পরিণত হচ্ছে এক আধুনিক কৃষিতে। এখন জমি প্রস্তুত থেকে শুরু করে ধান কাটা মাড়াই ঝাড়া শুকানো সবই হচ্ছে যন্ত্রের মাধ্যমে। আর এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের কৃষি প্রবেশ করেছে যান্ত্রিক যুগে। এতে শুধু ফসল উৎপাদনের ব্যয়ই কমছে না, কমছে ফসল ঘরে তোলার সময়ও। সময়মতো ফসল সংগ্রহ করার ফলে হ্রাস পাচ্ছে সংগ্রহোত্তর ক্ষতি। সাশ্রয় হচ্ছে কৃষকের সময়ও। হ্রাস পাচ্ছে কৃষকের কায়িক শ্রম। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাচ্ছে ফসল। সংগ্রহত্তোর অপচয় হ্রাস পাওয়ায় বেশি ফসল পাচ্ছে কৃষক। সর্বোপরি, উৎপাদন খরচ কমে যাওয়ায় কৃষকের লাভের পরিমাণ বাড়ছে। এতে প্রতি বছর শুধু বোরো ও আমন মৌসুমেই কৃষকের সাশ্রয় হচ্ছে দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকা।       
এক সময় দেশে চাষাবাদ হতো গরু ও মহিষ দিয়ে। এতে জমি প্রস্তুত থেকে রোপণ পর্যন্ত লাগতো দীর্ঘ সময়। আবার শ্রমিক সংকটে ধান কাটা নিয়েও বিপাকে পড়তে হতো। সময়ের ব্যবধানে গত কয়েক বছরে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ায় কৃষকদের সেই কষ্ট লাঘব হতে চলেছে। এখন আর শ্রমিকদের অপেক্ষায় দিন গুণতে হয় না কৃষকদের। কৃষিযন্ত্র ব্যবহারের ফলে স্বল্প সময়েই কয়েক বিঘা জমি চাষাবাদ করা যাচ্ছে। রাইস ট্রান্সপ্লান্টার যন্ত্রের মাধ্যমে ঘণ্টায় ২৫০ হেক্টর জমিতে চারা রোপণ করা যায়, যা চারজন শ্রমিক দিয়ে করলে তিন দিন সময় লাগে। আবার স্বল্প শ্রমিকেই মাইলের পর মাইল হয়ে যাচ্ছে ধান কাটা ও মাড়াই। কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার দিয়ে ঘণ্টায় চার বিঘা জমির ধান কাটা যাচ্ছে। 
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, একসময় ভারী কৃষিযন্ত্র বলতে শুধু ট্রাক্টরকেই চিনত দেশের কৃষক। সেটাও খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। কিন্তু এখন কৃষিতে ডজনখানেক বড় যন্ত্রের ব্যবহার করছেন কৃষকরা। চাষাবাদ থেকে শুরু করে ঘরে তোলা পর্যন্ত সবখানেই যন্ত্র তাদের সাহায্য করছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএইউ) কৃষিশক্তি ও যন্ত্র বিভাগের এক গবেষণা বলছে, চাষ, সেচ, নিড়ানি, কীটনাশক প্রয়োগে ৮০-৯৫ শতাংশ যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে। যদিও ফসল রোপণ, সার দেওয়া, কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই ও শুকানোর ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার এখনো অনেক কম। তবে নতুন করে প্রকল্প গ্রহণ করায় গত তিন বছর ধরে এসব ক্ষেত্রে কৃষি যন্ত্রের ব্যবহারও দ্রুত বাড়ছে। 
আধুনিক কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ছোঁয়ায় দেশের কৃষির অবস্থা ক্রমেই পাল্টে যাচ্ছে। কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধির ও খরচ কমিয়ে আনতে এখন বড় ভূমিকা রাখছে আধুনিক কৃষিযন্ত্র। এগুলোর মধ্যে আছে ফসল কাটা ও শস্য সংগ্রহ ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত কম্বাইন্ড হার্ভেস্টর, মাটিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গভীরভাবে কর্ষণ করতে ব্যবহৃত হচ্ছে পাওয়ার টিলার। এটি মাটিকে প্রায় ১২ ইঞ্চি গভীর থেকে আলগা করে। মাটিকে বীজ বপনের উপযোগী করে প্রস্তুত করার কাজে রয়েছে প্লান্টার। মাটিকে চাষাবাদের উপযোগী করতে ও বসতবাড়ির কাজে লাগাতে ব্যবহৃত হচ্ছে টু হুইল ট্রাক্টর। বীজ বপন, সার দেওয়া, কীটনাশক ছিটানো প্রভৃতি কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে ব্রডকাস্ট সিডার। নির্দিষ্ট স্থানে বীজ বপন করতে রয়েছে সিড ড্রিল। এ যন্ত্রটি ব্রডকাস্ট সিডার অপেক্ষা আধুনিক। এ ছাড়া রয়েছে মেনুয়র স্প্রেডার, স্প্রেয়ার, বিন হার্ভেস্টার, চেজার বিন, কর্ন হার্ভেস্টার ইত্যাদি।
