Bangladesh

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন

ধর্মীয়-নৈতিক শিক্ষাবিবর্জিত শিক্ষাক্রম এবং প্রগতিশীলতার নামে উলঙ্গ-বেলেল্লাপনা অভিভাবকতুল্য শিক্ষকদের ঘৃণ্য অপরাধে শিক্ষক সমাজ কলঙ্কিত হচ্ছে: প্রফেসর ড. এ কে এম রেজাউল করিম বর্তমানে সমাজের প্রতিটি শ্রেণি পেশার মানুষের মধ্যে অধঃপতন : প্রফেসর ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নিলে বারবার এমন ঘটতো না : ডা. ফওজিয়া মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ওপর যৌন নিপীড়কদের মধ্যে ৯ শতাংশই শিক্ষক : প্রফেসর ড. আব্দুল আলীম বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে শিক্ষকদের নৈতিকতা না থাকলে কী শিক্ষা দেবে : প্রফেসর ড. সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ

বিজ্ঞজনেরা বলেন, ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে পবিত্র এবং নিরাপদ জায়গা। আর শিক্ষার্থীদের কাছে বাবা-মায়ের পরই শিক্ষকদের স্থান। সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্বিনীত, অনৈতিকতা, ছাত্রী নিপীড়নের মতো ঘটনা ঘটছে। এমনকি বাবার সমতুল্য শিক্ষকদের হাতে কন্যাতুল্য ছাত্রী লাঞ্ছিত-ধর্ষিত হচ্ছেন। আইন ও সালিস কেন্দ্রের এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত এক বছরে সারা দেশে অন্তত ১৪২ জন নারী শিক্ষার্থী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধর্মীয়-নৈতিক শিক্ষাবিবর্জিত সর্বোত্তম শিক্ষাক্রম এ জন্য দায়ী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মীয়-নৈতিক শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণেই জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করার প্রতিযোগিতা, জালিয়াতি-কালোবাজারির ছড়াছড়ি। তথাকথিত প্রগতিশীলতার নামে উলঙ্গপনা শিক্ষা শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের বেলেল্লাপনায় উৎসাহিত করছে, ঘৃণ্য অপরাধ ঘটছে। শিক্ষার্থীদের সত্যিকারার্থে আলোকিত মানুষ ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন ধর্মীয় শিক্ষা তথা নৈতিক শিক্ষা। সেটা না থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে একের পর এক অনৈতিক ঘটনা ঘটছে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. এ কে এম রেজাউল করিম বলেন, অভিভাবকতুল্য শিক্ষক সমাজের একটা অংশ এমন ঘৃণ্য অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে আর আমাদের পুরো শিক্ষক সমাজকে তারা কলঙ্কিত করছে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবে এ ধরনের অপরাধ থামছে না, বরং ক্রমান্বয়ে তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকেই এ ধরনের অপরাধ করেও উল্টো পুরস্কৃত হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অনারারি প্রফেসর ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, শুধু শিক্ষক না, বর্তমানে সমাজের প্রতিটি শ্রেণি পেশার মানুষের একটা অংশ এই অধঃপতনের শিকার হচ্ছে। যার বিরুদ্ধে আমি নালিশ করছি সে যদি কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতা কাঠামোর সাথে জড়িত থাকে তবে তার বিরুদ্ধে সাধারণত আমরা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারি না। ফলে সে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে।

শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষকরা থাকেন সর্বোচ্চ সম্মানের আসনে। তাদের পিতা-মাতার সমতুল্যই মনে করা হয়। তাই অভিভাবকরা শিক্ষকদের কাছে তাদের সন্তানদের পাঠিয়ে নিশ্চিতে থাকতে চান। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সেই শিক্ষকদের কারো কারো নীতিভ্রষ্ট কর্মকাণ্ডে শিক্ষকরাই যেন অভিভাকদের কাছে আতঙ্কের চরিত্রে পরিণত হয়েছেন। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়Ñ সবস্তরে প্রতিনিয়তই শিক্ষকদের বিরুদ্ধেই উঠছে ছাত্রীদের যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের অভিযোগ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর প্রমাণও মিলছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অভিযোগ যেগুলো সামনে আসে তা ঘটনার যৎসামান্যই। অনেকে হয়রানির শিকার হয়ে আত্মসম্মানের ভয়ে চুপ থাকেন। অনেকে চাপ, ভীতি, ক্ষমতার প্রভাবের কারণে মুখ খুলতে সাহস পান না। কারণ এসব ঘটনায় অভিযোগ করলেই অনেক ক্ষেত্রেই পুন: হয়রানির শিকার হন। সমাজবিজ্ঞানী ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বড় ধরনের কোনো আন্দোলন না হলে কোনো ঘটনারই বিচার পান না ভুক্তভোগীরা। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় প্রতিনিয়তই এসব ঘটনা ঘটছে।

