যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের বাকি দুদিন: জরিপ কী বলছে, ভোটার টানতে হ্যারিস ও ট্রাম্পের দৌড়ঝাঁপ
৫ নভেম্বরে ভোট, তাই ছুটছেন তারা শেষ মুহূর্তের প্রচারণায়, হাড্ডহাড্ডি লড়াইয়ের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে – ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিসের দম ফেলবার ফুরসৎ নেই। প্রাক-নির্বাচনী জরিপগুলো বলছে, সমর্থনের বিচারে দুজনের পার্থক্য সামান্যই, ফলে হোয়াইট হাউস কে দখল করবেন – তা অনেকাংশে নির্ভর করবে দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলির (সুইং স্টেট) ওপর। একারণেই ‘ব্যাটেলগ্রাউন্ড’ বা রণভূমি বলেও পরিচিত এসব রাজ্য।
শনিবার দৌদুল্যমান অঙ্গরাজ্য নর্থ ক্যারোলাইনায় যান ট্রাম্প ও হ্যারিস দুজনেই। এনিয়ে টানা চারবার একই দিনে একই অঙ্গরাজ্যে প্রচারণা চালাতে হাজির হন তারা। ৫ তারিখে চূড়ান্ত ভোটের আগে আরো বেশি ভোটারকে নিজের পক্ষে টানতেই তাঁদের এই দৌড়ঝাঁপ। ধারণা করা হচ্ছে, দৌদুল্যমান রাজ্যগুলো এবারের নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে।
ইতোমধ্যে প্রায় ৭ কোটি আমেরিকান আগাম ভোট দিয়েছেন বলে জানিয়েছে ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকশন ল্যাব।
এখনও যারা বাকি আছেন– তাঁদের ভোট টানতে বিনোদন জগতের তারকাদের সাথে নিয়েও প্রার্থীরা হাজির হচ্ছেন জনসভায়। শনিবার হ্যারিস জনসভা করেন নর্থ ক্যারোলাইনার শার্লট শহরে, জনসভায় হাজির ছিলেন রক তারকা জন বোন জভি এবং আরআন্ডবি গীতিকার খালিদ। এর আগে নিউইয়র্কের জনপ্রিয় এক অনুষ্ঠানেও উপস্থিত হয়েছিলেন।
অন্যদিকে, ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যে এক জনসভা করে, নর্থ ক্যারোলাইনার গ্যাসটোনিয়া ও গ্রিনসবোরো যান ট্রাম্প।
প্রাক-নির্বাচন জরিপগুলোর সর্বশেষ অবস্থা কী?
ফাইভথার্টিএইটের সর্বশেষ জরিপ ট্র্যাকার অনুযায়ী, জাতীয়ভাবে হ্যারিস ট্রাম্পের চেয়ে মাত্র এক পয়েন্টের ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন। তবে দুই প্রার্থীর কেউই সমর্থন হারের দিক থেকে ৫০ শতাংশ ছাড়াতে পারেননি। জাতীয় গড়ে হ্যারিসের সমর্থনের হার ৪৭.৯ শতাংশ, যা ট্রাম্পের ক্ষেত্রে ৪৬.৯ শতাংশ।
ডেমোক্রেট দলের বড় সমর্থন থাকায় – তথাকথিত ‘ব্লু-ওয়াল’ নামে পরিচিত অঙ্গরাজ্যগুলো– এবছর যাদেরকে সুইং স্টেট বলে বিবেচনা করা হচ্ছে, ট্রাম্প ৪৭.৯ শতাংশ সমর্থন নিয়ে সামান্য এগিয়ে রয়েছেন পেনসিলভানিয়ায়, যেখানে হ্যারিসের সমর্থন হার ৪৭.৬ শতাংশ। আবার মিশিগান ও উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যে হ্যারিস ১ পয়েন্ট এগিয়ে রয়েছেন।
জরিপগুলো বলছে, নেভাদায় হ্যারিসের চেয়ে ১ শতাংশ সমর্থন বেশি রয়েছে ট্রাম্পের। জর্জিয়া ও নর্থ ক্যারোলাইনায় তা ২ শতাংশ এবং অ্যারিজোনায় ৩ শতাংশ।
তবে বড় রকমের রাজনৈতিক সমর্থন বদলের সাক্ষী হয়েছে আইওয়া অঙ্গরাজ্য, যেখানে ট্রাম্পের চেয়ে ৩ শতাংশীয় পয়েন্টে এগিয়ে রয়েছেন কমলা হ্যারিস। উল্লেখ্য, ২০১৬ ও ২০২০ সালের নির্বাচনে এই রাজ্যে ট্রাম্প জিতেছিলেন।
ফাইভথার্টিএইটের জরিপ যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক মহলে তাদের স্বচ্ছতার জন্য সুপরিচিত।