ফলে হালের বলদ আর হাতে তৈরি যন্ত্রপাতির ব্যবহার এখন আর হয় না বললেই চলে। হাল চাষ করার জন্য এখন আর ব্যবহার হয় না লাঙ্গল। ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলার নামের চাষের মেশিন দিয়ে এখন নিমিষেই রোপণ উপযোগী করা হয় জমিকে। জমিতে সার দেওয়ার জন্য কিংবা জমির আগাছা দমন করার জন্য দিনের পর দিন আর কষ্ট করতে হয় না। মেশিনের সাহায্যে সহজেই এখন এই কাজগুলো সম্পন্ন করা যায়।
ফসল পরিপক্ব হয়ে গেলে জমি থেকে বাড়িতে ওঠানো পর্যন্ত কৃষকের ঘুম হয় না। এই কাজের জন্য এক সময় অনেক লোকের দরকার হতো। কিন্তু আধুনিক কৃষিতে ফসল কাটার যন্ত্র যোগ হওয়ায় কৃষকরা এখন অনেকটাই শঙ্কামুক্ত থাকেন। ফসল কাটা থেকে মাড়াই পর্যন্ত প্রতিটি কাজের জন্য আলাদা যন্ত্র আবিষ্কার হওয়ায় একদিনেই একরের পর একর জমির ধান ঘরে তোলা সম্ভব হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে কৃষি যন্ত্রের মাধ্যমে নিরাপদে ফসল ঘরে তুলতে পেরে কৃষকও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন। 
এক সময় মনে করা হতো আধুনিক কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার বাড়লে কৃষি খাতে বেকারের সংখ্যা বাড়বে। অথচ এখন কৃষি শ্রমিকের সংকট এবং মজুরি যে হারে বাড়ছে তাতে কৃষকদের উৎপাদন ব্যয় কমাতে আধুনিক কৃষিযন্ত্র ব্যবহারের বিকল্প নেই। ফলে সরকার উদ্যোগী হয় দেশে কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য। 
যেভাবে কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার শুরু ॥ স্বাধীন দেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে শুরু হয় কৃষির যান্ত্রিকীকরণ। তাঁর নির্দেশনায় ১৯৭৩ সালে দ্রুততম সময়ে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রথমবারের মতো নামমাত্র মূল্যে ভর্তুকি দিয়ে ৪০ হাজার শক্তিচালিত লো-লিফট পাম্প, দুই হাজার ৯০০ গভীর নলকূপ এবং তিন হাজার অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়। আধুনিক কৃষিযন্ত্র সম্প্রসারণে এটি ছিল ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।

কিন্তু ব্যয়বহুল ও প্রাপ্যতার অভাবে সেভাবে আর পরবর্তী সময়ে দেশে কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার বাড়েনি। পরবর্তী সরকারগুলোও এ বিষয়ে আগ্রহী হয়নি। অথচ দেশে শিল্পের প্রসার ঘটতে থাকায় কৃষিশ্রমিকরা অনিশ্চয়তার কৃষিকাজ ছেড়ে শিল্পে চলে যায়। সেই সঙ্গে শিক্ষিত হয়ে কৃষকের ছেলে আর কৃষি পেশায় ফিরে আসে না। তারাও সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে চলে যাচ্ছেন। ফলে ক্রমান্বয়ে দেশের কৃষিতে শ্রমিক সংকট প্রকট আকার ধারণ করতে থাকে। 
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর খামার যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প শীর্ষক কৃষি যান্ত্রিকীকরণের প্রথম প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১০ সালে। ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ের ওই প্রকল্পের আওতায় তিন বছরে ৩৫ হাজার আধুনিক কৃষিযন্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। এসব যন্ত্রের মধ্যে রয়েছে- পাওয়ার টিলার, পাওয়ার থ্রেসার, ট্রাক্টর ও স্পেয়ার। 
