International

হামাসের কত নেতাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল, ধ্বংস হয়েছে কত সুড়ঙ্গ

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের চলমান হামলার ছয় মাস পূর্ণ হলো রোববার। এ সময়ে ইসরায়েলের বোমা ও গোলার আঘাতে তছনছ হয়ে গেছে গাজার বহু স্থাপনা। নিহত হয়েছেন ৩৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি। খাবার–পানির সংকটে দেখা দিয়েছে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে—ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস নির্মূলের যে লক্ষ্য নিয়ে ইসরায়েল এ হামলা শুরু করেছিল, তা কতটা পূরণ হয়েছে?

গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলি ভূখণ্ডে ঢুকে হামলা চালায় গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাস। ওই হামলায় ইসরায়েলে নিহত হন ১ হাজার ১৩৯ জন। এ সময় আনুমানিক ২৪০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যান হামাস সদস্যরা। সেদিন থেকেই গাজায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল।

২০০৭ সাল থেকে গাজা নিয়ন্ত্রণ করছে হামাস। উপত্যকাটির নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ নানা বিষয় দেখভাল করে গোষ্ঠীটি। হামাসের অনেক শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা উপত্যাকটির বাইরে থাকেন। যেমন ইসমাইল হানিয়া। তবে সামরিক নেতাদের বেশির ভাগই থাকেন গাজায়। ইসরায়েলি বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, ৭ অক্টোবরের আগে গাজায় ৩০ হাজারের মতো হামাস সদস্য ছিলেন।

হামাসের কত নেতা নিহত হয়েছেন

গাজায় ইয়াহিয়া সিনওয়ারসহ হামাসের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা এখনো জীবিত আছেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা

গাজায় ইয়াহিয়া সিনওয়ারসহ হামাসের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা এখনো জীবিত আছেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরাফাইল

সম্প্রতি এক বিবৃতিতে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, গাজায় হামলা শুরু করার পর তারা হামাসের প্রায় ১৩ হাজার সদস্যকে হত্যা করেছে। তবে এই সংখ্যা কীভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, তা জানায়নি। নিহত হামাস নেতাদের নামের তালিকাও প্রকাশ করছে ইসরায়েল।

ইসরায়েলের হিসাবে গত অক্টোবর থেকে ওই তালিকায় যুক্ত হয়েছে হামাসের ১১৩ নেতার নাম। তাঁদের বেশির ভাগই নিহত হয়েছেন সংঘাত শুরুর প্রথম তিন মাসের মধ্যে। তবে চলতি বছরের শুরু থেকে মার্চ পর্যন্ত কোনো হামাস নেতা নিহত হওয়ার খবর প্রকাশ করেনি ইসরায়েল। সর্বশেষ গত ২৬ মার্চ তারা জানায়, হামাসের সামরিক শাখার উপপ্রধান মারওয়ান ঈসাকে হত্যা করা হয়েছে।

ইসরায়েলি বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, ৭ অক্টোবরের আগে গাজায় ৩০ হাজারের মতো হামাস সদস্য ছিলেন।

মারওয়ান ঈসাকে ইসরায়েলের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় থাকা একজন বলে ধারণা করা হয়। চলমান সংঘাত শুরুর পর থেকে ইসরায়েলের হামলায় নিহত হামাস নেতাদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ। ঈসাকে হত্যা করা হয়েছে—এমন বিশ্বাস যুক্তরাষ্ট্রেরও। তবে হামাসের পক্ষ থেকে তা এখনো নিশ্চিত করা হয়নি।

নিহত হামাস নেতাদের যে তালিকা ইসরায়েল প্রকাশ করে আসছে, তার সত্যতা পুরোপুরি যাচাই করা সম্ভব হয়নি বিবিসির পক্ষে। যেমন তালিকায় মুস্তফা থুরায়া নামের একজন রয়েছেন। তিনি গাজায় সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এ ছাড়া অনেক নাম একাধিকবার তালিকায় এসেছে। তাই তালিকা থেকে বেশ কিছু নাম বাদ দিয়েছে বিবিসি।

এ ছাড়া গত জানুয়ারিতে লেবালনের রাজধানী বৈরুতের কাছে এক বিস্ফোরণে নিহত হন হামাসের রাজনৈতিক নেতা সালেহ আল–আরোউরি। ওই বিস্ফোরণের পেছনে ইসরায়েলের হাত ছিল বলে ধারণা করা হয়। বিবিসির সঙ্গে কথা হওয়া বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, গাজায় ইয়াহিয়া সিনওয়ারসহ হামাসের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা এখনো জীবিত থাকতে পারেন।

হামাসের কত সুড়ঙ্গ ধ্বংস হয়েছে

৭ অক্টোবর হামলা শুরুর সময় ইসরায়েলের একটি প্রতিশ্রুতি ছিল—গাজায় হামাসের ব্যবহার করা সুড়ঙ্গের যে বিস্তৃত নেটওয়ার্ক রয়েছে, তা ধ্বংস করা হবে। হামাসের তথ্য অনুযায়ী, গাজায় তাদের সুড়ঙ্গের নেটওয়ার্ক ৫০০ কিলোমিটার। তবে এ তথ্যের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

