International

লোহিত সাগর নিয়ে কেন উদ্বেগ, বিশ্ববাণিজ্যের জন্য এটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ

লোহিত সাগরে বেশ কয়েকটি পণ্যবাহী জাহাজ হামলার শিকার হওয়ার পর বিশ্বের বড় বড় জাহাজ কোম্পানি ওই সমুদ্রপথে জাহাজ চলাচল আপাতত বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে। দিন দুয়েক আগে ঘোষণা এসেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজ কোম্পানি মেডিটেরেনিয়ান শিপিং কোম্পানির (এমএসসি) পক্ষ থেকে। তারা বলেছে, লোহিত সাগর থেকে জাহাজ সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

এ সপ্তাহের আরও আগের দিকে ফ্রেঞ্চ কোম্পানি সিএমএ সিজিএম একই রকম পদক্ষেপ নিয়েছিল। সিএমএর আগে লোহিত সাগরে জাহাজ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় ডেনমার্কের কোম্পানি মায়ের্স্ক ও জার্মান পরিবহন কোম্পানি হাপাগ–লয়েড। এই কোম্পানিগুলো সমুদ্রপথে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক জাহাজ পরিচালনা করে থাকে।
আর লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচল বন্ধ করার কথা সবশেষে ঘোষণা করেছে হংকংভিত্তিক কোম্পানি ওওসিএল।

ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা এসব হামলার কথা স্বীকার করেছে। ইরান–সমর্থিত এই সশস্ত্র গোষ্ঠীটির দাবি, ইসরায়েলে যাচ্ছে এমন জাহাজকে তারা লক্ষ্যবস্তু করছে। তবে অন্য দেশের জাহাজও হামলার শিকার হচ্ছে। ড্রোন এবং রকেটের মাধ্যমে করা এসব হামলায় বিদেশি মালিকানাধীন জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

গত ৭ অক্টোবরে ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে ১ হাজার ২০০ জনকে হত্যা ও ২৪০ জনকে জিম্মি করে ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাস। এরপর ইসরায়েল গাজায় হামলা চালিয়ে এখন পর্যন্ত ১৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। ইয়েমেনের হুতিরা হামাসের পক্ষে তাদের সমর্থন ঘোষণা করেছে এবং ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ইতিমধ্যে ড্রোন ও মিসাইল ছুড়েছে।

এমএসসি তাদের সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করে জানিয়েছে, লোহিত সাগর এলাকায় পরিস্থিতি ‘মারাত্মক’ হয়ে উঠেছে। শুক্রবারে এই কোম্পানির জাহাজ এমএসসি প্লাটিনাম থ্রি লোহিত সাগরে হামলার শিকার হয়। জাহাজের কর্মীদের কোনো ক্ষতি হয়নি, তবে জাহাজটি আর চালানো হচ্ছে না। এর পর থেকে এই কোম্পানির জাহাজগুলো আফ্রিকার সর্বদক্ষিণের উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে চলাচল করছে।

লোহিত সাগরে কেন এই সমস্যা

আরব উপদ্বীপ ও আফ্রিকার মধ্যে অবস্থিত লোহিত সাগর। এর একেবারে উত্তর দিকে সুয়েজ খাল, আর দক্ষিণে বাব আল–মান্দাব প্রণালি, যা সাগরটিতে গালফ অব এডেনের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। বাব আল–মান্দাব আরবি শব্দ, যার অর্থ অশ্রুর দুয়ার। এটি ইয়েমেনকে আফ্রিকার দুই দেশ জিবুতি ও ইরিত্রিয়া থেকে পৃথক করেছে।
প্রায় ২০ মাইল বা ৩২ কিলোমিটার চওড়া এই প্রণালিতে জাহাজ চালানো খুবই কঠিন। আরব দেশের রূপকথায় আছে, এক মারাত্মক ভূমিকম্পের ফলে এই প্রণালি তৈরি হয়ে আরব উপদ্বীপ ও আফ্রিকা পৃথক হয়ে পড়েছিল, আর এখানে ডুবে মৃত্যু হয়েছিল অসংখ্য মানুষের। সে কারণেই এটি অশ্রুর দুয়ার।

ভারত মহাসাগর থেকে ইউরোপে যেতে হলে সবচেয়ে সহজ ও কম খরচের পথ লোহিত সাগর পাড়ি দেওয়া। সুয়েজ খাল হয়ে জাহাজ অল্প সময়ে ভূমধ্যসাগরে পৌঁছাতে পারে। অর্থাৎ এশিয়া, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে পণ্য ইউরোপে পাঠাতে, অথবা ইউরোপ থেকে পণ্য এসব গন্তব্যে পাঠাতে এটাই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা পথ।

সত্যিকার অর্থে লোহিত সাগর বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ। প্রতিবছর অন্তত ১৭ হাজার জাহাজ এবং বিশ্ববাণিজ্যের ১০ শতাংশ এই পথে পরিচালিত হয়।
বিশ্বের বাণিজ্যিক জাহাজের ৮০ শতাংশকে প্রতিনিধিত্ব করে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব শিপিং। এই প্রতিষ্ঠানের একজন জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক জন স্টপার্ট বার্তা সংস্থা এপিকে বলেন, ইউরোপের জ্বালানির একটি বড় অংশই লোহিত সাগরের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়। একইভাবে শস্য ও পাম অয়েলের মতো খাদ্যপণ্য এবং বিপুল পরিমাণ শিল্পপণ্য জাহাজে করে এই পথে পরিবহন করা হয়।

ফলে বিশ্বের প্রধান পাঁচটি জাহাজ কোম্পানি লোহিত সাগরপথে জাহাজ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করার মানে হলো, বিশ্ববাণিজ্যের ওপর এর একটি বড় প্রভাব পড়বে। শিপিং খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ কারণে পরিবহন খরচ বাড়বে। কারণ, জাহাজগুলো পুরো আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে ইউরোপে গেলে সময় বেশি লাগবে এবং তাতে ভাড়াও বাড়বে। ফলে বাড়বে পণ্যের মূল্য।

সরবরাহ চেইনের ব্যবসার প্রতিনিধিত্ব করে চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব লজিস্টিক অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট। এই প্রতিষ্ঠানের স্যু টারপিলোস্কি বিবিসিকে বলেন, ‘এটা জাহাজ ও জাহাজের কর্মীর নিরাপত্তা এবং ইনস্যুরেন্স নীতির ব্যাপার। জাহাজের জন্য বিমা করা গেলেও প্রিমিয়াম হবে আকাশচুম্বী। সুতরাং পণ্যের মজুত, খরচ এবং পুরো সরবরাহব্যবস্থার ওপর এর বিশাল তাৎপর্য থাকবে।’

সুয়েজ খাল ও লোহিত সাগর পরিহার করে কোনো জাহাজ যদি এশিয়া থেকে ইউরোপ যায়, অথবা ইউরোপ থেকে এশিয়ায় আসে, তাহলে দুই সপ্তাহ অতিরিক্ত সময় লাগে। সে কারণে জনবল, জ্বালানি ও বিমার জন্য অতিরিক্ত খরচ শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের ঘাড়ে গিয়ে পড়বে।

কী করা হচ্ছে

হুতিদের হামলা ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র লোহিত সাগর অঞ্চলে একটি সম্প্রসারিত সুরক্ষা বাহিনী মোতায়েনের পরিকল্পনা করছে। এই বাহিনীতে আরও কয়েকটি আরব দেশ যোগ দেবে বলে জানানো হয়েছে। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন চলতি সপ্তাহে যখন মধ্যপ্রাচ্য সফর করবেন, তখন এই বাহিনী মোতায়েনের কথা ঘোষণা করা হবে।
এই বাহিনীকে আপাতত অপারেশন প্রসপারিটি গার্ডিয়ান হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। একটি বড় এলাকাজুড়ে এটি মোতায়েন করা হবে। বর্তমানে বাহরাইনে মোতায়েন টাস্ক ফোর্স ১৫৩–এর আদলে এটি পরিচালিত হবে। হুতিদের হামলা থেকে রক্ষা করা হবে এবং লোহিত সাগর অঞ্চল জাহাজ চলাচলের জন্য নিরাপদ, এমন প্রতিশ্রুতি বাণিজ্যিক জাহাজ কোম্পানিগুলোকে দেওয়া হবে।

হুতিদের পক্ষে লোহিত সাগর পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব না বলেই মনে করেন সামরিক বিশেষজ্ঞরা। এই গোষ্ঠীর আনুষ্ঠানিক কোনো যুদ্ধজাহাজ নেই, যার মাধ্যমে তারা সাগর ঘিরে ফেলতে পারে। এখন পর্যন্ত তারা মূলত গুলি ছুড়ে হামলা করেছে। একটি অভিযানে তারা হেলিকপ্টার ব্যবহার করেছে। অন্যদিকে মার্কিন, ফরাসি ও মিত্রদের যুদ্ধজাহাজ ওই এলাকায় টহল দিচ্ছে।

ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব শিপিংয়ের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক জন স্টপার্ট এপিকে বলেন, হুতিদের হামলাগুলো যদিও জাহাজ কোম্পানিগুলোকে বিচলিত করে তুলেছে, এরপরও মনে হয় না যে তারা লোহিত সাগরের জাহাজপথ পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে পারবে। তিনি আরও বলেন, ‘যদি তেমন কোনো আশঙ্কা তৈরিও হয়, তাহলে নৌবাহিনীগুলো আরও বেশি সক্রিয় হয়ে উঠবে।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button