১০ বছরে ৬ গুণ বেড়েছে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ
দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে বেড়েই চলেছে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণের পরিমাণ। ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৮৮ মিলিয়ন ডালার। আর ২০২০ সালে তা ছিল ১০ হাজার ৯৮৬ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরের মাথায় এই স্বল্পমেয়াদি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে আট হাজার মিলিয়ন ডলার।
আর গত ১০ বছরের হিসাবে এই ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ছয় গুণের বেশি। ২০১০ সালে সরকারের স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৯৪৭ মিলিয়ন ডলার। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা আংকটাডের ‘দ্য লিস্ট ডেভেলপড কান্ট্রিজ রিপোর্ট ২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। মূলত আংকটাড এলডিসিভুক্ত ৪৬টি দেশের অর্থনৈতিক সূচক, লেনদেনের ভারসাম্য নিয়ে সম্প্রতি প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে।
তাদের ওই প্রতিবেদন বলেছে, শুধু স্বল্পমেয়াদি ঋণ নয়, এর পাশাপাশি বেড়েছে বিদেশি ঋণের পরিমাণও। গত কয়েক বছরে দ্রুত বেড়েছে এই ঋণের পরিমাণ। এতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতেও দ্রুত বাড়ছে বিদেশি ঋণ। সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতেই বিদেশি ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বাড়ায় সুদ ও আসল উভয় পরিশোধের চাপও বাড়ছে।
আর স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে (এলডিসি) বাংলাদেশের সরকারি ও সরকারের (সভরেন) গ্যারান্টিযুক্ত বিদেশি ঋণ সবচেয়ে বেশি। এলডিসিভুক্ত ৪৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের কাছাকাছি কেউ নেই।
প্রতিবছর এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর অর্থনীতির সার্বিক অবস্থা মূল্যায়ন করে আংকটাড। গতকাল এসংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এতে এলডিসিভুক্ত ৪৬টি দেশের ২০২১ সাল শেষে সরকারি ও সভরেন গ্যারান্টিযুক্ত বিদেশি ঋণের চিত্র এবং এসংক্রান্ত বিভিন্ন বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে।
আংকটাডের প্রতিবেদন বলেছে, ২০২১ সাল শেষে বাংলাদেশের সরকারি ও সভরেন গ্যারান্টিযুক্ত বিদেশি ঋণ দাঁডিয়েছে ৬২.৪২৫ বিলিয়ন ডলারে, ২০২০ সাল শেষে যা ছিল ৫৪.৭৮৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাত্ এক বছরে বাংলাদেশের সরকারি ও সভরেন গ্যারান্টিযুক্ত বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৭.৬৩৮ বিলিয়ন ডলার বা ১৩.৯৪ শতাংশ। সরকারি ও সভরেন গ্যারান্টিযুক্ত বিদেশি ঋণ বাড়ার হার ২০২১ সালেই ছিল সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১৯ সালে বাংলাদেশের সরকারি ও সভরেন গ্যারান্টিযুক্ত বিদেশি ঋণ ছিল ৪৬.৩৭৬ বিলিয়ন ডলার।
এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সরকারি ও সভরেন গ্যারান্টিযুক্ত বিদেশি ঋণ অ্যাঙ্গোলার। দেশটির ঋণের পরিমাণ ৪৬.৭৪ বিলিয়ন ডলার। তৃতীয় অবস্থানে থাকা ইথিওপিয়ার এই ঋণের পরিমাণ ২৮.১৭১ বিলিয়ন ডলার। চতুর্থ অবস্থানে থাকা তানজানিয়ার সরকারি ও সভরেন গ্যারান্টিযুক্ত বিদেশি ঋণ ১৮.৯১৭ বিলিয়ন ডলার ও পঞ্চম অবস্থানে থাকা সুদানের ১৫.৩০৫ বিলিয়ন ডলার। এলডিসিভুক্ত অন্য দেশগুলোর এ ধরনের ঋণ আরো কম।
আংকটাডের তথ্য মতে, জিডিপির তুলনায়ও বাংলাদেশের সরকারি ও সভরেন গ্যারান্টিযুক্ত বিদেশি ঋণ সর্বোচ্চ। ২০২১ সালে বাংলাদেশের এ ধরনের ঋণ দাঁড়িয়েছে জিডিপির ১৮.৬ শতাংশ। অ্যাঙ্গোলার সরকারি ও সভরেন গ্যারান্টিযুক্ত বিদেশি ঋণ জিডিপির ১৩.৯ শতাংশ, ইথিওপিয়ার ৮.৪ শতাংশ, তানজানিয়ার ৫.৬ শতাংশ এবং সুদানের ৫ শতাংশ। এলডিসিভুক্ত অন্য দেশগুলোর এ ধরনের ঋণ জিডিপির ৫ শতাংশেরও কম।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ সরকারি ও সভরেন গ্যারান্টিযুক্ত বিদেশি ঋণই বহুপক্ষীয় উৎস থেকে নেওয়া। তবে এলডিসিভুক্ত কয়েকটি দেশের জন্য বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ উদ্বেগের কারণ হয়ে গেছে। যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সংস্থাটি বলেছে, ২০১৯-২১ সাল পর্যন্ত কয়েকটি দেশের সরকারি ব্যয়ের গড়ে ১০ শতাংশের বেশি গেছে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল অ্যাঙ্গোলার ৩৩ শতাংশ ও বাংলাদেশের ২২ শতাংশ।
অপর দিকে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ পরিশোধের (ডেট সার্ভিসিং) চাপও বাড়ছে। ২০২০ সালে ডেট সার্ভিসিংয়ের পরিমাণ ছিল ২.০১৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁডিয়েছে ২.৭৭২ বিলিয়ন ডলার।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ২০১০ সালে বাংলাদেশের সরকারি ও সভরেন গ্যারান্টিযুক্ত বিদেশি ঋণ ছিল ২১.১৪৬ বিলিয়ন ডলার। ২০১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২২.২১৮ বিলিয়ন ডলার, ২০১২ সালে ২৪.১৯৭ বিলিয়ন ডলার, ২০১৩ সালে ২৫.০৩৪ বিলিয়ন ডলার, ২০১৪ সালে ২৬.৫৩৮ বিলিয়ন ডলার, ২০১৫ সালে ২৭.০৯৪ বিলিয়ন ডলার, ২০১৬ সালে ২৯.০৮০ বিলিয়ন ডলার, ২০১৭ সালে ৩৫.২৫৬ বিলিয়ন ডলার এবং ২০১৮ সালে ৪১.২৮৫ বিলিয়ন ডলার।
বস্তুত বাংলাদেশ বর্তমানে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় আছে। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট (সিডিপি) ২০২১ সালে বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণের সুপারিশ করে। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে পুরোপুরি বের হয়ে যাবে। একই বছর লাওস ও নেপাল এলডিসি থেকে বের হবে।