গাজায় হামাসের কয়টি সুড়ঙ্গ ধ্বংস করা হয়েছে, তা ইসরায়েলি বাহিনীর কাছে জানতে চেয়েছিল বিবিসি। জবাবে তারা বলেছে, গাজায় সন্ত্রাসীদের অবকাঠামোগুলোর বড় একটি অংশ ধ্বংস করা হয়েছে।

গাজায় সন্ধান পাওয়া সুড়ঙ্গগুলোর তথ্য মাঝেমধ্যে প্রকাশ করে ইসরায়েলি বাহিনী। যেমন গত নভেম্বরে গাজা নগরীর আল–শিফা হাসপাতালের নিচে সন্ধান পাওয়া সুড়ঙ্গের নেটওয়ার্কের ভিডিও প্রকাশ করে তারা। ইসরায়েলের দাবি, ওই সুড়ঙ্গ হামাসের একটি কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হতো।

হামাসকে নির্মূলের যে লক্ষ্য নিয়ে ইসরায়েল হামলা শুরু করেছিল, তার পক্ষে দেশটির প্রায় সব মানুষ। তবে বিশ্লেষকদের অনেকের ধারণা, এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়।

গাজায় ইসরায়েল কতগুলো সুড়ঙ্গের সন্ধান পেয়েছে, সে সম্পর্কে একটি ধারণা নিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইসরায়েলি বাহিনীর এ–সংক্রান্ত বার্তাগুলো খতিয়ে দেখেছে বিবিসি। গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ২৬ মার্চ পর্যন্ত ওই বার্তাগুলো প্রকাশ করা হয়েছে।

বার্তাগুলোর ১৯৮টিতে ইসরায়েলি বাহিনী বলেছে, তারা কোনো সুড়ঙ্গ বা সুড়ঙ্গমুখের সন্ধান পেয়েছে। বাকি ১৪১টি বার্তায় হামাসের সুড়ঙ্গ ধ্বংসের দাবি করা হয়েছে। এসব বার্তায় সুড়ঙ্গের অবস্থান বা অন্যান্য তথ্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হয়নি। বার্তাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৪০০টির বেশি সুড়ঙ্গমুখে হামলা চালানোর কথা বলেছে ইসরায়েল।

তবে সুড়ঙ্গ ধ্বংসের সঙ্গে সুড়ঙ্গমুখ ধ্বংসকে মিলালে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে বলে মনে করেন ইসরায়েলের রেইকম্যান ইউনিভার্সিটির বিশেষজ্ঞ ড্যাফনি রিচমন্ড বারাক। তিনি বলেন, কোনো সুড়ঙ্গের মুখ ধ্বংস করার পরও সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কটি অক্ষত থাকে। এই যুদ্ধে গাজার সব সুড়ঙ্গ ধ্বংস হয়েছে বলে মনে হয় না।

হামাস নির্মূল সম্ভব নয়

ইসরায়েলের হামলায় ধ্বংস হয়েছে গাজার বেশির ভাগ ঘরবাড়ি

ইসরায়েলের হামলায় ধ্বংস হয়েছে গাজার বেশির ভাগ ঘরবাড়িফাইল

হামাসকে নির্মূলের যে লক্ষ্য নিয়ে ইসরায়েল হামলা শুরু করেছিল, তার পক্ষে দেশটির প্রায় সব মানুষ। তবে বিশ্লেষকদের অনেকের ধারণা, এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। এ বিষয়ে জেরুজালেমভিত্তিক বিশেষজ্ঞ ও লেখক নাথান থরাল বলেন, ইসরায়েল হামাসকে নির্মূল করতে পারবে না। কারণ, পশ্চিম তীর ও গাজায় ফিলিস্তিনি সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পড়েছে সংগঠনটি। বিগত মাসগুলোয় হামাসের জনপ্রিয়তা আরও বেড়েছে।

৭ অক্টোবর গাজাজুড়ে বোমাবর্ষণ শুরুর পর ওই মাসের শেষের দিকে উপত্যকাটির উত্তরাঞ্চলে স্থল অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। পরে দক্ষিণেও স্থল অভিযান চালানো হয়। ইসরায়েলের দাবি, এসব অঞ্চলে হামাসকে পরাজিত করেছে তারা। এখন ইসরায়েলের লক্ষ্য, সর্ব দক্ষিণে মিসর সীমান্তের রাফা এলাকা। হামলার মুখে গাজার ২৪ লাখ বাসিন্দার বেশির ভাগই আশ্রয় নিয়েছেন সেখানে।

নাথান থরাল বলেন, ‘উত্তরে হামাসকে পরাজিত করা হয়েছে—ইসরায়েলের এমন দাবির পর থেকে আপনি দেখতে পাবেন, প্রতি সপ্তাহেই সেখানে ইসরায়েলি সেনারা মারা যাচ্ছেন। ইসরায়েল রাফায় হামলা চালাক বা না চালাক, এটা পরিষ্কার যে যুদ্ধের পরও হামাস থেকে যাবে। এর অর্থ সংঘাত থেকে বের হওয়ার কার্যকর কোনো পথ খোলা নেই ইসরায়েলি নেতাদের সামনে।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button