Bangladesh

সাদরে ডেকে এখন অনাদর

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ অধিকাংশ দল যখন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে অনীহা প্রকাশ করছিল, তখন অনেকটা আদর করেই অপেক্ষাকৃত ছোট ও নতুন দলগুলোকে নির্বাচনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সঙ্গে উৎসাহিত করা হয়েছিল স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। এদের নির্বাচনে আনতে ক্ষমতাসীনদের দৌড়ঝাঁপও ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু ভোট যতই ঘনিয়ে আসছে এসব দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতি অনাদর ক্রমেই বাড়ছে। নির্বাচন ঘিরে উৎসবমুখর পরিবেশের পরিবর্তে বিরাজ করছে হামলা-মামলাসহ নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের মতো নানান পরিস্থিতি। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ছোট দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সমান সুযোগ না দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভোটের মাঠে এমন চিত্র ভালো কিছু বয়ে আনবে না।

তথ্য বলছে, নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর পর গত এক সপ্তাহে ১৫ জেলায় অন্তত অর্ধশত সংঘাতের ঘটনায় দুজন নিহত ও শতাধিক নেতাকর্মী সমর্থক আহত হয়েছেন। ফেনী, ফরিদপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, যশোর, মৌলভীবাজার, মাদারীপুর, বগুড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, মুন্সীগঞ্জ, নওগাঁ, পাবনাসহ বেশ কয়েকটি জেলায় এসব সংঘাত হয়েছে। গত রবিবার পর্যন্ত গত ছয় দিনে শুধু দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত হয়েছে এমন হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা পাওয়া গেছে ৪৬টি। আর বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া গেছে প্রায় ৭২টি ঘটনা। দেখা গেছে, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ওপর নৌকার প্রার্থীরা হামলা চালিয়েছে ৩১টি স্থানে এবং ৪১টি হামলা হয়েছে বিরোধী দলের কর্মী ও সমর্থকদের ওপর।

একই সঙ্গে আচরণবিধিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন প্রার্থীরা এমন তথ্য মিলেছে। হামলা ছাড়াও তারা রাস্তা বন্ধ করে নির্বাচনী সভা-সমাবেশ, কোথাও সড়কের ওপরে নির্বাচনী অফিস, বৈদ্যুতিক খুঁটি ও দেয়ালে আঠা দিয়ে পোস্টার লাগিয়েছে, যা নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন। এসব অভিযোগে এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক প্রার্থীকে শোকজও দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কিছু প্রার্থীকে শোকজ করা হয়েছে একাধিকবার। তবে ভুক্তভোগী প্রার্থীদের প্রশ্ন ইসি কি শুধু শোকজেই থাকবে নাকি অ্যাকশনেও যাবে?

এবারের নির্বাচনে মোট ২৭টি রাজনৈতিক দলসহ স্বতন্ত্র মিলিয়ে ১ হাজার ৮৯৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে ৩৪৭ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী। স্বতন্ত্রের বেশিরভাগ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ইতিমধ্যে নির্বাচনে ডেকে আনা দলগুলোর অনেকই মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমূর আলম খন্দকার দেশ রূপান্তরকে বলেন, “সারা দেশে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থীরা ‘এমপি বাহিনী দ্বারা’ বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন, রাতের আঁধারে পোস্টার খুলে ফেলা হচ্ছে। বিচারিক তদন্ত কমিটির কাছে আমার আসন থেকেই তিনটি অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।” তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘নির্বাচন কমিশন কি শুধু শোকজ করবে নাকি অ্যাকশনেও যাবে। বিষয়টি আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। তারপর সংবাদ সম্মেলন করে আমরা জাতির সামনে সব তুলে ধরব।’ দলটির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সেলের প্রধান কালাম মাহমুদ জানান, রবিবার পর্যন্ত সারা দেশে তাদের দলের নেতাকর্মীদের ওপর ৩০টি হামলার ঘটনা ঘটেছে।

এর আগে গত ২২ ডিসেম্বর বিকেলে নিজ নির্বাচনী এলাকা রূপগঞ্জ উপজেলার পিতলগঞ্জে প্রচারণার সময় নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে প্রার্থী তৈমূর আরও বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আমি দেখি না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। যদি ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি প্রধানমন্ত্রী রক্ষা করতে পারবেন না।’

জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘আমি আমার নির্বাচনী এলাকায় কিশোরগঞ্জ-৩ (করিমগঞ্জ-তাড়াইল) গণসংযোগ করছি। সারা দেশে আমাদের প্রার্থী, সমর্থক, কর্মীদের বাধা দেওয়া, পোস্টার ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগ আমার কাছে এসেছে। এটা কতগুলো সেটা এখন বলতে পারছি না। দপ্তর বা নির্বাচন মনিটরিং সেল বলতে পারবে।’

জাতীয় পার্টির দপ্তর সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক খান বলেন, ‘সারা দেশ থেকেই আমরা প্রতিনিয়ত খবর পাচ্ছি আমাদের প্রার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে। বড় ধরনের ঘটনা ঘটেছে ১২টির মতো। এসব ঘটনায় তিনজন আহত হয়ে হাসপাতালে রয়েছেন।’

