Bangladesh

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট: বিরোধী দল, সমালোচক, অধিকারকর্মীদের অক্ষম করে দেয়ায় অবাধ নির্বাচন অসম্ভব

যখন সরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে গলা টিপে ধরে এবং খেয়ালখুশিমতো  গ্রেপ্তার, জোরপূর্বক গুম, হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমিকভাবে বিরোধী দল, সমালোচক এবং অধিকারকর্মীদের অক্ষম করে দেয়, তখন একটি অবাধ নির্বাচন অসম্ভব। এ কথা বলেছেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার। তিনি আরও বলেন, সহিংসতা ও সমালোচকদের জেলে পাঠানোর পরিবর্তে সরকারের উচিত অবিলম্বে রাজনৈতিক গ্রেপ্তার বন্ধের আহ্বান জানানো। একই সঙ্গে এটা পরিষ্কার করতে হবে যে, জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন এবং নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের হাতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সহ্য করা হবে না।

এ বিষয়ে রোববার নিজস্ব ওয়েবসাইটে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এতে বলা হয়, অবিলম্বে রাজনৈতিক এবং বেআইনি গ্রেপ্তার বন্ধ করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি। ৭ই জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলীয় নেতা ও সমর্থকদের টার্গেট করছে কর্তৃপক্ষ। একদিকে যখন বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দিয়ে জেলখানা ভরে ফেলছে কর্তৃপক্ষ, তখন সরকার কূটনৈতিক অংশীদারদের সঙ্গে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। এতে কূটনৈতিক অংশীদারদের এটা পরিষ্কার করার আহ্বান জানানো হয়েছে যে, এই দমনপীড়নে দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতা বিপন্ন হতে পারে। এই রিপোর্টে সব সহিংস ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। বলেছে, যেসব ঘটনায় একে অন্যকে দায়ী করছে, তদন্ত করতে হবে তারও। 

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ লিখেছে, গত ২৮শে অক্টোবর প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির মহাসমাবেশের পর থেকে বিরোধী দলের কমপক্ষে ১০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন সহিংসতায় দুই পুলিশ সদস্য সহ নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ১৬ জন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৫৫০০ মানুষ। ১৩ জন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকার, ভিডিও ও পুলিশি রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে যে, অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ, খেয়ালখুশি মতো গণগ্রেপ্তার, জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন এবং বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা। সম্প্রতি নির্বাচন সংক্রান্ত সহিংসতায় তা বেড়ে গেছে। ২৮শে অক্টোবরের সহিংসতার পর বিএনপি ৩১ অক্টোবর থেকে ২রা নভেম্বর পর্যন্ত ধর্মঘটের ডাক দেয়। এ সময়ে এবং পরে পুলিশ, বিরোধী দলের সদস্য এবং ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। সব পক্ষই সহিংসতা করেছে। বিক্ষোভের জবাবে অনেক ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত শক্তি ব্যবহার করেছে পুলিশ। কর্তৃপক্ষ বিরোধী দল বিএনপির বিরুদ্ধে বিশৃংখলা সৃষ্টির অভিযোগ এনে তাদের প্রধান কার্যালয় তালাবদ্ধ করে দিয়েছে। একে ‘ক্রাইম সিন’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। সরকারের সিনিয়র কর্মকর্তারা বিরোধী দলীয় প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে হামলাকে উৎসাহিত করে প্রকাশ্য বিবৃতির মাধ্যমে চলমান সহিংসতাকে উস্কে দিয়েছেন। ৩রা নভেম্বর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যদি তারা কাউকে অগ্নিসংযোগ করতে দেখেন, তাহলে সেই আগুনে তাদেরকে নিক্ষেপ  করতে হবে। যে হাত দিয়ে কোনো কিছু পোড়াবে সেই হাত পুড়িয়ে  দিতে হবে। বলেন, তাতে যদি তাদের শিক্ষা হয়। 

রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ভিডিও এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের হুমকি এবং টার্গেট করায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সমর্থকদের মধ্যে সমন্বয়ের প্রমাণ আছে। এটা হতাশাজনক। বিএনপির একজন সমর্থক বলেন, পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের কর্মীরা রাস্তায় থাকায় লোকজন বাইরে আসতে ভয় পাচ্ছে। ৪ঠা নভেম্বর ঢাকায় রেকর্ড করা একজন সাংবাদিকের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, দাঙ্গা পরিস্থিতিতে পুলিশের পিছনেই কাঠের লাঠি হাতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তারা স্লোগান দিচ্ছেন, বিএনপির একটা করে কর্মী ধর, ধরে ধরে জবাই কর। আরও স্লোগান দিচ্ছেন, বিএনপির পাণ্ডারা রাস্তায় আসার সাহস দেখিও না। আমরা তোমাদের প্রহার করবো।