দ্য মইন রেজিস্টার সংবাদপত্র ও মিডিয়াকম এটির ফলাফল যৌথভাবে প্রকাশ করে, এতে দেখা গেছে, আইওয়ায় নারীদের সমর্থন লাভে এগিয়ে রয়েছেন হ্যারিস, বিশেষত তুলনামূলক বেশি বয়সের নারীদের মধ্যে তার প্রতি সমর্থন বাড়ছে, অর্থাৎ তারা হ্যারিসকে ভোট দেবেন বলে জরিপে জানিয়েছেন। এছাড়া, যারা স্বতন্ত্র ভোটার বা কোনো দলের নিবন্ধিত সমর্থক নন, তাঁদের সমর্থনও বেশি পাচ্ছেন হ্যারিস।
অন্যদিকে আইওয়ায় রিপাবলিকান দলের সমর্থকদের মধ্যে ৮৯ শতাংশ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পকে সমর্থন করছেন, অর্থাৎ দলীয় সমর্থকদের সবাইকে একাট্টা করতে তিনি সমস্যার মধ্যে আছেন।
তবে একই অঙ্গরাজ্য নিয়ে অন্যান্য সংস্থার জরিপের ফলাফলে ট্রাম্পকে হ্যারিসের চেয়ে এগিয়ে রাখা হয়েছে।
শনিবার হ্যারিস যা যা করেছেন?
এদিন নর্থ ক্যারোলাইনার জনসভায় উপস্থিত হয়ে কমলা হ্যারিস তরুণ ভোটারদের প্রতি ভোট দেওয়ার আবেগঘন আহবান জানান। এই রাজ্যের তরুণদের মধ্যে ডেমোক্রেট দলের সমর্থন বেশি হলেও – আগের নির্বাচনগুলোতে দেখা গেছে, তুলনামূলক বেশি বয়সের ব্যক্তিদের চেয়ে তরুণদের কম সংখ্যকই ভোট দিতে যান।
এই প্রেক্ষাপটে গতকালকের জনসভায় হ্যারিস বলেন, ‘যেসব তরুণ ভোটার প্রথমবারের মতো ভোট দিচ্ছেন – আমি সেইসব তরুণ নেতৃত্বের মধ্যে আমেরিকার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে দেখছি। আপনারা আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা সংঘটিত সহিংসতা মুক্ত জীবন, জলবায়ু সংকট মোকাবিলার বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ, এবং বাসযোগ্যরূপে এই পৃথিবীর (বর্তমান অবস্থার) পরিবর্তন চান।’
এসময় প্রতিপক্ষ ট্রাম্পের প্রতি শানিত আক্রমণ করে বলেন, সাবেক এই রাষ্ট্রপতি শুধু তার আখের গোছানো নিয়েই ভাবেন, (দেশের) ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সার্বিক কোনো পরিকল্পনা তার নেই।
‘(প্রেসিডেন্ট) নির্বাচিত হলে– ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের প্রথমদিনেই অফিসে বসে তার শত্রুতালিকা বানাবেন। কিন্তু, যদি আমি নির্বাচিত হই, তাহলে আপনাদের হয়ে পদক্ষেপ নেব, এজন্য যা যা করতে হবে, সেই তালিকা ধরে কাজ করব।’
ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভকারীরা স্লোগানে হ্যারিসের বক্তব্যের মাঝখানে ছেদ পড়ে। পরে তিনি বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে আমরা সব যুদ্ধের অবসান চাই।’ যেকথা এর আগেও বিভিন্ন নির্বাচনী সভায় বলেছেন হ্যারিস।
তিনি বলেন, ‘আমরা চাই সব জিম্মি (হামাসের হাতে বন্দি ইসরায়েলিরা) বাড়ি ফিরুক। আমি যখন প্রেসিডেন্ট হব, এটাকে বাস্তবে রূপ দিতে আমার ক্ষমতার মধ্যে সবকিছু করব।’
এর আগে আটলান্টায় এক নির্বাচনী সভায় অংশ নেন হ্যারিস। সেখানে ট্রাম্পকে তিনি ‘অস্থিতিশীল’ এবং ‘অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা প্রত্যাশী’ বলে উল্লেখ করেন।
নর্থ ক্যারোলাইনায় প্রচারণা চালানোর পরে স্কেচ কমিডি সিরিজ সেটার্ডে নাইট লাইভে দেখা যায় হ্যারিসকে। সেখানে তার চরিত্রে অভিনয় করা মায়া রুডলফের সাথে নিজেও উপস্থিত হয়ে দর্শকে ‘সারপ্রাইজ’ দেন হ্যারিস। এসময় মজা করে মায়া রুডলফ হ্যারিসকে বলেন, ‘আমি আমাদের জন্য ভোট দেব।’
শনিবারে ট্রাম্প যা যা করলেন
