Bangladesh

রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচারের সন্দেহ আইএমএফের

গত অর্থবছরে পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে দেশে আসা আয়ের বড় পার্থক্য থাকাকে পুঁজি পাচারের সংকেত হিসেবে দেখছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ। সংস্থাটির ধারণা, এই পার্থক্যের একটি অংশ পদ্ধতিগত কারণে হতে পারে। কিন্তু ইতিহাসের সর্বোচ্চ অপ্রত্যাশিত রপ্তানি আয়ের সঙ্গে অর্থ পাচারের সম্পর্ক থাকতে পারে। 

গত শুক্রবার আইএমএফ প্রকাশিত বাংলাদেশ কান্ট্রি রিপোর্টে ‘সিলেক্টেড ইস্যুজ’ নামে আলাদা এক উপস্থাপনায় এমন মত রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনিশ্চয়তা বড় অঙ্কের রপ্তানি আয় দেশে না আসার অন্যতম কারণ হতে পারে। রপ্তানিকারকদের একটি অংশের মধ্যে নির্বাচনের ফল না জানা পর্যন্ত দেশে তাদের আয় না আনার সিদ্ধন্তের বিষয় থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়। 

এর আগে গত অক্টোবরে প্রকাশিত বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর বিশ্বব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণ এবং রপ্তানি আয় প্রত্যাবাসনের মধ্যে বড় পার্থক্য বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যে বড় ঘাটতির অন্যতম কারণ। কেননা, গত অর্থবছরে সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে ৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঘাটতির মধ্যে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি ‘এররস অ্যান্ড অমিশন্স’ বা ভুল এবং বাদজনিত রিপোর্টিংয়ের কারণে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে অবৈধ পুঁজি পাচারের সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংক এবং রপ্তানিকারকদের সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে, একটি নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য জাহাজীকরণ এবং রপ্তানি আয় প্রত্যাবাসনের মধ্যে পদ্ধতিগত কারণেই পার্থক্য থাকবে। কেননা, পণ্য মূল্যায়নের পর কাস্টম হাউসের দেওয়া বিল অব এক্সপোর্টের ভিত্তিতে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। বিল অব এক্সপোর্টের পরও অনেক সময় বিচ্ছিন্ন কারণে রপ্তানি বিলম্ব বা বাতিল হতে পারে। অন্যদিকে পণ্য জাহাজীকরণ বা বিল অব ল্যাডিংয়ের তথ্য অনলাইন এক্সপোর্ট মনিটরিং সিস্টেমে (ওইএমএস) রিপোর্ট করার পর বাংলাদেশ ব্যাংক রপ্তানির পরিসংখ্যান তৈরি করে, যা ব্যালান্স অব পেমেন্ট বা লেনদেনের ভারসাম্যের তথ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়। আর রপ্তানি আয় দেশে আনার তথ্য প্রকাশ করে বাণিজ্যিক ব্যাংকের হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রা  জমা হওয়ার পর। 

কেন সন্দেহ
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি বাবদ বাণিজ্যিক ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রা জমা হওয়ার পরিমাণ ৪৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার বা ৪ হাজার ৩৫৭ কোটি ডলার, যা এর আগের অর্থবছরের চেয়েও কম। ২০১১-২২ অর্থবছরে যার পরিমাণ ৪ হাজার ৩৬০ কোটি ডলার। অথচ ইপিবি এবং বাংলাদেশ ব্যাংক উভয়ের হিসাবে আগের অর্থবছরের তুলনায় রপ্তানি বেড়েছে ৬ শতাংশের বেশি। ইপিবি বলছে, গত অর্থবছরে রপ্তানি  হয়েছে ৫ হাজার ৫৬৬ কোটি ডলারের পণ্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে যার পরিমাণ ৫ হাজার ২৩৩ কোটি ডলার। অথচ দেশে রপ্তানি আয় যা ঢুকেছে, তা ইপিবির পরিসংখ্যানের চেয়ে ১২শ কোটি ডলার (১২ বিলিয়ন) কম এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের চেয়ে প্রায় ৯০০ কোটি (৯ বিলিয়ন) ডলার কম। স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ১ লাখ থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। 

