Bangladesh

স্বেচ্ছাসেবকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ!

আগে শুধু বর্ষা মৌসুমেই ডেঙ্গুজ¦রের প্রকোপ দেখা যেত। প্রধানত ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকত এই রোগ। তবে কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গুতে বছর জুড়ে সারা দেশের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। আক্রান্ত ও মৃত্যুতে আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে গত বছর। এমনকি আক্রান্তের দিক থেকে ঢাকাকে ছাড়িয়েছে ঢাকার বাইরের এলাকা।

এ তথ্যই বলে দেয় ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক এডিস মশা আশঙ্কাজনক হারে ছড়িয়ে পড়েছে জেলাগুলোতে। গ্রামাঞ্চলে স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে নিয়ন্ত্রণহীন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা করছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। পাশাপাশি মশকনিবারণী পরিদপ্তরকে শক্তিশালী করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

সিটি করপোরেশন, পৌরসভায় স্বল্পপরিসরে মশক নিয়ন্ত্রণ চালালেও ইউনিয়ন বা গ্রামপর্যায়ে মশক নিয়ন্ত্রণের কোনো কাজই হচ্ছে না। এজন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসেবকদের দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনার কথা ভাবা হচ্ছে।

এ ছাড়া ডেঙ্গু চিহ্নিত করার ক্ষেত্রেও বড় দুর্বলতা রয়েছে সরকারের। বৈধ প্রায় ১৫ হাজার হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার থাকলেও মাত্র ৮১টির তথ্য বিশ্লেষণ করা হচ্ছে, যা দেশের ডেঙ্গু আক্রান্তের বাস্তব চিত্র তুলে ধরছে না বলে অভিমত কীটতত্ত্ববিদদের।

তাদের অভিমত, ডেঙ্গুর প্রকোপের বাস্তব চিত্র পেতে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে। নইলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। সরকার এখন যে তথ্য সরবরাহ করছে, বাস্তবে আক্রান্তের হার তার চেয়েও অন্তত ২০ গুণ বেশি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী (এলজিআরডি) মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গত বছর স্থানীয় সরকার বিভাগ জনসচেতনতা সৃষ্টিতে টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন প্রচার করে ৪২ কোটি টাকা খরচ করেছে। এটা অব্যাহত রাখা হয়েছে।

তিনি বলেন, সিটি ও পৌরসভা এলাকায় মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সরকারের অন্যান্য সংস্থাকেও যার যার অবস্থান থেকে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজনন বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। সরকারের সংস্থাগুলো যার যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে।

ডেঙ্গু আক্রান্তের সঠিক হিসাব বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘এটা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিষয়। তাদের এ বিষয়ে বলা হয়েছে। তারা তাদের সক্ষমতা ও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কার্যক্রম পরিচালনা করবে।’

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ২৩ বছর ধরে ধাপে ধাপে সারা দেশে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটেছে। ডেঙ্গু মোকাবিলায় সরকার পর্যাপ্ত সময় পেলেও এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানভিত্তিক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। এখনো তথ্য সংগ্রহ, তথ্য পর্যালোচনা, ডেঙ্গু রোগী শনাক্তকরণ ও ডেঙ্গু প্রতিরোধের কার্যক্রমে মারাত্মক গলদ রয়েছে। যে কারণে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের নামে সরকার প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করলেও, তাতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

তথ্যানুসন্ধানে আরও জানা যায়, গত বছর সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ৩ লাখ ২১ হাজার ২৭৯ জন। এর মধ্যে ঢাকায় আক্রান্ত হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৮ জন। আর ঢাকার বাইরে আক্রান্ত হয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ২৭১ জন। একই সময় সারা দেশে ডেঙ্গুতে মারা গেছে ১ হাজার ৭০৫ জন। এর মধ্যে ঢাকায় মারা গেছে ৯৮০ এবং ঢাকার বাইরে মারা গেছে ৭২৫ জন।

গত বছরের বিভাগভিত্তিক আক্রান্ত ও মৃত্যু পর্যালোচনায় জানা গেছে, ঢাকায় (রাজধানী ছাড়া) আক্রান্ত হয়েছে ৫৯ হাজার ৯১৩, মারা গেছে ১৮৩ জন। ময়মনসিংহে আক্রান্ত ৮ হাজার ২৬৮ এবং মৃত্যু ১৬। চট্টগ্রামে আক্রান্ত ৪৪ হাজার ৪৩৫ ও মৃত্যু ১২৪। খুলনায় আক্রান্ত হয়েছে ৩৪ হাজার ৭১২ ও মৃত্যু ১২৫। রাজশাহীতে আক্রান্ত ১৯ হাজার ৪০৯ ও মৃত্যু ৬০। রংপুরে আক্রান্ত ৫ হাজার ৫৪০ ও মৃত্যু ১০। বরিশালে আক্রান্ত ৩৮ হাজার ৪৯, মৃত্যু ২০৬ এবং সিলেট বিভাগে আক্রান্ত হয়েছে ১ হাজার ৪৩৫ ও মৃত্যুবরণ করেছে ১ জন।