প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০১৩-২০১৯ সালে ৩৩৯ কোটি টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাজস্ব বাজেটে ১৬৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। বর্তমানে ২০২০-২০২৫ মেয়াদে তৃতীয় পর্যায়ে ৩০২০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদানের মাধ্যমে দেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ সম্প্রসারণের ধারা অব্যাহত রয়েছে। দেশের ৬৪ জেলার সকল উপজেলায় এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় দেশের ৬৪ জেলার ৫০০ উপজেলায় ৫ বছরে ১২ ক্যাটাগরির ৫১৩০০টি কৃষি যন্ত্র সরবরাহ করার সংস্থান রয়েছে। 
ফলে ধীরে ধীরে দেশে কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার বাড়তে শুরু করে। চাহিদা বাড়তে থাকায় দেশের বেসরকারি খাতও কৃষিযন্ত্র আমদানি, উৎপাদন ও বিপণনে এগিয়ে আসে। এতে দেশে ফসল আবাদের জন্য জমি প্রস্তুত ও ধান কাটার পর তা মাড়াইয়ে যন্ত্রের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়লেও, ধানের চারা রোপণ ও ধান কাটার ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার অতি নগণ্য পর্যায়ে থেকে যায়। ফলে মহামারি করোনার সময়ে বোরো মৌসুমে ধান কাটতে গিয়ে কৃষি যন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা খুব বড় করে দেখা দেয়। তখন তীব্র শ্রমিক সংকটে কৃষক জমির ধান কাটতে গিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন।

এ সময় উত্তরবঙ্গ ও চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে বাস ভর্তি করে শ্রমিক নিয়ে সরকার হাওড়ের ধান কাটতে কৃষকদের সহায়তা করে। সরকারের আহ্বানে ছাত্র, ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা গিয়ে কৃষকের ধান কেটে দেন। এই অবস্থায় কৃষি মন্ত্রণালয় নতুন করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের উদ্যোগ নেয়। গ্রহণ করা হয় তিন হাজার ২০ কোটি টাকার প্রকল্প। ২০২০ সালের জুলাই মাস থেকে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে কৃষি খাতে সর্ববৃহৎ প্রকল্প ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্প।

এ প্রকল্পের অধীনে সারাদেশে ৫০ শতাংশ ও হাওড়-উপকূলীয় এলাকায় ৭০ শতাংশ ভর্তুকিতে কৃষকদের কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হচ্ছে। দুই প্রকল্পের মাধ্যমে ২০১০ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত কম্বাইন্ড হার্ভেস্টর, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, রিপার, সিডার ও পাওয়ার থ্রেসারসহ প্রায় এক লাখ ৩৩ হাজারটি কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে। এর ফলে কৃষি শ্রমিকের সংকট কাটানো সম্ভব হচ্ছে। সেই সঙ্গে হ্রাস পেয়েছে উৎপাদন ব্যয়। 
যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে দ্রুত ॥ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের সুফল মিলতে শুরু করেছে। প্রকল্প শুরুর তিন বছরের মধ্যেই ধান কাটার যন্ত্র কম্বাইন্ড হার্ভেস্টারের ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ২০০০ শতাংশ। 
কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প  শুরুর আগে ২০১৯ সালে দেশে কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার দিয়ে ধান কাটা হতো মাত্র চার শতাংশ। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ১৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেবে, গত বোরো (২০২২) মৌসুমে নেত্রকোনায় ৭১ শতাংশ, মানিকগঞ্জে ৭০ শতাংশ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৬০ শতাংশ, দিনাজপুরে ৫২ শতাংশ, ঠাকুরগাঁওয়ে ৫২ শতাংশ, হবিগঞ্জে ৫২ শতাংশ, মৌলভীবাজারে ৫০ শতাংশ, নোয়াখালীতে ৫০ শতাংশ, ভোলায় ৪৭ শতাংশ, সুনামগঞ্জে ৪১ শতাংশ এবং পটুয়াখালীতে ৪১ শতাংশ জমির ধান কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার দিয়ে কাটা হয়েছে। আইএমইডির হিসেবে প্রকল্প শুরুর পর কম্বাইন্ড হার্ভেস্টারের ব্যবহার ১৯৯০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে শুধু ২০২২-২৩ অর্থবছরেই কম্বাইন্ড হার্ভেস্টারের মাধ্যমে বোরো ও আমন ধান কাটায় কৃষকের ২৭.১৪ বিলিয়ন বা দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে।
