Bangladesh

রোজার বাজারে আরও অস্বস্তি

কয়েক বছর ধরে পবিত্র রমজান মাসে অন্তত কম দামে পেঁয়াজ কিনতে পারতেন মানুষ। কারণ, রোজা শুরুর সময় পেঁয়াজের মৌসুম চলে। এবার সেই পেঁয়াজের দরও চড়া।

রোজা শুরুর আগের দিন গতকাল সোমবার রাজধানীর বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৯০ থেকে ১১০ টাকা। গত বছর রোজার আগে একই পেঁয়াজের কেজি ছিল ৪০ টাকার মধ্যে।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তালিকা ধরে মোটা চাল, খোলা আটা, সয়াবিন তেল (বোতল), চিনি, মসুর ডাল (বড় দানা), অ্যাংকর ডাল, ছোলা, পেঁয়াজ, দেশি রসুন, দেশি শুকনা মরিচ, রুই মাছ, ব্রয়লার মুরগি, গরুর মাংস, ডিম (হালি) ও খেজুর—এই ১৫ পণ্যের মূল্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত রোজার তুলনায় এবার ১০টি পণ্যের দাম বেশি; ৫টির কম।

যে পাঁচটি পণ্যের দাম কম, সেগুলোর মূল্য গত বছর অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তারপর কমেছে। তবে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নয়। ফলে সেগুলোর দামও চড়া বলা যায়।

যেমন ব্রয়লার মুরগি। ২০২২ সালের আগে ব্রয়লার মুরগি ছিল ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি। রোজা এলে দর কমত। কারণ, রোজায় রেস্তোরাঁগুলোতে মুরগির চাহিদা কমে যায়। এবার চিত্র ভিন্ন। দেশের বাজারে কয়েক মাস ধরে ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৯০ টাকার আশপাশে ছিল। এবার রোজায় দাম বেড়েছে। কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে গতকাল বাজারে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ২১০ থেকে ২২০ টাকায়।

রোজা শুরুর আগের কয়েক দিনে এবার দাম বেড়েছে মসুর ডাল, অ্যাংকর ডাল, মুগডাল, ছোলা, চিনি, সোনালি মুরগি, গরুর মাংস, বিভিন্ন ধরনের মাছ, বেগুনসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি, লেবু, শসা, ধনেপাতা ও ফলের দাম। কমেছে শুধু সয়াবিন তেলের দাম। সব মিলিয়ে বাজার চড়া।

রাজধানীর মিরপুর-৬ নম্বর সেকশন কাঁচাবাজার, পশ্চিম আগারগাঁওয়ের কাঁচাবাজার, মালিবাগ, মগবাজার, রামপুরা কাঁচাবাজার ও কারওয়ান বাজার ঘুরে গতকাল এই চিত্র দেখা গেছে। মিরপুর-৬ নম্বর সেকশন কাঁচাবাজারে গতকাল বেলা সোয়া তিনটার দিকে কেনাকাটা করছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী সোহেল রানা। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেটা কিনতে চাই, দেখি সেটার দামই বেড়েছে। এক হালি লেবু চায় ৮০ টাকা। ৪০ টাকার ক্ষীরা নাকি ৭০ টাকা।’ তিনি বলেন, রোজার শুরুতে দাম আরেক দফা বেড়েছে। মানুষের সংসারে চাপ বাড়ছেই।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ঘোষিত ইশতেহারে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। নতুন মন্ত্রিসভা দায়িত্ব নেওয়ার পর দাম কমাতে চারটি পণ্যের (চাল, চিনি, ভোজ্যতেল ও খেজুর) শুল্ককর কমানো হয়। এতে কমেছে শুধু সয়াবিন তেলের দাম, লিটারে ১০ টাকা। বাজারে অভিযান, হুঁশিয়ারি অন্য পণ্যের দাম কমাতে পারেনি। নির্ধারিত দর কার্যকর করতেও সফল হয়নি সরকারি সংস্থা।

যেমন রান্নায় ব্যবহৃত তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ১২ কেজির সিলিন্ডারের নির্ধারিত দর ১ হাজার ৪৮২ টাকা। যদিও রাজধানীতে তা বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৭০০ টাকার আশপাশে।

ইফতারের পণ্যের দাম

ইফতারে মানুষ সাধারণত ছোলা, বেগুনি, পেঁয়াজু, শসা ও কিছু ফল রাখেন। শরবত তৈরির জন্য লাগে লেবু।

দুই মাস আগেই ছোলার দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়েছিল। এখন বেড়েছে আরও ৫ টাকা। বাজারে ছোলা বিক্রি হচ্ছে ১১০-১১৫ টাকা কেজি। বেগুনি তৈরির বেগুনের দাম বেড়েছে গত দুই দিনে। লম্বা বেগুন ছিল মানভেদে ৬০ থেকে ৮০ টাকা কেজি। গতকাল তা ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হয়।

মৌসুমের এই সময়টায় ক্ষীরা থাকে। দামও কম থাকে। কয়েক দিন আগেও ক্ষীরা ৪০ টাকার আশপাশে ছিল। গতকাল তা ৬০-৭০ টাকা কেজি চান বিক্রেতারা। শসার দামও ৬০ থেকে বেড়ে ৮০ থেকে ৯০ টাকা কেজি হয়েছে। লেবুর দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। আকারভেদে প্রতি হালি বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৮০ টাকা।

