International

সত্যিই কি পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনী?

এই মুহুর্তে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি অতিবাহিত করছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী গত তিন বছরে দেশের অনেক স্থানের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। বর্তমানে সামরিক বাহিনী এমন সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে পড়েছে, যা এর আগে মিয়ানমারের ইতিহাসে কখনও ঘটেনি। 

শুধু তা-ই নয়, সামরিক বাহিনীর মধ্যেও নজিরবিহীন আত্মসমর্পণের ঘটনা দেখা গেছে। সামরিক বাহিনীর নেতারা পরাজয় মানতে বাধ্য হয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক সরকার ক্ষমতা দখলের পর থেকেই উত্তেজনা চলতে থাকলেও এতোটা কোণঠাসা পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীকে এর আগে কখনও পড়তে হয়নি।

গেল বছরের অক্টোবরে জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে সামরিক টহল চৌকি, অস্ত্রাগার ও বেশ কিছু শহরের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে বিদ্রোহীদের হাতে। সবশেষ ঘুমধুম সীমান্তে বিদ্রোহীদের আক্রমণের মুখে মিয়ানমারের শতাধিক সীমান্তরক্ষী বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে, যাদের অনেকেই আহত।

শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রতিবেশী আরও দুটি দেশ চীন ও ভারতেও মিয়ানমারের সেনারা এর আগে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানা গেছে। এ ধরনের জয় বিদ্রোহী অন্য গোষ্ঠীগুলোকেও সামরিক বাহিনীর উপর আক্রমণে উৎসাহিত করেছে।

ভয়েস অব আমেরিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের বিরোধী সশস্ত্র দলে জাতিগত ২০টি গোষ্ঠীর এক লাখ ৩৫ হাজার সদস্য, ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট-এনইউজি এর আওতায় পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের ৬৫ হাজার সদস্য এবং সিভিল ডিসঅবিডিয়েন্ট মুভমেন্ট-এর অধীনে প্রায় দুই লাখের মতো কর্মী রয়েছে।

এনইউজি’র আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বিষয়ক উপমন্ত্রী ডেভিড গাম অং এর আগে ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেন, “স্বায়ত্ব শাসনের জন্য লড়ছে এমন কয়েকটি জাতিগত গোষ্ঠীর সাথে ২০২২ সালে জোট গঠন করেছে এনইউজি। এদের প্রায় দুই লাখ সেনার একটি বাহিনী রয়েছে, যা আরও বাড়তে থাকবে। এটি জেনারেল মিন অং লাইংয়ের বাহিনীকে মোকাবেলা করার জন্য যথেষ্ট।”

অন্যদিকে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীতে প্রায় চার লাখ সেনা রয়েছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ইন্সটিটিউট ফর পিস-এর তথ্যানুযায়ী, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীতে প্রায় দেড় লাখের মতো সেনা রয়েছে। এর মধ্যে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত বা ‘কমব্যাট রেডি’ ৭০ হাজার সেনাও অন্তর্ভুক্ত।

মিয়ানমারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে কাজ করা বিশেষজ্ঞদের একটি দল যারা ‘স্পেশাল অ্যাডভাইজরি কাউন্সিল ফর মিয়ানমার’ নামে পরিচিত, তাদের তথ্যানুযায়ী, দেশটির জান্তা সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে মাত্র ১৭ শতাংশ ভূখণ্ডের উপর। ২৩ শতাংশ ভূখণ্ড নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের দখলে রয়েছে ৫২ শতাংশের মতো ভূখণ্ড।

বিবিসির বার্মিজ সার্ভিসের সহকারী সম্পাদক আয় থু সান জানিয়েছেন, ২০২৩ সালের অক্টোবরে তিনটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর জোট থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের আলোচিত ‘অপারেশন ১০২৭’ শুরুর পর থেকে এখনও পর্যন্ত তারা দেশটির ৩০টি শহরের দখল নিয়েছে।

যে কারণে শক্তিশালী বিদ্রোহীরা

যুক্তরাষ্ট্রের ইন্সটিটিউট অব পিস তাদের মূল্যায়নে বলছে, মিয়ানমারে বর্তমানে কর্তৃত্ববাদ বিরোধী যে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে তা এখনও পর্যন্ত সফল বলেই মনে হচ্ছে। দেশটিতে এর আগের গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের তুলনায় বর্তমানে চলমান প্রতিরোধ আন্দোলন জাতীয় অভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছে এবং এটি বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে যারা জান্তা সরকারকে উৎখাতে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি।

সংস্থাটি বলছে, টানা দুই বছর ধরে ছোট ছোট সফলতা পাওয়ার পর এই আন্দোলন ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে সুসংগঠিতভাবে দেশজুড়ে সামরিক অভিযান পরিচালনা শুরু করেছে, যা এখন আসলেই জান্তা সরকারের শাসনকে হুমকির মুখে ফেলেছে।

গেল অক্টোবর থেকে এখনও পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি জান্তা সেনা নিহত হয়েছে বা আটক হয়েছে। এদের মধ্যে ১০ জন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রয়েছেন। প্রতিরোধ বাহিনী ৩০টির বেশি শহর দখলে নিয়েছে। সব মিলিয়ে অভ্যুত্থানের পর থেকে এখনও পর্যন্ত জান্তা সরকার ত্রিশ হাজারের মতো সেনা হারিয়েছে। যেখানে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীতে সেনার সংখ্যা মাত্র দেড় লাখ।

সামরিক বাহিনী প্রতিদিনই পরাজয়ের মুখে পড়ছে এবং তারা দখল হয়ে যাওয়া ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতেও ব্যর্থ হচ্ছে।  এমন অবস্থায় সামরিক বাহিনী দ্রুত জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হারাচ্ছে। বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্য করে বিমান হামলা ও অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনা সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে জনগণকে আরও বেশি উস্কে দেওয়া ছাড়া কোনও কাজে আসছে না।