নব্বইয়ের দশকে দেশে আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার শুরুর পর বর্তমানে দেশে প্রায় শতভাগ জমি চাষ যন্ত্রের মাধ্যমে হচ্ছে। কিন্তু ধান রোপণ, কাটা, মাড়াইসহ অন্যান্য কাজে যন্ত্রের ব্যবহার ছিল খুবই কম। ২০১৯ সালে ধান রোপণের যন্ত্র রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের ব্যবহার ছিল এক শতাংশের নিচে। কিন্তু বর্তমানে ধান রোপণের রাইস ট্রান্সপ্লান্টার যন্ত্রের ব্যবহার বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ছয় শতাংশ। এছাড়া ধান কাটা রিপার যন্ত্রের ব্যবহার ১৮৫ শতাংশ, বীজ বপন ও জমি চাষ করার সিডার যন্ত্রের ব্যবহার ৬৯৭ শতাংশ, মাড়াই পাওয়ার থ্রেসার যন্ত্রের ব্যবহার ১৯৩ শতাংশ এবং মেইজশেলার যন্ত্রের (মাড়াই) ব্যবহার ২১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।  
আইএমইডির মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, কৃষিযন্ত্র ব্যবহারের কারণে দেশে ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি পেয়েছে ১০ শতাংশ। ফসলের সংগ্রহত্তোর অপচয় কমেছে আট শতাংশ। পাশাপাশি ফসলের উৎপাদন খরচ হ্রাস পেয়েছে ৪৫.২৫ শতাংশ, যা প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, কৃষিযন্ত্র ব্যবহারের ফলে আট ধরনের সুবিধা পাচ্ছেন কৃষক। কৃষিযন্ত্র ব্যবহার করায় প্রতি একরে সনাতন পদ্ধতির চেয়ে কৃষকের সাশ্রয় হচ্ছে পাঁচ হাজার ৮০০ টাকা। সনাতন পদ্ধতিতে প্রতি একর জমির ধান কাটা, ধানসহ খড় পরিবহন, মাড়াই, ঝাড়াইয়ে খরচ হয় ১১ হাজার ৮০০ টাকা। আর একই পরিমাণ জমির ধান কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার ব্যবহারের মাধ্যমে কাটা, মাড়াই, ঝাড়া ও পরিবহন বাবদ খরচ হয় ছয় হাজার টাকা। অর্থাৎ কৃষিযন্ত্র ব্যবহারে প্রতি একরে কৃষকের খরচ কমছে পাঁচ হাজার ৮০০ টাকা।
কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার দিয়ে ধান কাটার ফলে সংগ্রহত্তোর অপচয় ১০ শতাংশ থেকে কমে দুই শতাংশ চলে এসেছে। ফলে কৃষক আট শতাংশ ধান বেশি পাচ্ছে। এতে ধানের বর্তমান বাজারমূল্যে কৃষকের লাভ হচ্ছে প্রতি একরে চার হাজার ৪৪৫ টাকা। এছাড়া, কৃষিযন্ত্র ব্যবহার করে কৃষক কম সময়ে ফসল ঘরে তুলতে পারছে। সময়মতো ফসল সংগ্রহ করায় সংগ্রহত্তোর ক্ষতি অনেক কমে যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগেই কৃষক ফসল কেটে ঘরে তুলতে পারছেন। সাশ্রয় হচ্ছে কৃষকের সময়। হ্রাস পাচ্ছে কৃষকের কায়িক শ্রম। উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় কৃষকের লাভের পরিমাণ বাড়ছে।    
এ প্রসঙ্গে নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার দাউতপুর গ্রামে কৃষক আলতাফ হোসেন বলেন, ‘আগে গরু দিয়ে হালচাষ করতে খরচ বেশি পড়ত। এখন পাওয়ার টিলার দিয়ে চাষাবাদ করা হচ্ছে। যেখানে এক বিঘা জমি চাষাবাদ করতে তিন-চার গরুর হাল (লাঙ্গল) লাগত। সেখানে কয়েক মিনিটের মধ্যে এক বিঘা জমি চাষ করা হয়। যন্ত্রের ফলে সময় এবং টাকা দুটোই কম লাগছে।’