গত এক বছরে সারা দেশে অন্তত ১৪২ জন নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে বলে জানিয়েছে আইন ও সালিস কেন্দ্র। নির্যাতিতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী শিক্ষার্থী রয়েছে বলেও জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিটি পর্যায়েই এমন ঘটনা ঘটছে বলেন, আইন ও সালিস কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল। বিচারহীনতার কারণেই এ ধরনের ঘটনা থামানো যাচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির সমাজের সামনে খুব নেই। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যে ক্রমেই নারীদের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠছে, একের পর এক যৌন নির্যাতনের ঘটনাই যেন সেটি জানান দিচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজে যৌন হয়রানি নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। যার সর্বশেষটি গত শুক্রবার। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সহপাঠীদের মাধ্যমে নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেন। এ ঘটনার জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও সহপাঠী রায়হান সিদ্দিকী আম্মানকে দায়ী করেন। যদিও ইতঃপূর্বে শ্রেণিকক্ষে সহপাঠীর দ্বারা নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসে লিখিতভাবে অভিযোগও জানিয়েছিলেন তিনি। তবে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। উল্টো তাকে ছাত্রত্ব হারানোর ভয়ভীতি দেখানো হয়।

অবন্তিকার মৃত্যুর পর সহকারী প্রক্টরের পদ থেকে দ্বীন ইসলামকে অব্যাহতি এবং শিক্ষক হিসেবে সাময়িক বরখাস্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষার্থী আম্মানকে করা হয়েছে সাময়িক বহিষ্কার। গত শনিবার রাতে তাদের দু’জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ এবং আত্মহত্যার ঘটনায় তাদের আংশিক সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ পেয়েছে।

ওই আন্দোলনে এসেই আরেকজন ছাত্রী অভিযোগ করেন যে, তার ডিপার্টমেন্টের একজন শিক্ষক তাকে বন্ধুত্বের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিন বছর আগে। তাতে তিনি রাজি না হওয়ায় এখন তাকে শুধু ফেল করানো হচ্ছে। ১০০ নাম্বারের পরীক্ষায় তিন নাম্বার দেয়া হচ্ছে। তার কথা, আমি এ ঘটনার প্রতিবাদ করেছি। অভিযোগ করেছি। কিন্তু কোনো বিচার পাইনি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর সাদেকা হালিম বলেন, দোষীদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনা হবে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী ঘটনায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হবে। এছাড়া এর আগে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনা আগামী সিন্ডিকেটে উত্থাপন করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মুসলিম বলেন, আমরা অবাক হচ্ছি এ জন্য যে, বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি যথাযথ ব্যবস্থা নিত, তাহলে হয়তো এ ধরনের ঘটনা ঘটত না। আমরা এ ঘটনায় অন্য জড়িতদেরও গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।

এর আগে ৩ মার্চ রাতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক ছাত্রী একই বিভাগের শিক্ষক সাজন সাহার বিরুদ্ধে ফেসবুকে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন। ৫ মার্চ ওই শিক্ষার্থী ভিসির কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগে বলা হয়, বিভাগীয় প্রধান রেজুয়ান আহমেদের কাছে অভিযোগ করা হলেও তিনি এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেননি। এমন অভিযোগের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে গত বৃহস্পতিবার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীকে যৌন হয়রানির ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষক সাজন সাহাকে স্থায়ী বরখাস্ত করা হয়েছে। যৌন হয়রানির অভিযোগ পাওয়ার পরও সাজন সাহার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান রেজুয়ান আহমেদকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. সৌমিত্র শেখর বলেন, যৌন হয়রানির এবং যৌন হয়রানির অভিযোগ করার পরও ব্যবস্থা না নেয়ার ঘটনায় পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি করা হয়। একটি কমিটির তদন্তের প্রতিবেদন প্রকাশ করার পর দু’জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সিন্ডিকেট সভায় এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রফেসর নাদির জুনায়েদকে যৌন হয়রানির অভিযোগে তিন মাসের বাধ্যতামূলক ছুটি দেয়া হয় গত ১২ ফেব্রুয়ারি। তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও দীর্ঘদিন ধরে মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ করেন তার বিভাগের এক নারী শিক্ষার্থী।

গত নভেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রফেসর নূরুল ইসলামের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তোলেন একই ইনস্টিটিউটের প্রথম বর্ষের এক নারী শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ এই প্রফেসর সব বর্ষেই এক-দুইজন নারী শিক্ষার্থীকে টার্গেট করেন। তবে পরীক্ষায় ফেল করে দেয়ার শঙ্কায় কেউ অভিযোগ করার সাহস পান না। ওই সময় অভিযুক্ত শিক্ষকের বিচার চেয়ে ভিসির বাসভবনের সামনে মানববন্ধন করেন ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীরা। মানববন্ধন শেষে ইনস্টিটিউট শিক্ষার্থীরা অভিযুক্ত শিক্ষকের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবিতে ভিসির কাছে একটি লিখিত আবেদন জমা দেন।

সেপ্টেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) প্রফেসর ওয়াসেল বিন সাদাত এর কাছে থিসিস জমা দিতে গিয়ে যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী। এ বিষয়ে তিনি ব্র্যাকের প্রক্টরের কাছে অভিযোগ দেন। অভিযুক্ত প্রফেসর ওয়াসেল বিন সাদাত ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কোর্সের এক্সটার্নাল হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত এক বছরে ২০টির মতো যৌন হয়রানির অভিযোগ পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

জানুয়ারিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) রসায়ন বিভাগের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে ভিসির কার্যালয়ে যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের অভিযোগ করেন একই বিভাগের ছাত্রী। অভিযোগকারী শিক্ষার্থী ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে ওই প্রফেষর তত্ত্বাবধানে থিসিস করছেন। ওই শিক্ষার্থী জানান, থিসিস শুরুর পর থেকে তিনি আমার সঙ্গে বিভিন্ন যৌন হয়রানিমূলক-যেমন; জোর করে হাত চেপে ধরা, শরীরের বিভিন্ন অংশে অতর্কিত ও জোরপূর্বক স্পর্শ করা, অসঙ্গত ও অনুপযুক্ত শব্দের ব্যবহার করেছেন। কেমিক্যাল আনাসহ আরও বিভিন্ন বাহানায় তিনি আমাকে তাঁর রুমে ডেকে নিয়ে জোরপূর্বক জাপটে ধরতেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রফেসর ড. আব্দুল আলীম উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি নিয়ে একটি গবেষণায় দেখতে পান বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়কদের মধ্যে ৯ শতাংশই শিক্ষক। তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০ ছাত্রীর ওপর ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ওই গবেষণাটি পরিচালনা করেন। গবেষণার শিরোনাম “স্ট্র্যাটেজিস ফর প্রিভেন্টিং মাসকুলিনিটি অ্যান্ড জেন্ডার বেজ্ড ভায়োলেন্স ইন হায়ার এডুকেশনাল ইনস্টিটিউশন ইন বাংলাদেশ: আ স্টাডি অব রাজশাহী ইউনিভার্সিটি”। গবেষণায় অংশ নেয়াদের দেয়া তথ্য মতে, ৫৬ শতাংশ যৌন নিপীড়কই ছাত্রীদের সহপাঠী। ২৪ শতাংশ তাদের চেয়ে ছোট বা বড়। ১১ শতাংশ বহিরাগত ও ৯ শতাংশ শিক্ষক। ১০ শতাংশ ছাত্রী জানান, নির্যাতনের ৩০ শতাংশ বাজে মন্তব্য ও ৬০ শতাংশ সাইবার হয়রানি। নিপীড়নের ঘটনায় মাত্র ১০ শতাংশ ছাত্রী অভিযোগ করেছেন। এর মধ্যে পাঁচ শতাংশ বিভাগের শিক্ষকদের কাছে এবং বাকি পাঁচ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযোগ সেলে। ৯০ শতাংশ জানান, ন্যায়বিচার না পাওয়া ও চরিত্র হননের ভয়ে তারা সেলে অভিযোগ করেননি।