একই রকম দৃশ্য দেখা গেছে দেশের অন্য অংশগুলো থেকেও। ফেনী থেকে ৪ঠা নভেম্বর স্থানীয় সময় রাত ১১টার দিকে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার (সিসিটিভি) ফুটেজে দেখা গেছে, দাঙ্গা মোকাবিলার প্রস্তুতি নেয়া পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কাঠের লাঠি হাতে অবস্থান নিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ৫ই নভেম্বর এক ঘটনার পর ঢাকার তেজগাঁওয়ে যানবাহনের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। এরপরই এ ঘটনার জন্য দায়ীদের সন্ধানে একসঙ্গে সেখানে উপস্থিত হয় পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। প্রত্যক্ষদর্শী, ভিডিও এবং ওই ঘটনার ছবিগুলো অনুযায়ী, এ সময় কমপক্ষে একজন আওয়ামী লীগ কর্মীর হাতে ছিল দৃশ্যত ধাতব রড। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, এ সময় রাস্তায় থাকা লোকজনের মধ্যে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার অথবা আওয়ামী লীগের কর্মীদের হাতে প্রহৃত হওয়ার ভয় দেখা দেয়। এসব সহিংসতার যখন সবদিক দিয়ে তদন্ত করে দেখা উচিত পুলিশের, তখন তাদের পক্ষপাতিত্বে এবং আইনের শাসন সমুন্নত রাখার সক্ষমতা ক্ষুন্ন হয়, বিশেষ করে যখন তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অবস্থান নেন। যখন চলমান সহিংসতায় ভূমিকা থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দায়মুক্তি পায়, তখন বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীরা ব্যাপকহারে গ্রেপ্তার, কখনো খেয়ালখুশিমতো গ্রেপ্তারের মুখে পড়েন। 

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরও লিখেছে, বিরোধী দলকে মুছে দেয়ার সুস্পষ্ট লক্ষ্য নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে গণগ্রেপ্তার চালাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এর মধ্য দিয়ে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে মুছে দিতে চায়। বিএনপির মতে, তাদের ৫০ লাখ সদস্যের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক বিচারের মুখোমুখি। একজন কর্মী হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন, গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে কাউকে বাদ দিচ্ছে না। সিনিয়র পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। 

আরেক বিরোধী দল আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) একজন মুখপাত্র বলেছেন, তাদের অনেক সমর্থক রাতে পুলিশি অভিযানের ভয়ে পালিয়ে থাকছেন। জেলখানা আর বন্দি নিতে পারছে না। কারণ সেখানে বন্দিতে উপচে পড়ছে। বর্তমানে সক্ষমতার দ্বিগুণের চেয়েও বেশি বন্দি সেখানে। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান মিডিয়াকে বলেছেন, যদিও আমাদের কারাগারগুলোতে ধারণ ক্ষমতা ৪২ হাজার। তবু সেখানে আমরা রাখতে পারি ৯০ হাজার বন্দিকে। এ জন্য ঠিক এই মুহূর্তে কারাগারের সক্ষমতা বৃদ্ধি করার প্রয়োজন নেই। 

ওদিকে যাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদেরকে নিরাপত্তা হেফাজতে প্রহার ও নির্যাতন করার অভিাযোগ আছে। একজন নারী বলেছেন, তার ভাইকে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমি দেখেছি তার বাম হাতের আঙ্গুলগুলো ব্যান্ডেজ করা। বিএনপির একজন কর্মী বলেন, তার ভাইয়ের হার্টের সমস্যা আছে। ৩০শে অক্টোবর পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেছে। ১০ দিন যোগাযোগহীন অবস্থায় রাখা হয় তাকে। তার স্বাস্থ্যগত উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও নিরাপত্তা হেফাজতে প্রহার করা হয়েছে।

 এর প্রেক্ষিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ লিখেছে, বিদেশি সরকারগুলোর বলা উচিত যে, মানবাধিকারকে সমুন্নত রাখতে আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা আছে সরকারের। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ‘এভরিথিং বাট আর্মস’ বাণিজ্য কর্মসূচির প্রধান সুবিধাভোগী বাংলাদেশ। এছাড়া জিএসপি সুবিধা প্রয়োগের ইচ্ছা ব্যক্ত করেছে বাংলাদেশ সরকার। এটা করা হলে গার্মেন্টস সহ গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানিতে শুল্ক কমিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু নিয়ম লঙ্ঘনের ফলে এসব কর্মসূচিতে সরকারের বৈধতা প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এর সঙ্গে যুক্ত সুনির্দিষ্ট মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার। সম্প্রতি এ দেশ সফরে এসে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কর্মকর্তারা ও ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট এসব নিয়ে উদ্বেগ তুলে ধরেছে। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor