সরকারের নানা পদক্ষেপেও বাগে নেই চালের বাজার
সারাদেশে অভিযান, কোটি টাকার বেশি জরিমানা, এর পর শুল্ক ছাড়ের ঘোষণা। সবশেষ ৩০ প্রতিষ্ঠানকে ৮৩ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি। এসব পদক্ষেপকে পাত্তাই দিচ্ছেন না অসাধু চাল ব্যবসায়ীরা। সরকারের এত আয়োজনেও বাগে আসেনি চালের বাজার। উল্টো লাফিয়ে বেড়েছে দাম। গেল এক সপ্তাহে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৩ থেকে ৪ টাকা। রমজানে বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের বাড়তি দরে এমনিতেই চিড়েচ্যাপ্টা মানুষ। নতুন করে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপদে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রেতারা।
দাম বাড়ানোর খেলায় যারা কলকাঠি নাড়ছেন, তারা দায় চাপাচ্ছেন একে অন্যের ঘাড়ে। খুচরা ও পাইকাররা দুষছেন মিলারদের। তারা বলছেন, রোজার সময় বাজারে চালের ক্রেতা থাকে কম। তাই দামও স্বাভাবিক থাকার কথা। তবে বাজারে সেই চিত্র নেই। তাদের দাবি, কোনো কারণ ছাড়াই মিলগেটে বস্তাপ্রতি চালের দর বেড়েছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা, যার প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে।
অন্যদিকে মিলারদের দাবি, ধান সংকট। এ জন্য তারা দায়ী করছেন মৌসুমি মজুতদারদের। তাদের ভাষ্য, কৃষকের কাছ থেকে কম দরে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ধান কিনে রেখেছেন। ফলে কৃষকের কাছে ধান নেই। মিলারা বাধ্য হচ্ছেন বেশি দামে মজুতদারের কাছ থেকে ধান কিনতে। ধানের দাম বেশি হওয়ায় মিল পর্যায়ে চালের কেজিতে ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকার মতো দর বেড়েছে।
মিলারদের কেউ কেউ জানান, মৌসুমি ব্যবসায়ীদের নিবন্ধন নেই। ফলে তাদের কাছে কী পরিমাণ ধান মজুত আছে, সরকারের কাছে সেই পরিসংখ্যানও নেই। এ জন্য সরকার সেসব মজুতদারকে আইনের আওতায় আনতে পারছে না। তা ছাড়া অটো মিলের কারণে হাসকিং মিলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে সরকারের মনোযোগ বাড়ানো দরকার।
চালের দামে এক লাফে ৩-৪ টাকা বাড়লেও সরকারের সংশ্লিষ্টদের দাবি, দাম বাড়েনি। বাজার পুরোপুরি স্বাভাবিক।
কেমন দরদাম
বাজারে সবচেয়ে বেশি বেচাকেনা হয় বিআর-২৮ ও পাইজাম জাতের চাল; যা মাঝারি আকারের চাল নামে পরিচিত। সোম ও মঙ্গলবার ঢাকার মগবাজার, সেগুনবাগিচা, তেজকুনিপাড়া, কারওয়ান বাজারসহ কয়েকটি খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মাঝারি চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৬ থেকে ৫৮ টাকা দরে এবং গুটি স্বর্ণা বা মোটা চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৪ টাকায়। আট-দশ দিন আগে এ দুই জাতের চালের দর ছিল যথাক্রমে ৫২ থেকে ৫৪ ও ৪৮ থেকে ৫২ টাকা। একই সময় চিকন বা মিনিকেট চালের কেজি ছিল ৬৮ থেকে ৭২ টাকা, ভোক্তাদের এখন কিনতে হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৬ টাকা দরে। সেই হিসাবে এ তিন জাতের চালের কেজিতে বেড়েছে ২ থেকে ৪ টাকা।
গতকাল মগবাজার থেকে ২০ কেজি আটাশ চাল কেনেন বেসরকারি চাকুরে আবদুল কাদের। তিনি বলেন, ‘আটাশ চাল এ মাসের শুরুতে কেজি কিনেছি ৫৪ টাকা। ২০ দিন পর একই চাল দামাদামি করে আজ নিতে হলো ৫৮ টাকা করে। ২০ কেজি চালেই বেশি গেল ৮০ টাকা।’ কারওয়ান বাজারের ক্রেতা রংমিস্ত্রি হামিদ মিয়া বলেন, ‘ডেইলি (দৈনিক) কামাই (আয়) করি ৭০০ টাকা। চারজনের সংসারে এ টাকা দিয়ে চাল কিনমু, না মাছ-তরকারি খামু।’