আইএমএফ বলেছে, রপ্তানি বাতিলের কারণে পরিশোধ না করা, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হলে পরিশোধে ব্যর্থ হওয়া এবং ইপিজেড থেকে স্থানীয় বাজারে পণ্য সরবরাহকে ভুল করে রপ্তানি পরিসংখ্যানে যাওয়ার কারণে রপ্তানি মূল্য এবং দেশে আসা অর্থের মধ্যে  পার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু দুটির মধ্যে এত বড় পার্থক্য অর্থ পাচারকে ইঙ্গিত করে। 

গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানও মনে করেন, এত বড় পার্থক্য থাকার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। এর একটি বড় অংশ অর্থ পাচারকে নির্দেশ করে। তার মতে, এটি ঠিক যে, একটি নির্দিষ্ট অর্থবছরে জাহাজীকরণ এবং  রপ্তানি প্রত্যাবাসনের তথ্য একই হবে না। কিন্তু কাছাকাছি থাকার কথা। এর কারণ, কোনো একটি অর্থবছর শুরু হওয়ার আগে পণ্য জাহাজীকরণ হলে পরের অর্থবছরে যেমন রপ্তানি আয় দেশে আসতে পারে, আবার অর্থবছরের শেষের দিকে জাহাজীকরণ হলে তার পরের অর্থবছরে আয় হিসেবে যোগ হতে পারে। ফলে একটি অর্থবছরে এ দুয়ের মধ্যে খুব বড় পার্থক্য হওয়া অস্বাভাবিক। 

তিনি বলেন, অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, নির্বাচনের আগে-পরে অর্থ পাচার বেড়ে যায়। এবার নির্বাচনের সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট যুক্ত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার দর কমতে থাকায় রপ্তানিকারকদের মধ্যে দেরিতে আয় প্রত্যাবাসনের প্রবণতা রয়েছে। 

উল্লেখ করা যেতে পারে, ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাণিজ্য সম্পর্কিত অবৈধ অর্থের প্রবাহ নিয়ে গবেষণা করে। তাদের সর্বশেষ প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী,  বাংলাদেশ থেকে বাণিজ্যের আড়ালে বছরে আনুমানিক ৫০ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। 


বিজিএমইএ সভাপতির বক্তব্য
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান মনে করেন, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) তথ্যে বিভ্রাটের কারণে রপ্তানি মূল্য এবং প্রত্যাবাসিত অর্থের মধ্যে পার্থক্য তৈরি হয়েছে। ইপিজেডের রপ্তানি তথ্য দুই জায়গায় প্রদর্শন হয়। প্রথমবার  ইপিজেডের কারখানা থেকে যখন সরাসরি রপ্তানি হয়, দ্বিতীয়বার অন্য রপ্তানিকারক কারখানার কাছে যখন কাঁচামাল বিক্রি করে তখনও একবার রপ্তানি হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এ দ্বৈততা এড়ানোর ব্যবস্থা করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলবেন তিনি। 

আইএমএফের প্রতিবেদন প্রসঙ্গে ফারুক হাসান বলেন, অনেকের মতো আইএমএফও রপ্তানির অর্থ দেশে কম আসছে বলছে। আসলে কত কম, কেন কম– সে ব্যাপারে প্রকৃত তথ্য এবং বক্তব্য কেউ দিচ্ছে না। ক্রেতার সঙ্গে চুক্তি হওয়ার পরও নানান কারণে রপ্তানি মূল্য কম দেওয়া কিংবা দেরিতে দেওয়ার ঘটনা অনেক পুরোনো। সুতরাং রপ্তানি মূল্য প্রত্যাবাসিত না হওয়া মানেই পাচার নয়।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button