বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন: শীর্ষ ২০ খেলাপি থেকে আদায় ২ শতাংশ
ব্যাংকাররা বড় ঋণখেলাপিদের দয়ার ওপর নির্ভরশীল -ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির কাছে পাওনা ৮ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন পর্যন্ত নগদ আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৮৭০ কোটি টাকা। কিন্তু খেলাপিরা ফেরত দিয়েছেন মাত্র ১৬ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার ২ শতাংশ। তবে উলটো চিত্র ছোট ও মাঝারি খেলাপির ক্ষেত্রে। এসব খেলাপির কাছ থেকে ব্যাংকটির পাওনা ৬ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা। এখানে আদায়ের লক্ষ্য ৬৪৫ কোটি টাকা। আদায় ১১০ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যের ১৭ শতাংশ। অর্থাৎ ছোটরা টাকা দিলেও বড় ঋণখেলাপিরা টাকা দিচ্ছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের ওপর করা ২০২৩ সালের জুনভিত্তিক একটি প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য মিলেছে। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ প্রতিবেদনে দেখা যায়, অপর একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির কাছে পাওনা ৬ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা। ৬ মাসে নগদ আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৬৮৫ কোটি টাকা। খেলাপিরা দিয়েছেন মাত্র ১২ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার ২ শতাংশ। বিপরীতে অন্যান্য খেলাপি থেকে ব্যাংকটির পাওনা ৮ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা। আদায়ের লক্ষ্য ৮৫০ কোটি টাকা। আদায় ২০২ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যের ২৪ শতাংশ। অর্থাৎ এখানেও ছোটরা টাকা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। সে তুলনায় শীর্ষ ঋণখেলাপিদের টাকা ফেরত দেওয়ার প্রবণতা খুবই কম। বাকি দুই ব্যাংকের আদায়চিত্র কিছুটা ভালো। তবে কাক্সিক্ষত নয়।
এখানে রূপালী ব্যাংক সবচেয়ে ভালো করেছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির কাছে ব্যাংকটির পাওনা ৩ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা। নগদ আদায়ের লক্ষ্য ৩৩৫ কোটি, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত আদায় করেছে ৬৫ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার ১৯ শতাংশ। একইভাবে অন্যান্য খেলাপির কাছে পাওনা ছিল ৫ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। নগদ আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৫৭০ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে ২৬৪ কোটি, যা লক্ষ্যমাত্রার ৪৭ শতাংশ। আগের লক্ষ্যমাত্রায়ও ব্যাংকটির সর্বোচ্চ অর্জন ছিল ১৪৪ শতাংশ।
শীর্ষ ২০ খেলাপি থেকে সোনালী ব্যাংকের পাওনা ছিল ৪ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা। আদায়ের লক্ষ্য ৩০০ কোটি, আদায় করেছে ২৬ কোটি; যা লক্ষ্যমাত্রার ৯ শতাংশ। বিপরীতে অন্যান্য খেলাপি থেকে পাওনা ছিল ৮ হাজার ২৭০ কোটি টাকা। আদায়ের লক্ষ্য ৭০০ কোটি। আদায় ২৫১ কোটি, যা লক্ষ্যমাত্রার ৩৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের অবলোপন করা ঋণের অঙ্ক ১৪ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় ১ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। কিন্তু চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলো লক্ষ্যের ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেনি। এ চার ব্যাংক নির্ধারিত সময়ে আদায় করেছে মাত্র ৮৯ কোটি টাকা।
জানা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে ২০০৭ সাল থেকে সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবিড় তদারকি সত্ত্বেও রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করা যাচ্ছে না। সর্বশেষ ২০২৩ সালের সমঝোতা স্মারকের আওতায় ব্যাংকগুলোকে যেসব লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো অর্জন তো দূরের কথা, ধারেকাছেও যেতে পারেনি ব্যাংক চারটি। উলটো খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতি বেড়েছে। বিতরণ করা ঋণের অধিকাংশই কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে মাত্র ৫টি শাখায়। বড় গ্রাহকের সীমাতিরিক্ত ঋণ কমিয়ে আনার শর্তও পরিপালিত হয়নি। শীর্ষ খেলাপিসহ অন্য খেলাপি গ্রাহকদের কাছ থেকে নগদ আদায়ও সন্তোষজনক নয়। এছাড়া ব্যাংকগুলোর মোট আমানতের অর্ধেকের বেশি উচ্চ সুদবাহী হওয়ায় পরিচালন ব্যয়ও কমছে না। সম্প্রতি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সেসঙ্গে ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণের শর্ত পরিপালন, খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনাসহ বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এখন ব্যাংকাররা অনেকটা বড় ঋণখেলাপিদের দয়ার ওপর নির্ভরশীল। দয়া করে কিছু দিলে পেল, না দিলে কিছু করার নেই। এছাড়া বছরের পর বছর ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতিতে থাকা পুরো খাতের জন্য খারাপ বার্তা। কারণ, কোনো ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে থাকলে তার আর্থিক ভিত্তির দুর্বলতা প্রকাশ পায়। ফলে ওই ব্যাংকের ওপর গ্রাহকদের আস্থাও কমে যায়। এছাড়া অন্য দেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে তাদের অসুবিধার মুখে পড়তে হয়। তাই ব্যাংকগুলোর মূলধন ভিত্তিকে শক্তিশালী করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।