Bangladesh

লক্ষাধিক মাদকের মামলা, আসামি দেড় লাখ

সারা দেশে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে এক লাখের বেশি মামলা হয়েছে। এতে দেড় লাখের বেশি ব্যবসায়ীকে আসামি করা হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) ও পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

ডিএনসি ও পুলিশের তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৩০ ধরনের মাদকদ্রব্য বেচাকেনা হয়।

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেচাকেনা হয় ইয়াবা। প্রতিদিন প্রায় ৭০ লাখ ইয়াবা বিক্রি করা হয়। রাজধানীতে বিক্রি হয় অন্তত ১৮ লাখ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যাওয়া, পারিবারিক বন্ধন ভেঙে যাওয়া, বিভিন্ন কারণে একঘেয়েমি ও মানসিক অবসাদে ভোগা—এসব কারণে হতাশা থেকে অনেকে মাদকের দিকে ঝুঁকছে।

এই সুযোগ নিচ্ছে মাদক ব্যবসায়ীরা।

ডিএনসি, পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের বার্ষিক সর্বশেষ যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ১০ মাসে দেশের বিভিন্ন থানায় এক লাখ ১০ হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। এতে এক লাখ  ৪৮ হাজারের বেশি আসামি। 

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা তালিকা অনুযায়ী, ওই সময়ের মধ্যে তিন কোটি ২৭ লাখ ৬২ হাজার ৪৪৫টি ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার করা অন্যান্য মাদকদ্রব্যের মধ্যে রয়েছে হেরোইন ৪৯২.৬৩৫ কেজি, কোকেন ৬.০৩৫ কেজি, আফিম ৮.৬৩ কেজি, ফেনসিডিল তিন লাখ ৭৪ হাজার ৬৫৩ বোতল, আইস ১৩৬.৩১ কেজি, ১৪৫টি এসএসডি ও এক লাখ ৩৪ হাজার ৬৯৮টি ড্রাগ অ্যাম্পুল।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মাসিক প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা দেশে গত ১০ মাসে অধিদপ্তর ৮৫ হাজার ৮৬৫টি অভিযান চালিয়েছে। মামলা করেছে ২৩ হাজার ৩৯২টি। এসব মামলায় আসামি ২৪ হাজার ৮৮৯ জন। ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে ৪৩ লাখ ৭২ হাজার ৭৩৯টি।

এ ব্যাপারে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সচেতনতামূলক প্রচার চালাচ্ছে।

৩০ ধরনের মাদকদ্রব্য আসছে ইয়াবা সবচেয়ে বেশি

ডিএনসি সূত্র বলেছে, দেশে প্রায় ৩০ ধরনের মাদকের বেচাকেনা হয়। এর মধ্যে ইয়াবা সবচেয়ে বেশি। প্রতিদিন প্রায় ৭০ লাখ ইয়াবা বড়ি বিক্রি করা হয়। এর মধ্যে রাজধানীতে বিক্রি হয় অন্তত ১৮ লাখ। প্রতিটি ইয়াবার দাম ৩০০ টাকা হলে ৭০ লাখ ইয়াবার দাম দাঁড়ায় ২১০ কোটি টাকা।

ডিএনসির এক জরিপে এসেছে, বর্তমানে তরুণদের মধ্যে মাদকসেবী বেশি। মাদক কেনাবেচার ৩০ শতাংশ অর্থ লেনদেন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হচ্ছে।

বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের মধ্যে গাঁজা, ইয়াবা, কোডিন সিরাপ (ফেনসিডিল), আইস,  হেরোইন ইত্যাদি বেশি বেচাকেনা হয়। সম্প্রতি ট্রাংক নামের নতুন একটি মাদকদ্রব্যের কথা উল্লেখ করে অধিদপ্তর বলেছে, এটি আমেরিকায় ঘোড়ার চেতনানাশক ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মাদকসেবীরা এটিকে নেশার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করছে। দেশে এর প্রবেশ রোধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর তৎপর বলে জানান এটির গোয়েন্দা পরিচালক তানভীর মমতাজ।

ডিএনসির রাজশাহী অঞ্চলের উপপরিচালক (গোয়েন্দা) মোহা. জিল্লুর রহমান বলেন, ডিএনসিতে এ বিষয়ে ১১ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। শুধু ট্রাংক নয়, মাংকি ডাস্ট নামে যুক্তরাজ্যে ছড়িয়ে পড়া একটি মাদকের বিষয়েও সতর্ক করা হয়েছে।