প্রফেসর আব্দুল আলীম বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গবেষণাটি হলেও ওই সময়ে আমি আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাতে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা একই রকম। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা আরো খারাপ। আর গবেষণাটি গত বছরের। এর মধ্যে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে।

তিনি জানান, যারা যৌন নিপীড়ক তারা রাজনৈতিক বা অন্য কোনোভাবে প্রভাবশালী। তাদের রক্ষার জন্য রাজনৈতিক এবং প্রভাবশালীদের চাপ থাকে। ফলে অনেক ঘটনাই ধামাচাপা দেয়া হয়। অনেক ঘটনার বিচার হয় না।

শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, কলেজগুলোতেও ঘটছে একই ধরনের ঘটনা। গত মাসে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক মুরাদ হোসেনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা। প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে ওই শিক্ষককে দায়মুক্তি দিতে চাইলেও পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তাকে বরখাস্ত, গ্রেফতার এবং যৌন হয়রানির অভিযোগের প্রমাণও পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অভিযুক্ত ওই শিক্ষক দীর্ঘদিন ধরেই কোচিংয়ে পড়ানোর নামে ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করে আসছিলেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নারীদের জন্য ক্রমেই অনিরাপদ হয়ে উঠছে বলে জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মীরা।

শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠায় অভিভাবকদের অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন, লেখাপড়া শেখানোর জন্য এত টাকা-পয়সা খরচ করে যাদের কাছে আমরা সন্তানদের পাঠাচ্ছি, তারাই যদি এমন কাজ করে তাহলে আমরা কোথায় যাব? তারা এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান, যেন এরকম ঘটনা ভবিষ্যতে আর না ঘটে।

এর মধ্যে ২০১১ সালে পরিমল জয়ধর নামের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে ওঠা ছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগ সারা দেশেই আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। ভুক্তভোগী ছাত্রীর বাবা পরবর্তীতে মামলা করলে সে বছরই জয়ধরকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর ধর্ষণের দায়ে ২০১৫ সালে তাকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত। কিন্তু তারপরও প্রতিষ্ঠানটির পুরুষ শিক্ষকদের বিরুদ্ধ যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ওঠা বন্ধ হয়নি। গত বছরও বিদ্যালয়টির অপর একটি শাখার একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় পরবর্তীতে বরখাস্ত করা হলেও তাকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন অভিভাবকরা।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে খুলনা জেলার রূপসার শ্রীফলতলায় শিক্ষক নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ করা হয় থানায়। একই মাসে বরগুনার আমতলী পৌর শহরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক পুরুষ শিক্ষকের বিরুদ্ধে নারী সহকর্মীকে যৌন হয়রানি করেছেন বলে লিখিত অভিযোগ করা হয়। আত্মসম্মান বাঁচাতে আত্মহত্যার হুমকি দেন ওই শিক্ষিকা।

