শতকোটি দামের রাজউক কর্মচারী
রাজধানী উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষের (রাজউক) নিম্নমান সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক (বর্তমানে পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট) মো. ওবায়দুল্লাহ। তৃতীয় শ্রেণির এ সরকারি কর্মচারী রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা সিদ্ধেশ্বরীতে কার পার্কিংসহ ১৬০০ বর্গফুট আয়তনের একটি ফ্ল্যাটের মালিক। তিনি খাতাকলমে ফ্ল্যাটটির মূল্য দেখিয়েছেন ৩৪ লাখ ২৩ হাজার টাকা। যদিও রাজউকের প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তা বলেছেন, সিদ্ধেশ্বরী হচ্ছে মিশ্র এলাকা। সেখানকার ফ্ল্যাটের প্রতি বর্গফুটের মূল্য ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। সেই হিসাবে ওবায়দুল্লাহর ফ্ল্যাটটির প্রকৃত দাম হবে দেড় থেকে দুই কোটি টাকা। একই ভবনে আরও দুটি ফ্ল্যাট ও একটি দোকান রয়েছে রাজউকের এ কর্মচারীর।
শুধু তাই নয়, রাজধানীর বাড্ডায় পৌনে তিন কাঠার প্লট, নরসিংদীর মনোহরদীতে ৯৬ শতাংশ জমিতে দোতলা বাড়ি, নিজের নামে গড়ে তোলা স্কুলের সেমিপাকা ঘর ও স্কুলের হোস্টেল আছে ওবায়দুল্লাহর। এ ছাড়া মনোহরদীর খিদিরপুরে সাড়ে তিন কাঠা জমি, একটি প্রাইভেট কার, ৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকার ইন্স্যুরেন্স, ২৫ ভরি স্বর্ণালঙ্কার এবং ব্যাংকে নগদ জমা ৫২ লাখ ৫৩ হাজার টাকাসহ আরও অনেক সম্পদ রয়েছে তার। এখন পর্যন্ত ওবায়দুল্লাহর যেসব সম্পদের তথ্যের খোঁজ মিলেছে, তা রাজউকে চাকরি করে অর্জন করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ওবায়দুল্লাহর স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের মূল্য কয়েক কোটি টাকা। এর বাইরে তিনি ২০০৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত নিজের ও স্ত্রীর নামের ১১টি ব্যাংক হিসাবে ১০২ কোটি টাকা লেনদেন করেন। ব্যাংকে তার অস্বাভাবিক লেনদেনের ঘটনাটি বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) নজরে আসার পর এ বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠি পেয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। আর দুদকও প্রাথমিক অনুসন্ধানে রাজউক কর্মচারী ওবায়দুল্লাহর বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের তথ্য পায়।
দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা শাখার প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে চলতি বছর আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে ওবায়দুল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। এজন্য দায়িত্ব পান কমিশনের উপপরিচালক মো. ইয়াসির আরাফাত। তিনি সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে অভিযোগসংক্রান্ত নথিপত্র চেয়ে বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েছেন। একই সঙ্গে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ১১টি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ (স্থগিত) করতে গত ২২ আগস্ট চিঠি পাঠান। চিঠিতে বলা হয়, ‘রাজউকের নিম্নমান সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক ওবায়দুল্লাহ বিভিন্ন ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত ১০২ কোটি টাকা নিজের ও স্ত্রী আয়েশা আক্তারের নামে তিনটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর এবং পরে তাদের নিজের নামে থাকা ব্যাংক হিসাবে জমা করে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনসহ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে সম্পৃক্ত অপরাধে জড়িত। সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাবগুলো ফ্রিজ করা প্রয়োজন। এসব ব্যাংক হিসাব বিএফআইইউর মাধ্যমে ফ্রিজ করার অনুরোধ করা হলো।’