শরবত তৈরিতে লাগে চিনি। বাজারে এক কেজি চিনি কিনতে এখন ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা লাগছে। এবার চিনির ওপর শুল্ক কমানো হয়েছিল। তাতে দাম কমার কথা কেজিতে এক টাকার মতো। কিন্তু দাম কমেনি; বরং বেড়েছে কেজিতে পাঁচ টাকা।

খেজুরের দাম কমাতে রোজার আগে সরকার শুল্কহার ১০ শতাংশ কমিয়ে দেয়। যদিও এখনো খেজুর আমদানিতে ১৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক, ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট), ৫ শতাংশ করে অগ্রিম আয়কর ও অগ্রিম কর এবং ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক রয়েছে। পাশাপাশি গত নভেম্বরে খেজুরের ট্যারিফ ভ্যালু (শুল্ক আরোপের সর্বনিম্ন দর) বাড়ানো হয়। সব মিলিয়ে বাজারে খেজুরের দাম এক টাকাও কমেনি; বরং বেড়েছে। টিসিবির হিসাবে, সাধারণ মানের খেজুরের সর্বনিম্ন দর এখন ২৮০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগেও ২৫০ টাকা ছিল।

ইফতারে অনেকেই খেজুরের পাশাপাশি মাল্টা, আপেল, পেয়ারা, আনারস, তরমুজ ইত্যাদি রাখার চেষ্টা করেন। ফলের দাম কেজিতে ২০ থেকে ৫০ টাকা বেড়েছে। যেমন এক কেজি মাল্টা ৩৫০ থেকে ৩৭০ টাকা চাইছেন বিক্রেতারা।

মাছ ও মাংস

স্বল্প আয়ের পরিবারেও সাহ্‌রিতে মাছ অথবা মাংসের কোনো পদ রাখার চেষ্টা থাকে। রোজার আগের দিন গতকাল মাছ কেজিতে ২০ থেকে ১০০ টাকা বেশি চাইছিলেন বিক্রেতারা। মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের কাঁচাবাজারে ছোট আকারের চাষের পাঙাশের দাম চাওয়া হচ্ছিল ১৮০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগেও ১৬০ টাকা কেজি ছিল।

চাষের বাইরে অন্যান্য মাছের দাম অত্যধিক বেশি। যেমন নদীর ছোট চিংড়ির কেজি ১ হাজার ২০০ টাকা। মাঝারি শোল মাছের কেজি চাওয়া হচ্ছিল ৮০০ টাকা। সোনালি মুরগির দাম ৩০ টাকা বেড়ে ৩৩০-৩৫০ টাকা এবং গরুর মাংস ৫০ টাকা বেড়ে ৭৫০, ৭৮০ ও ৮০০ টাকা কেজি বিক্রি করতে দেখা যায়।

বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম গতকাল রাজধানীর শান্তিনগর বাজার পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, টেলিভিশনে চেহারা দেখানোর জন্য তিনি বাজারে যাননি। গিয়েছেন সরবরাহ ব্যবস্থায় যুক্ত সবার সঙ্গে আলাপ করে শৃঙ্খলা ফেরাতে। তিনি বলেন, এখন কেউ চালের দাম ও ভোজ্যতেলের দাম নিয়ে কথা বলে না। কারণ, ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আছে। ভোজ্যতেলের দাম কমেছে। চেষ্টা করেও চিনির দাম অস্বাভাবিক বাড়ানো সম্ভব হয়নি।

অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চাল, ভোজ্যতেল ও চিনির মতো পণ্যগুলোর দাম আগে থেকেই চড়া। সেগুলোর দাম কমা দরকার। ২০২১ সালের শুরুতে চিনি ছিল ৬২-৬৫ টাকা কেজি। এর পর থেকে প্রতিবছর তা বাড়ছে। পণ্যটির ওপর সরকার উচ্চ হারে শুল্ক-কর আরোপ করে রেখেছে, কেজিতে যা দাঁড়ায় ৪০ টাকার বেশি। ওই সময় মোটা চালের কেজি ৩০-৩৫ টাকা ছিল। দাম যে বেড়েছে, তা আর কমছে না।

মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির আশঙ্কা

রোজায় বাজারদর বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এখন মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি। এটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও কমছে না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত মাস ফেব্রুয়ারি শেষে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছর যে পণ্য কিনতে ১০০ টাকা লাগত, তা কিনতে এবার ফেব্রুয়ারিতে লেগেছে প্রায় ১১০ টাকা। একই সময়ে মানুষের আয়ও বেড়েছে। অবশ্য সেটা মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম হারে (৭.৭৮ শতাংশ)।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির বড় কারণ ২০২২ সালের পর থেকে ডলারের ৪০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি। যখন দাম বাড়তে থাকে, তখন দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে মূল্যস্ফীতি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। বাংলাদেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে দেরি করেছে।

আহসান মনসুর বলেন, মূল্যস্ফীতির কষ্ট হলো, এতে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের প্রকৃত আয় কমে যায়।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d