ডিএনসি সূত্র বলেছে, দেশের সীমান্তবর্তী ৩২ জেলার ৩৯৮টি স্থান দিয়ে বর্তমানে মাদক সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪৩টি স্থান চিহ্নিত হয়েছে দিনাজপুরে। এ ছাড়া ফেনীর ৩৮টি স্থান দিয়ে মাদকদ্রব্য বেশি আসছে। যশোর, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও ও খাগড়াছড়ির প্রতিটিতে ২০টির বেশি করে জায়গা রয়েছে।

৪০০ স্থানে প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা

‘আসেন ভাই, বাবা লাগব? বাবা নিলে ৬০০ টাকা, এক পোঁটলা ঝাঁজ (গাঁজা) নিলে ৭০, বিদেশি (হেরোইন) নিলে এক হাজার। যেইডা চান হেইডাই পাইবেন।’

গত বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজার রেলগেট এলাকায় কয়েক যুবক প্রকাশ্যে মাদকের দাম হাঁকছিলেন। প্রাইভেট কার ও অটোরিকশার দিকে ছুটে গিয়ে পলিথিনের ব্যাগ থেকে বিভিন্ন ধরনের মাদক বিক্রি করছিলেন তাঁরা।

শামসুল হক নামের স্থানীয় এক মাছ ব্যবসায়ী বলেন, ‘মাঝখানে পুলিশের টহলের কারণে এখানে মাদক ব্যবসা কমেছিল। চলমান রাজনৈতিক হট্টগোল, আগুন, নাশকতা নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। এই সুযোগে মাদক ব্যবসায়ীরা বেপরোয়া।’

রাজধানীর ধানমণ্ডি লেক, মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ, হাতিরঝিলের রামপুরা ব্রিজসংলগ্ন এলাকা, মিরপুরের পল্লবীর বিহারি ক্যাম্প এলাকাসহ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের আশপাশের এলাকা, কমলাপুর রেলস্টেশনসংলগ্ন এলাকা, পুরান ঢাকার লালবাগ, সূত্রাপুর ও বুড়িগঙ্গার আশপাশের অন্তত ২৭টি স্থান ঘুরে প্রকাশ্যে মাদক বিক্রির চিত্র দেখা যায়। তবে রাজধানীর ৫০টি থানার পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি এলাকায়ই একাধিক স্পট রয়েছে। পুলিশ গত এক বছরে ৩২১টি স্থান চিহ্নিত করেছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, অন্তত ৪০০টি স্থানে অনেকটা প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা চলছে। মোহাম্মদপুরের গজনবী রোড, বাবর রোড, শাহজাহান রোড, হুমায়ুন রোডে গিয়ে দেখা গেছে, চারটি রোডেই রয়েছে পুলিশের তল্লাশি চৌকি। তবে পুলিশ এখন অবরোধকারীদের নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত। আর এই সুযোগে মাঝখানের ক্যাম্পে দিনরাত চলছে মাদক বেচাকেনা।

ক্যাম্প সূত্রে জানা গেছে, অন্তত ৩০ জনের নিয়ন্ত্রণে মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে চলে মাদক ব্যবসা। তেজগাঁও রেল বস্তি, বনানীর কড়াইল বস্তি, সবুজবাগের ওহাব কলোনি, কামরাঙ্গীর চর, মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে অর্ধশতাধিক মাদক ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণে এসব বেচাকেনা চলে।

ডিএনসির তথ্য মতে, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন স্পটে সক্রিয় প্রায় সাড়ে চার হাজার মাদক ব্যবসায়ীকে তারা গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের তথ্য মতে, গত ৯ মাসে শুধু মাদক নিয়ে বিরোধে ৩৩ জন খুন হয়েছে।

জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, বর্তমানে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৮০ লাখের বেশি। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ বয়সে তরুণ। মোট মাদকাসক্তের মধ্যে ৪৮ শতাংশ শিক্ষিত। মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ আবার যৌন অপরাধী। জেলখানায় যত মানুষ আছে, এর বেশির ভাগ মাদক পাচারকারী কিংবা ব্যবসায়ী।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, মাদকদ্রব্য বরাবরই দেশের প্রধান সমস্যার একটি। মাদকের কারণে তরুণরা এখন বিপথে চলে যাচ্ছে। সীমান্ত দিয়ে আসা মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মাদকের গডফাদারদের গ্রেপ্তার করতে হবে। চিহ্নিত করতে হবে মাদকের অর্থায়নে জড়িত ব্যক্তিদের। মাদক নিয়ন্ত্রণে দেশের প্রচলিত আইনের সঠিক প্রয়োগ হলে এটি নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button