দুদকের একজন কর্মকর্তা বলেন, রাজউকের কর্মচারী ওবায়দুল্লাহর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে। তার ব্যাংক হিসাবে ১০২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। এসব টাকা এখন ব্যাংকে নেই। সব টাকা উঠিয়ে ফেলা হয়েছে। ব্যাংকের লেনদেনের বাইরে তার কয়েক কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। তার নামে-বেনামে থাকা সম্পদ অর্জনের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওবায়দুল্লাহ ২০০৬ সালের ১০ এপ্রিল স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের উত্তরা শাখায় ১৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকা জমা করেন। পরে ওই টাকা উত্তোলন করেন। এ হিসাবটি ২০২২ সালের ২৭ আগস্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর ২০০৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর সোনালী ব্যাংকের রাজউক শাখায় ২ কোটি ১৪ লাখ, ২০১০ সালের ৯ জুন জনতা ব্যাংকের রাজউক শাখায় ২০ লাখ টাকা জমা, ২০১১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ব্র্যাক ব্যাংকের গুলশান শাখার ফ্রেন্ডশিপ বিজনেস করপোরেশন নামের হিসাবে ১ কোটি ৩৬ লাখ, ২০১২ সালের ২০ ফেব্রয়ারি স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের উত্তরা শাখায় ফ্রেন্ডশিপ বিজনেস করপোরেশন নামের হিসাবে ৫ কোটি ৬৩ লাখ, ২০১৪ সালের ৯ জুন সোনালী ব্যাংকের বুয়েট শাখায় ফ্রেন্ডশিপ ফার্নিচার অ্যান্ড ডোর নামের হিসাবে ৫ কোটি ৩৯ লাখ, ২০২১ সালের ৬ এপ্রিল প্রিমিয়ার ব্যাংকের বসুন্ধরা শাখায় নিজ নামের হিসাবে ১২ কোটি ৬২ লাখ, ২০১৮ সালের ১২ আগস্ট ব্যাংক এশিয়ার প্রগতি সরণি শাখায় তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান মোহাম্মদ এন্টারপ্রাইজের নামের হিসাবে ৫ কোটি ২৪ লাখ, ২০১৯ সালের ২৮ নভেম্বর আইপিডি ফাইন্যান্স লিমিটেডের গুলশান শাখায় স্ত্রী আয়েশা আক্তারের নামে ৭ লাখ, ২০১৯ সালের ১১ জুন ইউসিবি ব্যাংকের শান্তিনগর শাখায় ২ কোটি ৫৭ লাখ, ২০২২ সালে ২ আগস্ট অগ্রণী ব্যাংকের মৌচাক শাখায় স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে ১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা জমা হয়। অবশ্য এসব টাকা পরে উত্তোলন করা হয়। উত্তোলনের পর ছয়টি ব্যাংক হিসাব বন্ধ করে দেওয়া হয়।
রাজউক থেকে দুদকে পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, নিজের, স্ত্রী ও অন্যের নামে চারটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন ওবায়দুল্লাহ। প্রতিষ্ঠানগুলো হলোÑ মেসার্স ওবায়দুল্লাহ এন্টারপ্রাইজ, মোহাম্মদ এন্টারপ্রাইজ, ফ্রেন্ডশিপ বিজনেস করপোরেশন এবং ফ্রেন্ডশিপ ফার্নিচার ও ডোর। তার সম্পদের মধ্যে রয়েছে ঢাকা ও নরসিংদীতে একাধিক ফ্ল্যাট ও প্লট। ওবায়দুল্লাহর সম্পদের মধ্যে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে ০৩৮৮ অযুতাংশ জমিতে নির্মিত ছয়তলা ভবনের দ্বিতীয়তলায় ১৬০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট ও কার পার্কিং, ভবনটির পাঁচতলায় ১০২০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, একই তলায় ৮১০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট এবং ভবনটির নিচতলায় ২০১ বর্গফুটের দোকান। এ ছাড়া বাড্ডা ডিআইটি প্রকল্পে তিন নম্বর সড়কে দুই কাঠা আট ছটাক আয়তনের ৪২ নম্বর প্লট, ঢাকার বাইরে নরসিংদীর মনোহরদী থানার চরমান্দালিয়া মৌজায় ৯৬ শতাংশ জমিতে দোতলা বাড়ি ও লন উন্নয়ন, সেমিপাকা স্কুল ঘর ও হোস্টেল নির্মাণাধীন। একই থানার খিদিরপুরে সাড়ে তিন কাঠা জমি আছে। এসব সম্পদের মূল্য মাত্র ১ কোটি ৩২ লাখ ৭৬ হাজার টাকা দেখান ওবায়দুল্লাহ। এ ছাড়া তার অস্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে একটি প্রাইভেট কার, যার নম্বর ঢাকা মেট্রো-গ-২৫-৫৪০০। রয়েছে ৯ লাখ ৫৫ হাজার ৮৯৬ টাকার ইন্স্যুরেন্স, বিয়ের উপহার হিসেবে পাওয়া ২৫ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, লাখ লাখ টাকার আসবাবপত্র ও ইলেকট্রনিকস পণ্য। আর ব্যাংকে জমা আছে ৫২ লাখ ৫৩ হাজার ২৮৪ টাকা। এসব অস্থাবর সম্পদের মূল্য দেখানো হয় ৭৬ লাখ ৯৯ হাজার ১৮০ টাকা। তিনি স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মোট মূল্য উল্লেখ করেন ২ কোটি ৯ লাখ ৭৫ হাজার ৭৮০ টাকা। ১৬ বছরে আয় দেখিয়েছেন ২ কোটি ৫৩ লাখ ৯২ হাজার ৪০৩ টাকা আর সঞ্চয় দেখান ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৯৭৬ টাকা।
তবে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করে মো. ওবায়দুল্লাহ গতকাল সোমবার বিকেলে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে যে ১০২ কোটি টাকা লেনদেন কথা বলা হয়েছে, তা মিথ্যা।’ সম্পদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব যৌথ সম্পত্তি। দুদক অনুসন্ধান করছে, আমি দুদককে তথ্য দিচ্ছি।’ এ বিষয়ে তিনি আর কিছু বলতে রাজি হননি।