মগবাজারের ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও সাভার রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী মো. রাজীব বলেন, আট-দশ দিন আগে হঠাৎ চড়ে ওঠে বাজার। পাইকারিতে সব ধরনের চালের বস্তায় (৫০ কেজি) ১৫০ থেকে ২০০ টাকা বেড়েছে। অর্থাৎ কেজিতে বেড়েছে দেড় থেকে ২ টাকা। এবার বোরো ধান রোপণ করা হয়েছে দেরিতে। সে জন্য ধান আসতে কিছুটা সময় লাগবে। এ সুযোগে বেড়ে গেল দাম।
এ বছরের শুরু থেকে চালের দাম বাড়তে থাকে। এর পর শুরু হয় সরকারের নানা তৎপরতা। চার দিনের মধ্যে বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী মাঠেও নামেন কর্মকর্তারা। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১ জানুয়ারি থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে আড়ত, পাইকারি দোকান ও হাটবাজারে মোট ৩৪ হাজার ২৯২টি অভিযান চালানো হয়েছে। একই সঙ্গে চাল ও আটার মিল এবং অনির্ধারিত গুদামে ১৩ হাজার ৫৫৬টি অভিযান হয়েছে। সারাদেশে গত ২২ জানুয়ারি থেকে বিভিন্ন অভিযানে অবৈধ মজুতদারদের জরিমানার আওতায় আনা শুরু হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক মাসে অবৈধ মজুত, দাম বেশি রাখাসহ বিভিন্ন অনিয়মের দায়ে ব্যবসায়ীদের ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকার বেশি জরিমানা করা হয়। যদিও সম্প্রতি অভিযানে কিছুটা শিথিলতা দেখা গেছে। এ সুযোগে আবারও চালের বাজার চড়তে থাকে।
সরকারি হিসাবে কত বাড়ল
খোদ সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদন বলছে, গত বছরের এ সময়ের চেয়ে বাজারে এখন সব ধরনের চালের দর বেশি। সংস্থাটির তথ্য মতে, গত বছরের এ সময় চিকন চালের কেজি ৬০ থেকে ৭৫ টাকা, মাঝারি চাল ৫০ থেকে ৫৬ ও মোট চাল ৪৬ থেকে ৫০ টাকা ছিল। টিসিবির গত শুক্রবারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি চিকন চাল ৬৫ থেকে ৭৬, মাঝারি চাল ৫৪ থেকে ৫৬ ও মোটা চাল ৫০ থেকে ৫২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সে হিসাবে এ তিন ধরনের চাল কেজিতে গত বছরের চেয়ে যথাক্রমে ১ থেকে ৫, ও ২ থেকে ৪ টাকা বেশি। শতাংশের হিসাবে দেখা গেছে, এক বছরের ব্যবধানে মোটা চালে ৬ দশমিক ২৫, মাঝারি চালে ৩ দশমিক ৭৭ এবং চিকন চালের দর ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেড়েছে। তবে গত এক মাসের ব্যবধানে সরু চালে ৪ দশমিক ৪৪, মাঝারি চালের ৪ দশমিক ৭৬ ও মোট চালের ৪ দশমিক ০৮ শতাংশ দর বেড়েছে।
চালের বাজার স্বাভাবিক রাখতে সরকার গত ৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সিদ্ধ ও আতপ চালের ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সেই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ২৫ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতদিন প্রতি কেজি চাল আমদানিতে করভার ছিল ৩১ টাকা। শুল্ক কমানোর কারণে এখন তা কেজিতে কমবে সাড়ে ২৩ টাকা। এ সুবিধা পাওয়া যাবে আগামী ১৫ মে পর্যন্ত।
বাজার নিয়ন্ত্রণে আমদানির অনুমতি
৩০টি প্রতিষ্ঠানকে সিদ্ধ ও আতপ মিলিয়ে ৮৩ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এ চাল আমদানি করে আগামী ২৫ এপ্রিলের মধ্যে তা বাজারজাত করার শর্ত দেওয়া হয়েছে ব্যবসায়ীদের।