২১ ডিসেম্বর ঝালকাঠির রাজাপুর ডাকবাংলো মোড়ে ফাজিল মাদ্রাসা মাঠে উপজেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক নির্বাচনী সভায় বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ঝালকাঠি-১ আসনে (রাজাপুর-কাঠালিয়া) নৌকার প্রার্থী হওয়া মুহম্মদ শাহজাহান ওমর বলেছেন, ‘এবারকার নির্বাচন, কী নির্বাচন পাতছে, এটা তো কোনো নির্বাচন না।’

গত শুক্রবার টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার ইন্দারজানী এলাকায় পথসভায় টাঙ্গাইল-৮ (সখীপুর-বাসাইল) আসনে নিজের দল থেকে গামছা প্রতীকে প্রার্থী হয়েছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচনটা খুব একটা ভালো হইতেছে না। কেমন যেন একটা ঝিমানো ঝিমানো ভাব।’ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী অনুপম শাহজাহানকে উদ্দেশ্য করে তিনি আরও বলেন, ‘যদি নৌকা না পাইতা, তাহলে আমার সামনে খাড়ানো তো দূরের কথা, আমার সামনে শুইয়া থাকতেও পারতা না। তুমি নৌকার গরম দেখাইও না। নৌকার কিন্তু এখন গোড়া নাই, পাটাতন নাই, পানি নাই।’

দ্বাদশ নির্বাচনে প্রচারণা শুরুর পর নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে মাদারীপুর ও ময়মনসিংহে। মাদারীপুর-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক নিহত এসকেন্দার খাঁ মাদারীপুরের লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য। গত শনিবার মারা যাওয়া এসকেন্দ্রার কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমিনা বেগমের সমর্থক ছিলেন। তাহমিনা বেগম একাদশ সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য। নৌকার প্রার্থী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ। আর গত মঙ্গলবার ময়মনসিংহ-৪ আসনে রাত পৌনে ৯টার দিকে উপজেলার সিরতা কোনাপাড়া গ্রামে স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আমিনুল হকের নির্বাচনী প্রচারকেন্দ্র স্থাপন করা নিয়ে বিরোধের জেরে ভাই ও ভাতিজার মারধরে রফিকুল ইসলাম (৫২) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।

তথ্য পর্যালোচনায় আরও দেখা গেছে, রবিবার বগুড়া-৪ আসনে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে গিয়ে নৌকার সমর্থকদের হামলার শিকার হয়েছেন বাংলাদেশ কংগ্রেসের প্রার্থী আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলম। ২২ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ-২ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী আলমগীর সিকদার লোটনের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগ তুলেছেন তার প্রধান নির্বাচন সমন্বয়কারী জাহাঙ্গীর সিকদার জোটন। গত বুধবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান থেকে পদত্যাগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া ফিরোজুর রহমানের কাঁচি প্রতীকের পোস্টার ছিনিয়ে নেন পৌর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মঞ্জুর-ই-মাওলা। ময়মনসিংহ-৯ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে লিফলেট বিতরণ করায় নান্দাইলের গাঙাইল ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি সাদেক হোসেন ভূঁইয়াকে নৌকার সমর্থকরা বইঠা দিয়ে পিটিয়ে জখম করেছেন। চট্টগ্রাম-১৫ আসনের সাতকানিয়াতে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) এক চেয়ারম্যানের বাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। গত বুধবার রাতে উপজেলার পশ্চিম ঢেমশা ইউনিয়নের ইছামতী আলীনগর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। যশোর-৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ইয়াকুব আলীর গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় একাধিক ককটেলের বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। পোস্টার লাগানো নিয়ে ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামীম হক ও স্বতন্ত্র প্রার্থী এ. কে. আজাদের সমর্থকদের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে সদর উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের ওমেদিয়া বটতলা বাজারে।

তথ্যে দেখা যায়, নাটোর-৩ আসনে বুধবার রাতে উপজেলার ইটালী ইউনিয়নের সাতপুকুরিয়া বাজারে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জুনাইদ আহমেদ ও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিকুল ইসলামের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ১১ জন আহত হয়েছেন। শরীয়তপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য খালেদ শওকত আলী অভিযোগ করেছেন, তার সমর্থকদের প্রচারে বাধা দেওয়া হচ্ছে ও পোস্টার ছেঁড়া হচ্ছে। নেত্রকোনা-৩ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সমর্থকদের হামলার অভিযোগে করা মামলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পাবনা-১ আসনে প্রচারে নেমেই পদে পদে বাধার অভিযোগ তোলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ।

জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচনে ডেকে এনেছে সরকার। এখন আবার নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণায় বাধা দিচ্ছে। এই যে নির্বাচনী খেলা এবং এর শেষ পরিণতি কী বা সরকারের পরিকল্পনা কী, সেটা একমাত্র তারাই বলতে পারবে। তবে দেশে নির্বাচনের নামে যা হচ্ছে সেটি নির্বাচনের গ্রামারের মধ্যেই পড়ে না।’

জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, ‘জাকের পার্টি মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছে। আওয়ামী লীগের বাইরে অধিকাংশ স্বতন্ত্র প্রার্থী, তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, সুপ্রিম পার্টিসহ যারা সরকারের গৎবাঁধা নিয়মের মধ্যে থেকে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে তারাও নির্বাচন বয়কটের চিন্তা করছে। সেটি হলে ব্যালটে তাদের নাম ছাড়া এ নির্বাচন আওয়ামী লীগ, তাদের স্বতন্ত্র ও জাতীয় পার্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ হবে। এতে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নিয়ে সিরিয়াসলি প্রশ্নের মুখে পড়বে।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button