International

রাজা-মহারাজা আপ্যায়নে ‘ভিটেছাড়া’ গরিব

দিল্লির জনাকীর্ণ অন্ধকার রাস্তাগুলো এখন জ্বলজ্বল করছে স্ট্রিটলাইটের আলোয়। অথচ কিছুদিন আগেও ছিল গা ছমছমে আবছায়া। দেওয়ালে আঁকা হয়েছে রংবেরঙের চিত্র। তৈরি হয়েছে নানান ভাস্কর্য। ছোট ছোট বাহারি ফুলবাগানে হাসছে পুরো পথ। এক কথায় জম্পেশ আয়োজনে মেতে উঠেছে দিল্লি। কারণ দুদিন পরই শুরু জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন। ঝাঁকে ঝাঁকে নামবে ‘রাজা-মহারাজা’র দল।  আপ্যায়নের কোনো কমতি রাখছে না মোদি সরকার।

নয়াদিল্লিকে ঝলমলে করে তোলার আঙ্গিকে খরচ করছেন ১ হাজার কোটিরও বেশি রুপি। চারদিকের চোখ ঝলসানো চাকচিক্য দেখে বোঝার উপায় নেই কদিন আগের এই গলি-ঘুপচি, ফুটপাত, ফ্লাইওভারের নিচে যুগ যুগ ধরে সংসার সাজিয়েছিল অসহায় আশ্রয়হীনের দল। লাখ-কোটি মাইল দূরের মরা নক্ষত্র দেখে ফেলা নাসার সবচেয়ে বড় টেলিস্কোপেও চোখে পড়বে না তাদের ‘মায়াপুরীর ঠিকানা’। কে বলবে গরিবের ঘর ভেঙেই তৈরি হয়েছে এসব ‘প্রমোদ উদ্যান’। জি-২০ আয়োজনের আনন্দস্রোতে ফেনা হয়ে ভাসছে সহায়-সম্বলহীন দুস্থ-দিনমজুরদের হতবিহ্বল দীর্ঘশ্বাস। রাজা-মহারাজার আপ্যায়নে ভিটেছাড়া হয়ে গেছে ভারতের এমন লাখ লাখ ‘অচ্ছুত’। ভেতরে ভেতরে চাপা একটা গুঞ্জনও ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে-একদিকে ক্ষুধায় মরছে আশ্রয়হীন মানুষ, আরেকদিকে বিশাল অট্টালিকায় তৈরি হচ্ছে ৫০০ আইটেমের খাবারের থালা।

শহরের অনেক দরিদ্র বলছেন, কুকুর ও বানরদের মতো আমাদেরও সরিয়ে দিচ্ছে সরকার। দিল্লির সুশীল সমাজ বলছে, সম্মেলনের কাজ আগানোর সঙ্গে সঙ্গে বস্তি ও অনানুষ্ঠানিক বস্তিগুলো ভেঙে ফেলার ঘটনা তীব্রতর হয়েছে। জানুয়ারি থেকে শত শত বাড়িঘর ও রাস্তার পাশের স্টল ভেঙে ফেলা হয়। ফলে হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। বস্তি সুরক্ষা মঞ্চের আকবর আলী বলেন, জি-২০ ঘোষণার পর থেকে এমনভাবে উচ্ছেদ আমি আগে কখনো দেখিনি। কর্তৃপক্ষ বলেন, ধ্বংসগুলো অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে করা হয়। পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্ট (পিডব্লিউডি) দাখিল করে, এটি পূর্ব ও দক্ষিণ দিল্লির সরকারি জমিতে ২৬৭টি জায়গা বেদখল হিসাবে চিহ্নিত করে। কিন্তু মানবাধিকারকর্মীরা ও উচ্ছেদকৃতরা এই নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। অভিযোগ করে, এটি লাখ লাখ মানুষকে গৃহহীনতার দিকে ঠেলে দেয়। সম্মেলনের আয়োজনে মুম্বাই ও কলকাতার মতো ভারতীয় অন্যান্য শহরেও একইভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। বস্তি সুরক্ষা মঞ্চের (সেভ কলোনি ফোরাম) আবদুল শাকিল বলেন, সৌন্দর্যের নামে শহুরে দরিদ্রদের জীবন ধ্বংস করা হচ্ছে।