সফলতা ও চ্যালেঞ্জ ॥ এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সমন্বিত কৃষি যান্ত্রিকীকরণের প্রকল্প পরিচালক তারিক মাহমুদুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমানে দেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায় চলছে। এই প্রকল্পের আওতায় আমাদের পাঁচ বছরে ৫১ হাজার ৩০০টি কৃষিযন্ত্র কৃষকদের দেওয়ার কথা। ইতোমধ্যে তিন বছরেই আমরা দিয়ে ফেলেছি ৩৩ হাজার ৩৬০টি। এর মধ্যে রয়েছে কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার ৮৪৬৭টি, রিপার ২১৯৬টি, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ৩৩০টি, পাওয়ার টিলারচালিত বেড প্লান্টার ও সিডার ১১৮৯৪টি, পাওয়ার থ্রেসার ৮০৫৮টি, মেইজ শেলার ১১৯৫টি, পাওয়ার স্প্রেয়ার ১৫২টি, পাওয়ার উইডার ২৭টি, পটেটো ডিগার ১০০৮টি, ড্রায়ার ৩৩টি।  এটি সম্ভব হয়েছে কৃষিযন্ত্র ব্যবহারে কৃষকদের ব্যাপক আগ্রহের কারণে।’ 
তিনি বলেন, কৃষকদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে ধান কাটার অত্যাধুনিক যন্ত্র কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার। এটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের শঙ্কা কাটিয়ে নিরাপদে দ্রুত ফসল ঘরে তুলতে সাহায্য করছে কৃষককে। ফলে কৃষকের আগ্রহের শীর্ষে রয়েছে কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার। পাঁচ বছরে আমাদের কম্বাইন্ড হার্ভেস্টর বিতরণের লক্ষ্য হচ্ছে ৯ হাজার। ইতোমধ্যে তিন বছরে আমরা বিতরণ করে ফেলেছি আট হাজার ৭৬৭টি। ২০১৯ সালে এই যন্ত্রের ব্যবহার ছিল চার শতাংশ, এখন তা ১৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। কৃষিযন্ত্র ব্যবহারের কারণে কৃষকের অল্প সময়ে ধান কাটার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এই যন্ত্র ব্যবহার করে কৃষক এখন গম সরিষা ও সয়াবিনও কাটছে। চুয়াডাঙ্গা জেলায় এ বছর শতভাগ জমির ধান কৃষি যন্ত্রের মাধ্যমে কাটা হয়েছে।  
তারিক মাহমুদুল ইসলাম বলেন, কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার ব্যবহারে কৃষক দুইভাবে লাভবান হচ্ছেন। প্রথমত শ্রমিক দিয়ে প্রতি বিঘা জমির ধান কাটতে কৃষকের যেখানে খরচ হতো ছয় হাজার টাকা, সেখানে এই যন্ত্র দিয়ে ধান কাটতে খরচ পড়ছে মাত্র দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। দ্বিতীয়ত. শ্রমিক দিয়ে ধান কাটতে গিয়ে কৃষকের ধান পড়ে গিয়ে অপচয় হতো ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত। সেই অপচয় এখন কমে দাঁড়িয়েছে এক থেকে দুই শতাংশের মধ্যে। এতে দেখা যাচ্ছে, বোরো এবং আমন মৌসুমে কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার দিয়ে জমির ধান কাটতে কৃষকের সাশ্রয় হচ্ছে দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রকল্পের তিন হাজার কোটি টাকার ব্যয় এক বছরেই উঠে এসেছে। 
তিনি বলেন, এই প্রকল্পের কারণে দেশে এখন কম্বাইন্ড হার্ভেস্টারের বাজার তৈরি হয়েছে। ফলে দেশীয় কোম্পানিও এই হার্ভেস্টার তৈরি করছে। প্রকল্পের কারিগরি কমিটির পরামর্শে আনসার এনার্জি লিমিডেট নামে একটি কোম্পানি বাংলাদেশে প্রথম কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার তৈরি করেছে। প্রকল্পের উন্নয়ন সহায়তায় (ভর্তুকি) ইতোমধ্যে এই কোম্পানি ২০-২৫টি হার্ভেস্টার (৭৫ হর্সপাওয়ার) কৃষকের মাঝে বিতরণ করেছে। আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি, দেশে তৈরি এসব হার্ভেস্টারের মান বেশ ভালো। 
তিনি বলেন, আগে দেশে ধানের চারা রোপণের রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের ব্যবহার ছিল এক শতাংশের নিচে। সেটি এখন বৃদ্ধি পেয়ে ছয় শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, পুরুষদের পাশাপাশি মহিলারাও উদ্বুদ্ধ হয়ে ট্রেতে চারা তৈরি এবং রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের মাধ্যমে তা জমিতে রোপণ করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে। রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার প্রমীলা ম-ল ট্রেতে ধানের চারা তৈরি করে প্রতিটি ট্রে ১০০ টাকা করে বিক্রি করছেন। এতে দেশের নারী সমাজের কর্মসংস্থান হচ্ছে।

কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার ও রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ভিত্তিক অনেক উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। তারা এসব যন্ত্র দিয়ে ধানের চারা রোপণ বা ধান কেটে দিয়ে নিজেরা যেমন আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন, তেমনি দেশে কর্মসংস্থানও হচ্ছে। অনেক উচ্চ শিক্ষিত বেকার যুবক চাকরি না পেয়ে ভর্তুকিতে কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার ক্রয় করে বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন জেলায় ধান কর্তন করে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছে। 
তিনি বলেন, ‘কৃষি যান্ত্রিকীকরণের কারণে দেশে কৃষিযন্ত্র ব্যবসায় নতুন নতুন কোম্পানি আসছে। আগে কৃষিযন্ত্রের ব্যবসার সঙ্গে ১৪টি কোম্পানি জড়িত ছিল। এখন সেখানে ৪০টি কোম্পানি এই ব্যবসা করছে। এতে বাজারে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে প্রতিযোগী মূল্যে তার প্রয়োজনীয় কৃষিযন্ত্র কিনতে পারছেন। কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে খুচরা যন্ত্রাংশের চাহিদা বাড়ছে। খুচরা যন্ত্রাংশের সহজলভ্যতার জন্য ইতোমধ্যে অনেক জেলায় খুচরা যন্ত্রাংশ মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সম্প্রতি কুষ্টিয়ায় খুচরা যন্ত্রের একটি মেলা হয়েছে।’  
জনাব ইসলাম আরও বলেন, দেশে এখন সনাতন পদ্ধতির কৃষি থেকে যান্ত্রিকীকরণ কৃষির রূপান্তর ঘটছে। ফলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ করতে গিয়ে আমরা নানা সমস্যারও সম্মুখীন হচ্ছি। এরমধ্যে অন্যতম হলো- যন্ত্র নষ্ট হলে তা মেরামত, বিক্রয় পরবর্তী সেবা, যন্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণ এবং খুচরা যন্ত্রাংশ পাওয়া। এগুলোই এখন আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মোকাবিলা করছি। বিভিন্ন ব্যাচ যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আমরা মেকানিক তৈরি করছি। ইতোমধ্যে তিন হাজার ২১০ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। এরমধ্যে দেড় থেকে দুই হাজার মেকানিক এখন বিভিন্ন উপজেলায় গিয়ে কাজ করছেন। 
তিনি বলেন, অবসর সময়ে যন্ত্র কিভাবে সংরক্ষণ করতে হবে সে বিষয়ে আমরা কৃষকদের সচেতন করছি। পাশাপাশি আমরা একটি হটলাইন চালু করেছি, যাতে কৃষক তার কৃষিযন্ত্রের যে কোনো সমস্যার কথা আমাদের জানালে আমরা তাৎক্ষণিক সমাধান করছি। এছাড়া কোম্পাানিগুলোর সঙ্গে আমরা কথা বলছি, তারা যাতে কৃষিযন্ত্র বিক্রির পর বিক্রয়োত্তর সেবা সঠিকভাবে দেয়।
উল্লেখ্য, শর্ত অনুসারে এই প্রকল্পের আওতায় যেসব কৃষক সরকারের নিয়োগকৃত সরবরাহকারীদের কাছ থেকে কৃষি যন্ত্রপাতি কিনবেন তারা তিন বছরের বিক্রয়োত্তর সেবা পাবেন। এছাড়া কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার, পাওয়ার থ্রেসার ও রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের মতো যন্ত্রপাতির জন্য কৃষকরা এক বছরের ওয়ারেন্টি পাবেন। যন্ত্রের ত্রুটি শনাক্ত করে তা মেরামতের বিষয়টি ওয়ারেন্টিতে অন্তর্ভুক্ত আছে।