এবারের নির্বাচনে ডেমোক্রেট প্রার্থী হ্যারিসের প্রতি সমর্থনের পাল্লা কিছুটা বেশি ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যে, পার্শ্ববর্তী রাজ্য নর্থ ক্যারোলাইনায় দুটি সমাবেশের পরে শনিবার সেখানে একটি জনসভা করেন ট্রাম্প। তবে নর্থ ক্যারোলাইনায় ট্রাম্প নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত প্রচারণা চালাবেন বলে জানা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে গণমাধ্যমের প্রতি জনগণের আস্থা কমে যাওয়ার কৃতিত্ব তার নিজের বলে শনিবার সন্ধ্যায় নর্থ ক্যারোলাইনার গ্রিনসবোরোর জনসভায় মন্তব্য করেন ট্রাম্প।
ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘২০১৫ সালে যখন আমরা এই যাত্রা (প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচার) শুরু করি, তখন ভুয়া খবরে দাবি করা হয়েছিল (প্রতিপক্ষ প্রার্থীর) সমর্থন হার ৯২ শতাংশ। কিন্তু, এখন সেটা কংগ্রেসের চেয়েও কম, বা মাত্র ১২ শতাংশ। এনিয়ে আমি খুবই গর্বিত, কারন আমি তাদের ভুয়া বলে প্রমাণ করেছি।’
এরপরে ট্রাম্প তার ভাষণের প্রিয় বিষয়বস্তু বা যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসনের আশঙ্কা নিয়ে কথা বলেন।
ট্রাম্প বলেন, ‘আমেরিকা সমাজকে আমি কেবল আমেরিকান নাগরিকদের জন্য রক্ষা করব। আমাদের সম্প্রদায়গুলোতে শুধু আমেরিকান লোকজন থাকবে।’
ট্রাম্পের অভিবাসন বিদ্বেষী প্রচারণায় যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের অনেকের সমর্থন রয়েছে; অশ্বেতাঙ্গ ভোটারদের মধ্যেও এই বিদ্বেষ ছড়াতে অভিবাসন নিয়ে তার বক্তব্যে নতুনত্ব এনে ট্রাম্প বলেছেন, অবাধ অভিবাসন কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়কে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
‘এটা অব্যাহত থাকলে, তাঁদের কাছে কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা অবশিষ্ট থাকবে না। তাঁদের সম্প্রদায়ের মধ্যে তখন বেশিরভাগই হবে অভিবাসী।’
এসময় কঙ্গোর মানুষ অভিবাসনের মাধ্যমে দলে দলে আমেরিকায় আসছে এমন মিথ্যা দাবিও পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি।
আগামী দুইদিন যা করছেন হ্যারিস ও ট্রাম্প
দোদুল্যমান দুই অঙ্গরাজ্য – মিশিগান ও পেনসিলভানিয়ায় যাবেন হ্যারিস।
রোববার ডেমোক্রেট দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর একটি জনসভা হওয়ার কথা মিশিগানের ল্যানসিং – এ।
আর পেনসিলভানিয়ার একটি জনসভার মধ্যে দিয়ে সোমবার শেষ হবে কমলা হ্যারিসের প্রচারণা।
লাতিন আমেরিকান ভোটারদের শক্তঘাঁটি হিসেবে পরিচিত অ্যালেনটাউন এবং পিটসবুর্গ ও ফিলাডেলফিয়ার মতো বড় শহরগুলোতেও সভা করার পরিকল্পনা রয়েছে তার।
অন্যদিকে পেনসিলভানিয়া ও নর্থ ক্যারোলাইনায় যাবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি এদিন পেনসিলভানিয়ায় প্রচার চালানোর পরে আবারো দক্ষিণের অঙ্গরাজ্য নর্থ ক্যারোলাইনার কিনস্টোনে আসবেন। এরপর সোমবার নির্বাচনের আগের রাতে এই অঙ্গরাজ্যের রাজধানী রেলেইঘ- এ যাবেন।
সাম্প্রতিক দশকগুলোয় নির্বাচনী লড়াইয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই রাজ্যে ট্রাম্প যথেষ্ট সময় দিচ্ছেন– তাতে সন্দেহ নেই। সাম্প্রতিক জরিপগুলোয়, নর্থ ক্যারোলাইনায় ট্রাম্প হ্যারিসের চেয়ে (ভোটারদের সমর্থন লাভে) এগিয়ে রয়েছেন বলেও জানা যাচ্ছে।