Bangladesh

‘রাজনৈতিক গুরুত্বে’ বিচারে তাড়া

সামনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। রাজনীতি এখন অনেকাংশে আদালতকেন্দ্রিক। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার চলছে। সরকারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল বিএনপির শীর্ষ নেতাদের নামে মামলার বিচার শুরুর আদেশ আসছে আদালতের কর্মদিবসগুলোতে। দুর্নীতি, নাশকতার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিএনপির অনেক শীর্ষ নেতার সাজা হতে পারে।

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আইনে করা মামলার শিগগির নিষ্পত্তি হতে পারে। এ ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি আইনের মামলায় রায় হতে যাচ্ছে মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের দুই শীর্ষ ব্যক্তির। আগামী দুই মাস গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মামলা, শুনানি ও রায় নিয়ে গরম থাকবে আদালতপাড়া।

বিএনপির শীর্ষ আইনজীবীদের ভাষ্য, আগামী দুই মাস তাদের জন্য কঠিন সময়। সরকার আদালতকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক গুরুত্বের মামলার বিচারে তাড়াহুড়া করছে। নেতাদের সাজা হয়ে গেলে স্বল্পতম সময়ে এগুলোর বিষয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করা এবং আইনি ও সাংবিধানিক ব্যবস্থা গ্রহণ সময়সাপেক্ষ ও জটিল হবে।

সম্প্রতি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, তাকে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হতে পারে। অন্যদিকে দুদকের মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, মির্জা আব্বাসসহ আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে।

দুদকের মামলার পাশাপাশি বিএনপির আইনজীবীদের দুশ্চিন্তার কারণ নাশকতার মামলা। গত ১৫ বছরে হাজার হাজার নাশকতার মামলাকে বিএনপি নিছক রাজনৈতিক মামলা ভেবেছিল। নির্বাচনের আগে সম্প্রতি ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নাশকতার অনেক মামলায় বিচার শুরুর আদেশ হয়েছে। আইনজীবীদের তথ্যমতে, চলতি বছর তিন মহানগরেই অন্তত ১০টি নাশকতার মামলায় ৪০০ জনের বিরুদ্ধে বিচার শুরুর আদেশ হয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন আদালতে গত ২৩ আগস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাত্র আট কার্যদিবসে হত্যা, নাশকতার তিনটি পুরনো মামলায় ১২১ জনের বিরুদ্ধে বিচার শুরু ও সাক্ষ্যগ্রহণের আদেশ হয়।

নিষ্পত্তির দিকে যাচ্ছে ড. ইউনূসের মামলা : গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে নির্দিষ্ট ৫ শতাংশ লভ্যাংশ জমা না দেওয়ায় ও শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী না করায় গ্রামীণ টেলিকমের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ড. ইউনূসসহ প্রতিষ্ঠানটির আরও তিনজনের বিরুদ্ধে মামলাটি হয়েছিল ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে থাকা এ মামলাকে কেন্দ্র করে বিশে^র শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিক ও নোবেল বিজয়ীদের খোলা চিঠি, বাদীপক্ষের দুজন আইনজীবীর একজনের সরে দাঁড়ানো ও পরে ফিরে আসা, ড. ইউনূসের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষের একজন আইন কর্মকর্তার বক্তব্যের পর তার নিয়োগ বাতিল এবং বিচারের পক্ষে-বিপক্ষে বিবৃতি চলছে।

মামলাটিতে সাক্ষী চারজন। গত ২২ আগস্ট প্রথম সাক্ষীর সাক্ষ্য শুরু হওয়ার পর আজ (১৩ সেপ্টেম্বর) পরবর্তী সাক্ষ্যের দিন রয়েছে। যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে এ মামলা রায়ের পর্যায়ে আসবে। মামলার বাদী কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিচার আদালতের ইচ্ছায় ও আইনের নিজস্ব গতিতে চলবে।’ ড. ইউনূসের আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘সাধারণত একটা মামলায় এক মাস, দুই মাস পর তারিখ হয়। কিন্তু এ মামলায় তারিখ পড়ছে খুব দ্রুত। শিগগির মামলাটির নিষ্পত্তি হবে মনে হচ্ছে।’

অন্যদিকে শ্রম আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের ৫ শতাংশ শ্রমিকদের বুঝিয়ে না দেওয়ায় গত ২৮ আগস্ট তার বিরুদ্ধে ১৮টি মামলা হয়। আদালত ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে সমন জারি করেছে।

চাকরিচ্যুত শ্রমিকদের পাওনা আদায়ে তার বিরুদ্ধে ঢাকার শ্রম আদালতে আরও ৩০টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে বলে বাদীপক্ষের আইনজীবী মো. ইউসূফ আলী জানান।

রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশকেন্দ্রিক অভিযানে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগ ছিল নিবন্ধন হারানো বেসরকারি সংগঠন অধিকারের বিরুদ্ধে। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও পরিচালক এএসএম নাসির উদ্দিন এলানের রায় হবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘দেশের মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল আদালত। কিন্তু নির্বাচন ও রাজনীতিকে কেন্দ্র করে এ প্রতিষ্ঠানকেও সরকার ধ্বংস করে ফেলেছে। শুধু আমাদের নেতাকর্মী নয়, যারাই ভিন্নমত পোষণ করছে, সরকার তাদেরই আইনের আওতায় আনছে। আমাদের আশঙ্কা নির্বাচনের আগে অনেক নেতাকর্মীর সাজা হতে পারে। এমন সময়ে হবে যখন আপিল নিষ্পত্তির সময়ও পাওয়া যাবে না।’ তিনি বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতাদের চাপে রাখতেই এ বিচার।’

অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘তিনি (ড. ইউনূস) মামলা নিয়ে উচ্চ আদালতেও এসেছিলেন। অনেকেই বলেন, তার মামলাটি আগে চলছে। কিন্তু লেবার কোর্টে গিয়ে দেখুন কোনো মামলা পড়ে আছে কি না। সবার মামলা বাদ দিয়ে শুধু উনার মামলা চললে একটা কথা ছিল। অধিকারের দুজনের মামলা ৯ বছর আগের। হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ আপিল বিভাগে শেষ হয়েছে দুই বছর আগে। এরপরই সাক্ষ্য শুরু হয়েছে। বিএনপির আইনজীবীরা তাদের মামলায় উচ্চ আদালতে অসংখ্যবার সময় নিয়েছেন। শুনানি করেছেন। আদেশের পর তবেই মামলা চলছে। আসলে মামলা নিয়ে যা বলা হচ্ছে তা তথ্যভিত্তিক নয়। মামলার নিষ্পত্তি একটি চলমান প্রক্রিয়া।’

বিএনপির আইনজীবীদের উদ্বেগ নাশকতার মামলায় : চলতি বছরের শুরু থেকে বিএনপির শীর্ষ আইনজীবীদের তৎপরতা ছিল শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে দুদকের মামলার বিচার, রায়, সাজা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে। সম্প্রতি তাদের উদ্বেগ ও অস্বস্তির কারণ নাশকতার মামলার বিচার।

প্রায় ১১ বছর আগে রাজধানীর পল্টনে সিটি করপোরেশনের আবর্জনাবাহী গাড়ি ভাঙচুর ও হামলার ঘটনায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভীর বিচার শুরু করতে গত ৩ সেপ্টেম্বর আদেশ দেয় ঢাকার একটি আদালত। ২০ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে। এ মামলায় আসামির তালিকায় বিএনপির তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নীরবসহ আরও ছয়জন আসামি। দলীয় সূত্র ও আইনজীবীদের তথ্য অনুযায়ী, মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে ৯০টির বেশি মামলা রয়েছে যার প্রায় সবই নাশকতার অভিযোগে।

আট বছরের বেশি সময় আগে রাজধানীর মৎস্য ভবন মোড়ে পুলিশের গাড়িতে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপে কনস্টেবল শামীম হত্যা মামলায় বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলসহ সাতজনের বিচার শুরুর আদেশ হয় গত ৩১ আগস্ট। সাত বছরের বেশি সময় আগে এ মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হলেও মামলাটি আলোচনার বাইরে ছিল। আজ (১৩ সেপ্টেম্বর) এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর কথা। রিজভীর বিরুদ্ধে প্রায় পৌনে দুইশ (১৭৫) মামলা রয়েছে। সোহেলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে মামলা হয়েছে সাড়ে চারশর বেশি। এই প্রথম কোনো হত্যা মামলায় দুজনের বিচার শুরু হচ্ছে। রিজভী ও সোহেলের বিরুদ্ধে নাশকতার মামলাও সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে।

বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, ‘নির্বাচনের আগে এটা সরকারের কূটকৌশল বা পরিকল্পনা যাই বলি না কেন, কখনো দুদক, কখনো নাশকতার মামলায় বিএনপির নেতাকর্মীদের আদালতের মাধ্যমে সাজা দেওয়া হবে, যাতে তারা নির্বাচনে অযোগ্য হয়ে পড়েন। আমরা রাজনৈতিক ও আইনি দুভাবেই পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করব।’

ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতের প্রধান কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু বলেন, ‘রাজনীতি ও নির্বাচন দেখে বিএনপির নেতাদের মামলা তাড়াতাড়ি শেষ করা হবে, এটি ঠিক নয়। সাধারণ প্রসিডিংসে মামলার বিচার হচ্ছে। আমরা চাই দ্রুত মামলা শেষ করে মামলার জট কমাতে।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button