প্রকল্পের আওতায় ভর্তুকি মূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য এসিআই মোটরস লিমিটেড, গ্রিনল্যান্ড টেকনোলজিস লিমিটেড ও এসকিউ ট্রেডিং অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংসহ মোট ৩৪ কোম্পানিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। হাওড় ও উপকূলীয় এলাকার কৃষকরা ৭০ শতাংশ ভর্তুকি দিয়ে কৃষি যন্ত্রপাতি কিনতে পারবেন। অন্যান্য অঞ্চলের কৃষকরা ৫০ শতাংশ ছাড় পাবেন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
Situs Toto
Toto Gacor
bacan4d
bacansport login
slot gacor
pasaran togel resmi
bacan4d
toto togel
slot toto
Toto slot gacor
bacan4d
slotgacor
bacan4d rtp
bacan4d
bacan4d toto
Slot Casino
bacan4d toto
slot gacor
bacan4d
bacan4d
Slot Toto
bacan4d
bacan4d login
totoslotgacor
slot gacor
TOTO GACOR
bacan4d
bacan4d slot gacor
bacan4d login
Bacan4d
bacan4d
bacan4d bonus
Toto gacor
Toto gacor
slot gacor hari ini
bacan4d toto
bacan4d toto
bacan4d
bacan4d
bacan4d
toto slot
bacan4d
bacan4d link alternatif
slot gacor bett 200
situs toto
SITUS TOTO
toto 4d
Slot Toto
Slot Toto
Slot Toto
Situs toto
Slot toto
Slot Dana
Slot Dana
Judi Bola
Judi Bola
Slot Gacor
toto slot
bacan4d toto
bacan4d akun demo slot
bacantogel
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacantoto
bacan4d
Bacan4d Login
slot demo
Bacan4d Toto
toto gacor
Slot Gacor
Live Draw
Live Draw Hk
Slot Gacor
toto slot
Bacan4d slot gacor
toto macau
toto slot
Toto Gacor
slot dana
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
Slot Dp Pulsa
Bacan4d Login
toto slot
Bacansports/a>
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
slot gacor
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
slot demo
toto slot gacor
bacansports Slot toto toto slot Slot toto Slot dana Slot toto slot maxwin slot maxwin toto slot toto slot slot dana
Toto Bola
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
bacan4d
ts77casino
situs toto
slot pulsa
bacansports
situs toto
slot toto
situs toto
slot toto
situs toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansports
slot toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
situs toto
situs toto
xx1toto
toto slot
xx1toto
xx1toto
slot qriss
Slot Toto
slot dana
situs toto
slot toto
slot dana
Situs Toto Slot Gacor
xx1toto
xx1toto
bacan4d
xx1toto
xx1toto
toto slot
situs toto slot gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
situs toto
Slot Toto
Toto Slot
Slot Gacor
Slot Gacor
Slot Gacor
slot toto
Toto Slot
slot gacor
situs togel
Toto Slot
xx1toto
bacansport
bacan4d
toto slot
situs toto
slot gacor
Toto Slot
slot maxwin
slot demo
bacan4d toto slot
bacan4d toto slot
bacan4d slot
bacan4d slot
bacan4d slot
bacansports
bacansports
bacansports
bacan4d slot
bacan4d slot
bacan4d
slot gacor
pasaran togel resmi
situs toto
bacan4d login
pasaran togel
pasaran togel
situs toto
bacan4d
bacan4d gacor
bacan4d slot
bacan4d rtp
bacan4d rtp
bacan4d slot gacor
toto slot
situs toto
bacan4d
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bandar togel
toto gacor Toto Gacor bacan4d slot toto casino slot slot gacor bacantoto totogacorslot Toto gacor bacan4d login slotgacor bacan4d bacan4d toto Slot Gacor toto 4d bacan4d toto slot bacan4d slot gacor