Bangladesh

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালক নিয়োগ: অনিয়মের দশ অভিযোগ থাকলে অযোগ্য

ঋণখেলাপিসহ ১০ অনিয়মের অভিযোগ থাকলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সরকারের শেয়ারভুক্ত বেসরকারি ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পর্ষদে চেয়ারম্যান ও পরিচালক হিসাবে নিয়োগ পাবেন না। এছাড়া প্রতিষ্ঠানে হিসাব-নিরীক্ষা ও আইনের বিষয়গুলো সুষ্ঠুভাবে নিষ্পন্ন করতে পর্ষদে কমপক্ষে একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেট (সিএ), অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ/ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং ব্যাংকার নিয়োগ দিতে হবে। তবে পর্ষদের চেয়ারম্যান বা পরিচালক হিসাবে নিয়োগের জন্য সরকারের কর্মরত কোনো সচিব ও সমগ্রেডভুক্ত কর্মকর্তা বিবেচিত হবেন না। 

এসব বিধান রেখে গত ৯ এপ্রিল প্রথমবারের মতো জারি করা হয় ‘রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের শেয়ার রয়েছে এমন বেসরকারি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে চেয়ারম্যান ও পরিচালক নিয়োগ নীতিমালা।’ সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এ তথ্য।

নতুন নীতিমালায় চেয়ারম্যান ও পরিচালক নিয়োগ দেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সচিবের নেতৃত্বে গঠিত চার সদস্যের বাছাই কমিটি। ওই কমিটি নিয়োগের আগে চেয়ারম্যানের ক্ষেত্রে অনুমোদন নিতে হবে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এবং পরিচালকের ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীর। তবে কমিটি নিয়োগ দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সার্বিক অবস্থা নিয়ে একটি বোর্ড প্রোফাইল প্রস্তুত করবে। 

রাষ্ট্রীয় খাতের ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে কারা নিয়োগ পাবেন-তা নিয়ে এতদিন কোনো নীতিমালা ছিল না। এই সুযোগে সব সরকারের সময়েই দলীয় লোক কিংবা পছন্দের পেশাজীবীদের সেখানে বসানো হয়েছে। ফলে বহুল আলোচিত হল-মার্ক, বিসমিল্লাহ ও অ্যাননটেক্স, মুন গ্রুপ, গোল্ড আনোয়ার এবং বেসিক ব্যাংকে বড় ধরনের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে। ব্যাংক খাত বিশ্লেষকদের অনেকে আলোচিত ব্যাংক কেলেঙ্কারির জন্য পর্ষদগুলোতে যুক্ত হওয়া প্রভাবশালী সদস্যদের দায়ী করেন। 

কারণ রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া এসব সদস্যের বেশিরভাগ ব্যক্তির উদ্দেশ্য থাকে কীভাবে নিজে লাভবান হবেন। এরপর রয়েছে অদক্ষতা। অর্থাৎ পর্ষদ সদস্য হওয়ার মতো ব্যাংকিং, মুদ্রানীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে তাদের জ্ঞানের ঘাটতি ছিল যথেষ্ট। যে কারণে ব্যাংকিং খাতে একের পর এক বিপর্যয় ঘটে। এর ফলে সাম্প্রতিক সময়ে সরকার তথা বাংলাদেশ ব্যাংক রেডজোনে থাকা বেশ কিছু ব্যাংককে উদ্ধার করতে একীভূত করার ফর্মুলা সামনে এনেছে। 

ইতোমধ্যে কয়েকটি দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হয়েছে। আরও কয়েকটি প্রক্রিয়াধীন আছে। তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ মনে করছে, এভাবে হয়তো সাময়িক কিছুটা উপশম হবে, তবে স্থায়ীভাবে এর সমাধান করার জন্য দরকার বাস্তবভিত্তিক কঠোর নীতিমালা। মূলত এমন চিন্তা থেকেই সরকারের নীতিনির্ধারক মহল উল্লেখিত নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। ফলে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ আরও কার্যকর, দক্ষ ও পেশাভিত্তিক হবে বলে তাদের প্রত্যাশা। 

জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মইনুল ইসলাম মঙ্গলবার জানান, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও পরিচালক নিয়োগের শর্ত দিয়ে ব্যাংকিং খাতের সমস্যা সমাধান করা যাবে না। কারণ যারা রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি তাদের ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচার নিশ্চিত করে টাকা আদায় করতে হবে। প্রয়োজনে ঋণখেলাপিদের জন্য পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যেতে পারে। সেটি করতে না পারলে এসব শর্ত দিয়ে দুর্নীতিপরায়ণ প্রভাবশালী মহলকে সঠিক পথে আনা যাবে না।

এদিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নীতিমালায় চেয়ারম্যান ও পরিচালক নিয়োগের অযোগ্যতা ও অনুপযুক্ততা হিসাবে ১০টি ক্ষেত্র তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের নাগরিক না হলে অথবা অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন বা কোনো রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য পোষণ করেন এমন ব্যক্তিকে পর্ষদের চেয়ারম্যান বা পরিচালক হিসাবে নিয়োগের যোগ্য হবেন না। এছাড়া ন্যূনতম ১০ বছরের প্রশাসনিক বা ব্যবস্থাপনা বা পেশাগত অভিজ্ঞতা না থাকলে এবং ফৌজদারি অপরাধ কিংবা জাল-জালিয়াতি, আর্থিক অপরাধ বা অন্য কোনো অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন বা থাকলে সেক্ষেত্রে চেয়ারম্যান বা পরিচালক হিসাবে নিয়োগের যোগ্যতা হারাবেন। 

এতে আরও বলা হয়, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নামে কোনো দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলায় আদালতের রায়ে কোনো বিরূপ পর্যবেক্ষণ বা মন্তব্য থাকলে, আর্থিক খাত সংশ্লিষ্ট কোনো নিয়ামক সংস্থার বিধিমালা, প্রবিধান বা নিয়মাচার লংঘনজনিত কারণে দণ্ডিত হলে এবং নিজের বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের হালনাগাদ কর পরিশোধের প্রমাণাদি দাখিলে ব্যর্থ হলে অযোগ্য হিসাবে বিবেচিত হবেন। সর্বশেষে বলা হয়, যদি কোনো উপযুক্ত আদালত কর্তৃক অপ্রকৃতিস্থ বা দেউলিয়া ঘোষিত হন এবং অন্য কোনো উপযুক্ত কারণে সরকার কর্তৃক যোগ্য বিবেচিত না হন সেক্ষেত্রে চেয়ারম্যান ও পরিচালক নিয়োগ হিসাবে উপযুক্ত হবেন না। 

নীতিমালায় আরও বলা হয়, যোগ্যতা থাকা সাপেক্ষে ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদে মোট পরিচালকের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ পদে নারীকে নিয়োগের বিবেচনা করা হবে। পাশাপাশি সরকারের বিবেচনায় অভিজ্ঞ ও প্রমাণিত দক্ষতাসম্পন্ন পেশাজীবী ব্যক্তিদের নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য পরিচালনা পর্ষদে অর্থনীতি, ব্যাংকিং, আর্থিক বাজার, মুদ্রানীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, করপোরেট সুশাসন, কোম্পানি আইন, পুঁজিবাজার, ব্যবসা শিক্ষা, ব্যবসা প্রশাসন, কৃষি, শিল্প, আইন, তথ্য, প্রযুক্তি বিষয়ে জ্ঞানসম্পন্ন পেশাজীবী নিয়োগ দিতে হবে। আর যিনি চেয়ারম্যান ও পরিচালক হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন তিনি ব্যাংকিং আইন, বিধিবিধান, নিয়মাচারসহ প্রাসঙ্গিক সব বিধিবিধান পরিচালন করতে হবে। 

নীতিমালায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালক নিয়োগে বাধা-নিষেধে উল্লেখ করে বলা হয়, কোনো ব্যক্তি কোনো ব্যাংক-কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা বিমা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হলে একই সময়ে তিনি অন্য কোনো ব্যাংক-কোম্পানির পরিচালক হিসাবে নিযুক্ত হতে পারবেন না। সংশ্লিষ্ট ব্যাংক-কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যদিও কেউ বেতনভুক্ত কর্মচারী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বহিঃহিসাব নিরীক্ষক, আইন উপদেষ্টা, উপদেষ্টা, পরামর্শক বা অন্য কোনো পদে নিয়োজিত আছেন বা গত পাঁচ বছরের মধ্যে ছিলেন তিনি চেয়ারম্যান বা পরিচালক হিসাবে নিয়োগ পাবেন না। এছাড়া অন্য কোনো ব্যাংক-কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা বা পরামর্শক হিসাবে থাকলেও অযোগ্য হিসাবে ধরা হবে।

নীতিমালায় আরও বলা হয়, ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী পর্ষদে প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে। পর্ষদের পরিচালকদের মেয়াদ হবে তিন বছর। তবে ধারাবাহিকভাবে তিন মেয়াদের বেশি থাকতে পারবেন না। মেয়াদ শেষে তিন বছর পার হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি পরিচালক পদে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য হবেন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button