গত তিন বছরে দেশটির ২৬ লাখ মানুষ শরণার্থীতে পরিণত হতে বাধ্য হয়েছে। দেশান্তরে থাকা মিয়ানমারের সাবেক রাজনীতিবিদদের সংগঠন অ্যাসিসট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন অব পলিটিক্যাল প্রিজনার্সের তথ্যানুযায়ী, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হাতে এখনও পর্যন্ত ৪৩০০ মানুষ নিহত হয়েছে।  গ্রেফতার করা হয়েছে ২৫ হাজার মানুষকে।  

অন্যদিকে সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, বিদ্রোহী বাহিনীর হাতে কমপক্ষে ছয় হাজার ৬০০ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে।

বিবিসি বার্মিজ সার্ভিসের সাংবাদিক আয় থু সান বলেন, এমন অবস্থায় সামরিক বাহিনীর অনেক সমর্থকের মধ্যেও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। সামরিক বাহিনী কিছু এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারানোর পরও যদি বর্তমান সমস্যার সমাধানে জান্তা কর্তৃপক্ষ নমনীয় হয়, তাহলে তারা সেনাপ্রধানকে সমর্থন দেবে বলে মনে হচ্ছে না।

মিয়ানমারে জাতিসংঘের বিশেষ দূতের উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদমাধ্যম ইরাবতি এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অভ্যুত্থানের পর বাজেটে সামরিক ব্যয় বাড়লেও গত বছরের অক্টোবরে শুরু হওয়া বিদ্রোহী গোষ্ঠীর আক্রমণের কারণে জান্তা সরকার কয়েক ডজন শহর, কয়েকশ টহল চৌকি, পুরো একটি অস্ত্রাগারের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।

গত ৩১ জানুয়ারি মিয়ানমারে পঞ্চম দফায় জরুরি অবস্থার মেয়াদ বাড়ানোর পর স্থানীয় বাসিন্দারা সেনাপ্রধানকে বার্মিজ ভাষায় ‘টো’ বা ‘নবায়ন’ নামে ডাকতে শুরু করেছে। কারণ মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী, দেশটিতে সাময়িকভাবে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা যায় এবং পরে সর্বোচ্চ দুই বার ছয় মাস করে মেয়াদ বাড়ানো যায়।

মিয়ানমার ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যালায়েন্স-এমএনডিএএ, আরাকান আর্মি এবং তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি যারা যৌথভাবে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স নামে পরিচিত, তারা জানুয়ারিতে উত্তরাঞ্চলের শান রাজ্য থেকে সামরিক বাহিনীকে বিতাড়িত করেছে। ধারণা করা হয়েছিল, এর পাল্টা অভিযান চালানো হবে। কিন্তু সেটি এখনও হয়নি।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে গেছে ভাবলে ভুল হবে।  মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যদি সিত্ত্বে বা নেপিদোতে বা রেঙ্গুনের আশেপাশে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধ হতো তাহলে আশঙ্কা করা যেতো যে তারা দুর্বল হয়ে গেছে।  কিন্তু সেটি দেখা যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, মিয়ানমার ন্যাশনাল ডিফেন্সের সাথে আরাকান আর্মির তেমন কোনও যোগসূত্র নাই। তাদের যোগসূত্র আছে কাচিন ইন্ডিপেনডেন্ট আর্মি, শান, তাং বা ওয়া আর্মির সাথে। এরা আবার ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের সাথে তেমনভাবে সংশ্লিষ্ট নয়।

বরং বর্তমানে নর্দান অ্যালায়েন্স বা ফ্রেন্ডশিপ অ্যালায়েন্স চীনের আশির্বাদপুষ্ট। এখানে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী আবার চীনের আশির্বাদপুষ্ট। বরং এটা চীনের একটি সুনিপুন কৌশল বলে মনে করেন তিনি। আরাকানে ভূ-রাজনৈতিক কৌশল ও ভূ-রাজনৈতিক অর্থনীতি বিষয়ক বিপুল স্বার্থ রয়েছে চীন ও ভারতের। সেটার উপর পারস্পরিক আঘাত হানার প্রচেষ্টা থেকে এই যুদ্ধ চলছে বলে তিনি মনে করেন।

মিয়ানমারের সাথে ভারতের ১৬৪৩ কিলোমিটার উন্মুক্ত সীমান্ত রয়েছে। একই সাথে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন ভারত সরকার মিয়ানমারের সাথে সই করা ছয় বছর মেয়াদি উন্মুক্ত চলাচল বিষয়ক একটি চুক্তিও বাতিল করার বিষয়ে ভাবছে। এই চুক্তির মাধ্যমে মিয়ানমার ও ভারতের বাসিন্দারা কোনও ভিসা ছাড়াই পরস্পরের সীমানার ১৬ কিলোমিটারের মধ্যে চলাচল করতে পারে।

চীনের সাথে জান্তা সরকারের সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়টিও আবার পুনর্বিবেচনার মুখে পড়েছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সামরিক জেনারেলদের প্রশ্রয়ে এবং চীনের নাগরিকদের টার্গেট করে পরিচালিত প্রতারণা চক্রকে উৎখাতের বিষয়ে জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী বিশেষ করে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সকে সমর্থন দিয়েছে বেইজিং।

যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর উপর গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য চাপ দিয়ে আসছে।

Show More

8 Comments

  1. Excellent pieces. Keep posting such kind of info on your blog.
    Im really impressed by your site.
    Hi there, You’ve performed a fantastic job. I will definitely digg it and in my view suggest to my friends.
    I’m sure they will be benefited from this site.

    my web page vpn explained

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor