সংশোধিত শ্রম আইন শ্রমিকবান্ধব নয়
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সফররত প্রতিনিধিদলের কাছে বাংলাদেশের শ্রমিক নেতাদের একটি অংশ বলেছে যে, সংশোধিত শ্রম আইন শ্রমিকবান্ধব নয়। তাদের অভিযোগ, গত ২ নভেম্বর সংসদে পাস হওয়া বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) বিল-২০২৩ তাদের সঙ্গে যথাযথ পরামর্শ না করেই চূড়ান্ত করা হয়েছে। গতকাল বুধবার ঢাকায় ইইউ কার্যালয়ে তাদের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে বসেন শ্রমিক নেতারা। এরপর পররাষ্ট্র, বাণিজ্য এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সঙ্গে বৈঠকে বসে ইইউ প্রতিনিধিদল। সেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও নিবর্তনমূলক আটকের মতো বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকে শ্রমিকদের সংগঠন সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, ‘নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটির বিধান সুনির্দিষ্ট নয়, তাই কারখানা কর্তৃপক্ষ পুরনো রীতি অনুসরণ করতে পারে এবং শ্রমিকদের আবারও বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। ফলে কোনো কারখানায় শ্রমিকের সংখ্যা তিন হাজারের কম হলে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে ২০ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতি লাগবে। যেসব কারখানায় তিন হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করেন, সেখানে এর সীমা ১৫ শতাংশ।’ তার অভিযোগ, এ সংশোধনী চূড়ান্ত করার আগে ইউনিয়ন নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করা হয়নি।
ইউনিয়ন নেতারা অভিযোগ করেছেন, সংশোধিত আইনে পরিষেবা সুবিধাটি ভালোভাবে সুরক্ষিত নয়। যদি কোনো শ্রমিক টানা এক বছর তার কাজ চালিয়ে যেতে না পারেন, তবে সুবিধা হারানোর সম্ভাবনা আছে।
বাংলাদেশ অ্যাপারেল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি তৌহিদুর রহমান বলেন, ‘সংশোধিত আইনটি শ্রমিকবান্ধব না হওয়ায় ইইউর জেনারেলাইজড স্কিম অব প্রেফারেন্স প্লাস স্ট্যাটাস পাওয়া বাংলাদেশের পক্ষে কঠিন হবে।’
বাংলাদেশের শ্রম খাতের অগ্রগতি দেখতে ইইউ প্রতিনিধিদল গত রবিবার পাঁচ দিনের সফরে ঢাকায় আসে। ঢাকা সফরকালে তারা শ্রম আইন সংশোধন-পরবর্তী পরিস্থিতি, শিশুশ্রম বিলোপ ও শ্রমিকবিরোধী সব ধরনের সহিংসতা নিরসনসহ নানা বিষয়ে আলোচনা করছে।
এলডিসি বাণিজ্য সুবিধার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ২০২৯ সাল থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক জোটে জিএসপি প্লাস মর্যাদা পাওয়ার আশা করছে বাংলাদেশ। এর জন্য দেশটিকে মানবাধিকার, শ্রম অধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা ও সুশাসনÑ এ চার ক্ষেত্রে ৩২টি আন্তর্জাতিক কনভেনশন বাস্তবায়ন করতে হবে। জিএসপি প্লাস মর্যাদা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে শ্রম আইন সংশোধন করা হয়েছে।
সফররত ইইউ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিসের এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর পাওলা পাম্পালোনি। গতকাল শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর প্রতিনিধিদল বাণিজ্য, শ্রম ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করে।
এসব বৈঠকে বাংলাদেশের শ্রম আইন সংশোধনে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) সন্তুষ্ট কি না, তা জানতে চেয়েছে ইইউ প্রতিনিধিদল। এর পাশাপাশি তিন সচিবের সঙ্গে বৈঠকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা এবং নিবর্তনমূলক আটকের মতো বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে। প্রতিনিধিদলটি আশা করে, আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে।
পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘শ্রম খাতের অশান্ত অবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির প্রসঙ্গটি আলোচনায় এসেছে। ন্যূনতম মজুরি নিয়ে ওরা প্রশ্ন করেনি। আমরা তাদের কাছে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছি।’
তিনি জানান, আলোচনায় মানবাধিকারের কিছু কিছু বিষয় উঠে এসেছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা এবং নিবর্তনমূলক আটকের বিষয়ে ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ (ইউপিআর) বা সর্বজনীন নিয়মিত পর্যালোচনার আলোকে আলোচনা হয়েছে। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে তারা আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। তবে আশা করে যে, আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে।’
শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব এহছানে ইলাহী বলেন, ‘শ্রম খাতের উন্নয়নে গৃহীত জাতীয় কর্মপরিকল্পনার নয়টি লক্ষ্যের ৮০ শতাংশ আমরা পূর্ণ করেছি। সংশোধন নিয়ে তারা জানতে চেয়েছে। শ্রম আইন সংশোধন নিয়ে আইএলও সন্তুষ্ট কি না, জানতে চেয়েছিল ইইউ প্রতিনিধিদল। আমরা বলেছি, এ প্রক্রিয়ায় আমরা আইএলওর সঙ্গে যুক্ত আছি।’
বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘বাংলাদেশের রপ্তানির ৮৫ ভাগ আসে পোশাকশিল্প থেকে। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর আমাদের জন্য যদি জিএসপি প্লাস থাকে এবং একই সঙ্গে এ খাত যদি শুল্কমুক্ত সুবিধার বাইরে থাকে, তাহলে তো এটা অর্থহীন। তাই আমরা পোশাকশিল্প খাতকে যুক্ত করতে বলেছি। জিএসপি প্লাসের বাংলাদেশ এর মধ্যেই ৩২ সনদ সই করে বাস্তবায়নের নানা পর্যায়ে আছে। আমরা বলেছি, আমাদের পোশাকশিল্প খাতের সাফল্যকে শাস্তি দেওয়া যাবে না।’