সংকট সমাধানে সক্রিয় ও মানবিক ছিলেন উ থান্ট
মিয়ানমারের নাগরিক ও একজন আচারনিষ্ঠ বৌদ্ধ উ থান্ট ছিলেন জাতিসংঘের তৃতীয় মহাসচিব। ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ সালের শেষ দিন পর্যন্ত ১০ বছর ১ মাস তিনি সংস্থার মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন; অর্থাৎ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সংস্থার প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। আর সে কারণেই প্রশ্ন আসে, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রতিবেশী মিয়ানমারের এই নাগরিকের ভূমিকা নিয়ে। ১৯৭১ সালে বিশ্ব ছিল স্পষ্ট দুটি ভাগে বিভক্ত। চলছিল ঠান্ডা লড়াই। যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়ার পাল্টাপাল্টি অবস্থানে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছিল উত্তেজনা। অনেকটাই অচল ছিল জাতিসংঘ। এমন পরিস্থিতিতে কোনো পক্ষে অবস্থান নেওয়াটা উ থান্টের জন্য খুবই কঠিন ছিল। সংগত কারণেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে উ থান্ট কোনো পক্ষ নিতে পারেননি; বরং পেশাদারির সঙ্গে নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছেন। তবে বাংলাদেশের মানবিক সংকটে তিনি ছিলেন সোচ্চার। এমনকি অনেক সংকট সমাধানে ইতিবাচকভাবে সক্রিয় ও মানবিক ভূমিকা রেখেছেন; বিশেষ করে শরণার্থীসংকট ও বাংলাদেশের ভেতরে বাস্তুচ্যুত মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় তিনি সোচ্চার ছিলেন।
২৫ মার্চ কালরাতে ক্র্যাকডাউনের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মানবিক সংকট শুরু হলে এ সমস্যার সমাধানে এক অনানুষ্ঠানিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন উ থান্ট। ওই সময় মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা ছিলেন মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী টুংকু আবদুর রহমান। তিনি তখন ছিলেন ইসলামি দেশগুলোর আন্তর্জাতিক সংগঠন ওআইসির মহাসচিব। সংকট শুরুর পরপরই উ থান্ট একটি ব্যক্তিগত বার্তা পাঠিয়েছিলেন টুংকু আবদুর রহমানকে। তাতে তিনি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক সংলাপে সমস্যা সমাধানের অনুরোধ করেন। কিন্তু সেই উদ্যোগ এগোয়নি। উ থান্টের আবেদনে টুংকু আব্দুর রহমান যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাতে সায় দেয়নি পাকিস্তান, এমনকি ভারতও সমঝোতার বিরোধী ছিল।
রাজনৈতিক সমঝোতা না করতে পেরে উ থান্ট নজর দেন মানবিক সাহায্যের দিকে। ঢাকাসহ সারা দেশে ভয়াবহ হামলার এক সপ্তাহ পর ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল উ থান্ট ঘোষণা করেন, পাকিস্তান সরকার চাইলে তিনি পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মানুষের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তার আবেদন করতে পারেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জাতিসংঘকে নাক না গলাতে পরামর্শ দেয় ইয়াহিয়া খানের প্রশাসন। যদিও মে মাসের মাঝামাঝি পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়। গণহত্যা ও মানবিক বিপর্যয়ের প্রমাণ হাতে পাওয়ার পর প্রবল আন্তর্জাতিক চাপে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক সহায়তার বিষয়ে সম্মত হয়। ১৯ মে জাতিসংঘ মহাসচিব ভারতে অবস্থানরত পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনে আন্তর্জাতিক সহায়তা চেয়ে একটি আবেদন করেন।
যার পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত হয় ইস্ট পাকিস্তান রিলিফ অপারেশন (ইউএনপিআরও) নামের একটি সংস্থা। মানবিক সাহায্য হিসেবে এ সংস্থাটি ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকারকে খাদ্য ও কারিগরি সাহায্য দেয়। পরে দেখা যায়, পাকিস্তান সরকার এই খাদ্যসহায়তা নিজের মতো করে ব্যবহার করছে। আর জাতিসংঘের দেওয়া বিভিন্ন ধরনের যানবাহন ব্যবহার করছে সামরিক কাজে। এমন পরিস্থিতিতে ত্রাণকাজে ব্যবহারের জন্য দেওয়া ৫০টি অসামরিক যানবাহন পাকিস্তানের কাছ থেকে ফেরত নেয় জাতিসংঘ। ১৯৭১ সালের কুটিল কূটনীতিতে উ থান্ট কার পক্ষে ছিলেন? ভারত নাকি পাকিস্তান? জটিল সেই পরিস্থিতি বিবেচনায় এই প্রশ্নের উত্তর সহজ করে দেওয়া সম্ভব নয়; বরং বলা যায়, একাত্তরের ভূমিকার জন্য ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই উ থান্টের ওপর বিরক্ত ছিল।
২৫ মার্চের পর মানবিক সাহায্যের আবেদন করলে উ থান্টের ওপর ক্ষুব্ধ হয় পাকিস্তান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শারীরিক অবস্থার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলে তাতেও ক্ষুব্ধ হন ইয়াহিয়া খান। আর ভারতও উ থান্টের ওপর বিরক্ত হয় উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবর্তনে সীমান্ত বরাবর উদ্বাস্তু হাইকমিশনের প্রতিনিধি নিয়োগের প্রস্তাবে। ক্ষমতা হস্তান্তর না করে উদ্বাস্তুদের ফেরানোর এই উদ্যোগের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হোসেন আলীও। উ থান্টের এই প্রস্তাবের বিপরীতে ভারতের প্রস্তাব ছিল, সংকট সমাধানে দ্রুত পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
এরপর ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে আবার সক্রিয় হন উ থান্ট। সম্ভাব্য যুদ্ধ বন্ধ ও উত্তেজনা প্রশমনে কাশ্মীরের মতো পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতের সীমান্তে পর্যবেক্ষক নিয়োগের প্রস্তাব দেন তিনি। এর জন্য ভারত-পাকিস্তানকে চিঠিও লেখেন। যদিও এই প্রস্তাব সরাসরি নাচক করে দেন ইন্দিরা গান্ধী। তিনি বলেন, উ থান্টের প্রস্তাবে ভারত-পাকিস্তানকে একই চোখে দেখা হয়েছে; যা যুক্তিসংগত নয়। কারণ এই সংকট পাকিস্তানের তৈরি। যাতে মারাত্মকভাবে বিঘিœত হয়েছে ভারতের নিরাপত্তা। এই প্রস্তাবের পর উ থান্ট পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছেন বলেও অভিযোগ করেন ইন্দিরা গান্ধী। যদিও সীমান্তে পর্যবেক্ষক নিয়োগের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিল ইয়াহিয়া খানের পাকিস্তান।
১৯৭১ সালের সংকট ও জাতিসংঘের অভিজ্ঞতা নিয়ে উ থান্ট ‘ভিউ ফ্রম ইউএন’ নামে আত্মজীবনী লিখেছিলেন। বইটি সুপাঠ্য এবং খুবই তথ্যসমৃদ্ধ। তিনি লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশে যে নিষ্ঠুর হামলা চালিয়েছে এর নজির ইতিহাসে বিরল। তবে এই সংকটে ভারতের ভূমিকারও সমালোচনা করেছিলেন উ থান্ট। ‘ভিউ ফ্রম ইউএন’ বইয়ে নানা তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেছেন, ১৯৭১ সালের ঘটনাপ্রবাহকে ভারত-পাকিস্তান যেভাবেই ব্যাখ্যা করুক না কেন, এই ঘটনার বেদনাদায়ক শিকার ছিল জাতিসংঘ।