তবে শুল্ক ছাড় ও আমদানির অনুমতির উদ্যোগ কতটা কাজে আসবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আমদানিকারকরা বলছেন, বিশ্ববাজারে এখন চালের দর বেশি। বাংলাদেশ চাল বেশি আমদানি করে ভারত থেকে। কিন্তু নিজ দেশে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত আগস্টে সিদ্ধ চাল রপ্তানিতে ২০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে ভারত সরকার, যা আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও গত ২২ ফেব্রুয়ারি সেই মেয়াদ অনির্দিষ্টকালের জন্য বাড়ানো হয়।
তাই সরকার আমদানির অনুমতি দিলেও খুব বেশি কাজে দেবে না বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের এইচ আর খান পাঠান সাকি বলেন, শুল্ক কমানো এবং আমদানির অনুমতি দেওয়ায় বাজারে এর প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ ডলারের দাম বেশি থাকায় আমিদানি খরচও বেশি হবে।
এর আগের বছরগুলোতেও দেখা গেছে, আমদানির অনুমতি নিয়েও বিভিন্ন শর্তের কারণে অনেকেই আমদানি করেনি। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারি-বেসরকারিভাবে মোট চাল আমদানি হয়েছে ১০ লাখ ৫৫ হাজার টন। যদিও আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ১৯ লাখ টনের মতো।
কমেছে খাদ্যের মজুতও
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, খাদ্যের মজুতও কমেছে। এই অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এখন পর্যন্ত কোনো চাল আমদানি হয়নি। তবে তাদের কোষাগারে বর্তমানে প্রায় ১৪ লাখ ৪৭ হাজার টন খাদ্য মজুত রয়েছে। এর মধ্যে চাল ও ধান রয়েছে ৮ হাজার ৭৩ টন, বাকিটা চাল ও গম। গত বছরের এ সময় খাদ্যের মজুত ছিল প্রায় ২০ লাখ টন। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, দেশে দৈনিক চালের চাহিদা রয়েছে এক লাখ টনের।
মিলাররা বলছেন ধানের দাম বেশি
চালের দাম বাড়ার ব্যাপারে ঠাকুরগাঁওয়ের হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসেসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হাসান রাজু বলেন, সরকার কৃষকের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে চায়। অন্যদিকে মিলারদের বলা হয়, কম দামে চাল বিক্রি করতে হবে। তাহলে কৃষকের কাছ থেকে বেশি দামে ধান কিনে কম দামে চাল বিক্রি করা কীভাবে সম্ভব?
সরকারের অসহযোগিতার কারণে হাসকিং মিল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দাবি করে তিনি বলেন, সরকার একটা অটো মিল থেকে বছরে ১০০ টন চাল সংগ্রহ করলে বিপরীতে হাসকিং মিল থেকে সংগ্রহ করে মাত্র ১০ থেকে ১২ টন। কিন্তু অটো মিলে চাল যত পোলিশ করা হয় তত তার পুষ্টিগুণ হারিয়ে যায়।
তবে চালকল মালিক সমিতির নেতা এইচ আর খান পাঠান সাকি বলেন, আইন অনুযায়ী এখন মিলে ১৫ দিনের বেশি ধান-চাল মজুত রাখা যায় না। মিলে এখন ধান কম আছে। তবে ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে নতুন ধান উঠবে। তাতে বাজার স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
সচিবের দাবি, দাম বাড়েনি
এদিকে চালের দাম বাড়েনি বলে দাবি করেছেন খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন। তিনি বলেন, বাজার পুরোপুরি স্থিতিশীল আছে। তবে বাজারের দাম পর্যালোচনা, এমনকি টিসিবির তথ্যেও দাম বাড়ার প্রমাণ রয়েছে– এ কথা জানালে তিনি বলেন, আমার কাছে তথ্য আছে। বাজারে দাম বাড়ার বিষয়টি একেবারেই সঠিক নয়।