চলতি বছর ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত ৮৮৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে; এর মধ্যে ১৪ জন মারা গেছে। আক্রান্তদের ৩১০ জন ঢাকা সিটি এলাকার ও ৫৭৩ জন ঢাকার বাইরের। মৃতদের মধ্যে ঢাকা সিটিতে ৮ ও ঢাকা সিটির বাইরে ৬ জন। গত ২২ জানুয়ারিতে নতুন করে ৩০ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার ৪ ও ঢাকার বাইরের ২৬ জন। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশে নিবন্ধিত হাসপাতাল রয়েছে ৪ হাজার ৯৯৩টি এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে ৯ হাজার ৯৫৬টি। এর বাইরে নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় রয়েছে আরও প্রায় ৩৫ হাজার হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এগুলো অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। বিপুলসংখ্যক হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা পরীক্ষা করাচ্ছে ও চিকিৎসা নিচ্ছে। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সেখান থেকে মাত্র ৮১টি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ডেঙ্গু আক্রান্তের তথ্য সংগ্রহ করছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কত মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে, তার তথ্য সংগ্রহ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সরকার ৮১টি জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে। এখানে বাস্তবচিত্র উঠে আসার কোনো সুযোগ নেই। সব তথ্য পেতে হলে প্রথমে অনুমোদিত হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। পরে অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় থাকা হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।

বাস্তবচিত্র না পেলে মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হবে না জানিয়ে তারা বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের সঠিক চিত্র বের করে আনার কোনো আগ্রহ সরকারের নেই। বাস্তবচিত্র বের হয়ে এলে সরকারের ব্যর্থতাই প্রকাশ করবে, এমন আশঙ্কা থেকেই এক ধরনের অনীহা কাজ করে। তাই সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য গোপনের চেষ্টা করছে। এটা উল্টো সমস্যা বাড়াবে, এমন মন্তব্য করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে ডেঙ্গু প্রকট আকার ধারণ করবে।

জানতে চাইলে কীটতত্ত্ববিদ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি মেম্বার ড. জিএম সাইফুর রহমান বলেন, দেশে ১৯৬৪ সালে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। এরপর ২০০০ সালে তার বিস্তার ঘটে। এ সময় যেভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল, তা নেওয়া হয়নি। যার ফলে পরিস্থিতি বর্তমান পর্যায়ে এসেছে ডেঙ্গুর বিস্তার।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে ডেঙ্গুর বাস্তবচিত্র আসছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমানে সরকার যে হিসাব দিচ্ছে, তার চেয়েও অন্তত ২০ গুণ বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। সত্যিকার অর্থে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে সরকারকে ডেঙ্গু আক্রান্তের সঠিক হিসাব বের করতে হবে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পর্যাপ্ত জনবল ও ওষুধ রয়েছে তাদের। তবে কোনো কীটতত্ত্ববিদ নেই। শূন্যপদে নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। ডিএসসিসির স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, কিউলেক্স মশার মৌসুমে এর প্রাদুর্ভাব নেই। তবে বর্ষার ডেঙ্গু মাঘের শীতেও তাদের ভোগাচ্ছে।

ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, জলাশয় পরিষ্কার, নিয়মিতভাবে মশার ওষুধ ছিটানোর কাজ চলমান রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকা ধরে তৎপরতা চালাচ্ছে তারা। তবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসছে না। কী করলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসবে, সেটা তারা বুঝতে পারছে না।

এ প্রসঙ্গে কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে যা করা দরকার সেভাবে কাজ হচ্ছে না। কাজ চলছে ঢিমেতালে, এমন কার্যক্রমে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসবে না।

তিনি বলেন, বর্তমানে ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুতে বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। সিটি ও পৌরসভার বাইরে মশক নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই। এ অবস্থায় সরকারের প্রচেষ্টায় ডেঙ্গু কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে তা নিয়ে সরকারকে আরও ভাবতে হবে। আরও আন্তরিকভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d