অক্টোবরে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার হাই স্কুলের শিক্ষক সৌরভ কুমারের বিরুদ্ধে ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে এলাকায় ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। গত ৭ মার্চ রামু সরকারি কলেজে জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ না করে ছাত্রীর সঙ্গে অনৈতিক কাজ করতে গিয়ে কক্সবাজার সৈকতের কবিতা চত্বরে ধরা পড়েন রামু সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক মোহাম্মদ হোছাইন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানি রোধে হাইকোর্ট ২০০৯ সালে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেল গঠনের নির্দেশ দেয়। ওই নির্দেশে অভিযোগ গ্রহণ ও ব্যবস্থা নেয়ার জন্য কমিটি গঠনের কথাও বলা হয়। কোনো অভিযোগ পেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেল কাজ করার কথা। তবে অনেক প্রতিষ্ঠানেই এখনো যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেল নেই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কমিটি থাকলেও তা ঠিকমতো কাজ করে না। কমিটির সদস্যরাই বিষয়টি ঠিকমতো বোঝেন না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্ট্যাডিজ বিভাগের প্রফেসর ড. সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ বলেন, প্রথমত যখন কোনো ঘটনা ঘটে তার দৃষ্টন্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। আরেকটি হলো এটা যাতে না ঘটে তার ব্যবস্থা নেয়া। এর কোনোটিই আমরা দেখি না। তিনি বলেন, এখানে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলছে। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকেন তারা রাজনৈতিকভাবে নিযুক্ত। আর যারা এ ধরনের কাজ করে তারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। ফলে এরা রেহাই পেয়ে যায়। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের শিক্ষকদের এই যদি নৈতিক মান হয় তাহলে আমরা কী শিক্ষা দেবো!

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
Situs Toto
Toto Gacor
bacan4d
bacansport login
slot gacor
pasaran togel resmi
bacan4d
toto togel
slot toto
Toto slot gacor
bacan4d
slotgacor
bacan4d rtp
bacan4d
bacan4d toto
Slot Casino
bacan4d toto
slot gacor
bacan4d
bacan4d
Slot Toto
bacan4d
bacan4d login
totoslotgacor
slot gacor
TOTO GACOR
bacan4d
bacan4d slot gacor
bacan4d login
Bacan4d
bacan4d
bacan4d bonus
Toto gacor
Toto gacor
slot gacor hari ini
bacan4d toto
bacan4d toto
bacan4d
bacan4d
bacan4d
toto slot
bacan4d
bacan4d link alternatif
slot gacor bett 200
situs toto
SITUS TOTO
toto 4d
Slot Toto
Slot Toto
Slot Toto
Situs toto
Slot toto
Slot Dana
Slot Dana
Judi Bola
Judi Bola
Slot Gacor
toto slot
bacan4d toto
bacan4d akun demo slot
bacantogel
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacantoto
bacan4d
Bacan4d Login
slot demo
Bacan4d Toto
toto gacor
Slot Gacor
Live Draw
Live Draw Hk
Slot Gacor
toto slot
Bacan4d slot gacor
toto macau
toto slot
Toto Gacor
slot dana
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
Slot Dp Pulsa
Bacan4d Login
toto slot
Bacansports/a>
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
slot gacor
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
slot demo
toto slot gacor
bacansports Slot toto toto slot Slot toto Slot dana Slot toto slot maxwin slot maxwin toto slot toto slot slot dana
Toto Bola
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
bacan4d
ts77casino
situs toto
slot pulsa
bacansports
situs toto
slot toto
situs toto
slot toto
situs toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansports
slot toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
situs toto
situs toto
xx1toto
toto slot
xx1toto
xx1toto
slot qriss
Slot Toto
slot dana
situs toto
slot toto
slot dana
Situs Toto Slot Gacor
xx1toto
xx1toto
bacan4d
xx1toto
xx1toto
toto slot
situs toto slot gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
situs toto
Slot Toto
Toto Slot
Slot Gacor
Slot Gacor
Slot Gacor
slot toto
Toto Slot
slot gacor
situs togel
Toto Slot
xx1toto
bacansport
bacan4d
toto slot
situs toto
slot gacor
Toto Slot
slot maxwin
slot demo
bacan4d toto slot
bacan4d toto slot
bacan4d slot
bacan4d slot
bacan4d slot
bacansports
bacansports
bacansports
bacan4d slot
bacan4d slot
bacan4d
slot gacor
pasaran togel resmi
situs toto
bacan4d login
pasaran togel
pasaran togel
situs toto
bacan4d
bacan4d gacor
bacan4d slot
bacan4d rtp
bacan4d rtp
bacan4d slot gacor
toto slot
situs toto
bacan4d
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bandar togel
toto gacor Toto Gacor bacan4d slot toto casino slot slot gacor bacantoto totogacorslot Toto gacor bacan4d login slotgacor bacan4d bacan4d toto Slot Gacor toto 4d bacan4d toto slot bacan4d slot gacor