দিল্লির আশপাশেও জোরপূর্বক উচ্ছেদের পদক্ষেপ জোরদার হয় বছরের গোড়া থেকেই। জুলাই মাসে, মানবাধিকার গোষ্ঠী কনসার্নড সিটিজেনস কালেক্টিভের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সম্মেলনের প্রস্তুতির ফলে প্রায় ৩ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। অন্তত ২৫টি ঝোপঝাড় ও একাধিক আশ্রয়কেন্দ্র ধ্বংস করে পার্কে পরিণত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার সদ্য গৃহহীনদের জন্য বিকল্প আশ্রয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আলী বলেন, নয়াদিল্লির দক্ষিণ-পূর্ব জেলার তুঘলাকাবাদে গ্রাম উচ্ছেদের সময় পুলিশ ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল। যাতে কেউ ছবি তুলতে না পারে। সেখানে ২ হাজার থেকে ৩ হাজার বাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়। ভিটে ছাড়ার জন্য মাত্র দুই ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়। মেহরাউলি গ্রামেও একইভাবে চলে ধ্বংসের কাজ। ধারণা করা হয়, তুঘলাকাবাদ ও মেহরাউলির ধ্বংসযজ্ঞ জি-২০ সম্মেলনের পরিকল্পনার অংশ। বস্তি ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে জলের কলগুলোও ভেঙে দেওয়া হয়। তারপর ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যে উন্নয়নের কাজ শুরু করে দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, গৃহহীনদের রাস্তায় বসবাস করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

তবে বস্তি উৎখাত দেশটির নতুন কোনো কর্মকাণ্ড নয়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ অতীতেও বড় ইভেন্টের আগে গৃহহীন শিবির ও ঝোপঝাড় পরিষ্কার করার জন্য সমালোচিত হয়েছে। ২০২০ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সফরের আগে গুজরাট রাজ্যে ১ হাজার ৬৪০ ফুট ইটের প্রাচীর তৈরি করে। সমালোচকরা বলেন, এটি ২ হাজার জনেরও বেশি অধিবাসীর একটি বস্তি এলাকার গরিবানা হালকে অবরুদ্ধ করার জন্য নির্মিত হয়েছিল। নয়াদিল্লিতে ২০১০ সালের কমনওয়েলথ গেমসের সময়ও ধ্বংস করা হয় বেশ কিছু বস্তি।

দীনদুঃখী তাড়িয়ে দিল্লি এখন প্যারিস
বিশ্বমঞ্চে ভারতের মুখ উজ্জ্বল করতে দিল্লিকে অভিজাত পোশাকে সাজিয়েছে মোদি সরকার। গায়ে ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন তকমা লাগাতে শুধু সৌন্দর্যবর্ধনেই ১২০ মিলিয়ন ডলারের ‘সৌন্দর্যায়ন প্রকল্প’ হাতে নেয় দিল্লি। তারপর থেকেই মরিয়া হয়ে ওঠে ভাসমান খেটে খাওয়া মানুষ উচ্ছেদে। রাষ্ট্রের এই লোক দেখানো সৌন্দর্য শক্তির দাপটে বাস্তুচ্যুত হয় লাখ লাখ দীনদুঃখী। 

বিরিয়ানি বিক্রেতা মিস্টার মোহন সিং ভার্মা বলেন, জি-২০ সম্মেলনের জন্য রাস্তার বিক্রেতাদের তুলে দেওয়া হয়। ফলে চলতি বছরের জুলাই মাস থেকে তার জীবিকার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে। রাগে-ক্ষোভে-হতাশায় ভার্মা আরও বলেন, ‘পরিচ্ছন্নতার নামে গরিবদের সরিয়ে দিল্লিকে প্যারিসের মতো করে তুলতে চায় সরকার।’ রাস্তার পাশের আরেক বিক্রেতা শঙ্কর লাল বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ তাকে সরে যেতে বলার পর থেকে তিন মাস তিনি তার দোকান খুলতে পারেননি। সরকার জানে না আমরা ক্ষুধায় মারা যাচ্ছি।’ দিল্লির একটি ফ্লাইওভারের (বর্তমান) নিচে ১০০ বছর ধরে একই স্থানে বাস করছে রেখা দেবীর পরিবার। ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে পারেননি সে বাড়িটিও। কারণ প্রমাণ হিসাবে যে নথিগুলো দেখিয়েছিলেন তা অস্বীকার করেন সরকারি কর্মকর্তারা। রেখা বলেন, ‘গৃহহীনদের এখন রাস্তায়ও থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। সবাই অন্ধের মতো আচরণ করছে। জি-২০ ইভেন্টের নামে কৃষক, শ্রমিক ও দরিদ্ররা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’ মিস্টার কুমার যিনি প্রতি মাসে ২০ হাজার রুপি আয় করতেন। কিন্তু জুলাই মাস থেকে ৫ হাজার রুপিরও কম উপার্জন করছেন। কুমার বলেন, ‘আমরা আমাদের সঞ্চয় থেকে খাচ্ছি। জি-২০ আমাদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor