অফশোর বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ১.৩ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব দিল ড্যানিশ প্রতিষ্ঠান
ড্যানিশ বিনিয়োগকারীরা ৫০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এই অফশোর বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করতে চায়। এটিই বায়ুবিদ্যুৎ খাতে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ প্রস্তাব হবে।
সমুদ্রে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনে যৌথভাবে আগ্রহ দেখিয়েছে ডেনমার্কের দুটি এবং বাংলাদেশের একটি কোম্পানি। সমুদ্রতীর থেকে দূরবর্তী এলাকায় বঙ্গোপসাগরের মধ্যে বায়ুকল স্থাপন করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাংলাদেশ সরকারের কাছে একটি প্রকল্প প্রস্তাব গত মাসে জমা দিয়েছে তিন কোম্পানি নিয়ে গঠিত কনসোর্টিয়ামটি। প্রাথমিকভাবে দৈনিক ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে প্রস্তাবটিতে। এর জন্য ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার (বর্তমান মুদ্রা বিনিময় হার অনুযায়ী প্রায় ১৪ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা) বিনিয়োগ করা হবে।
বঙ্গোপসাগরে ১.৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে একটি অফশোর বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলার জন্য স্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী সামিট গ্রুপের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করবে ডেনমার্কের বিনিয়োগকারী সিআইপি ও উন্নয়নকারী সিওপি। এর সুবাদে দেশের অফশোর বায়ুশক্তির বড় উল্লম্ফন ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দেওয়া প্রস্তাব অনুযায়ী, ড্যানিশ বিনিয়োগকারীরা ৫০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এই অফশোর বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করতে চায়। এটিই বায়ুবিদ্যুৎ খাতে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ প্রস্তাব হবে।
চব্বিশ ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম হওয়ায় প্রকল্পটি বাংলাদেশের জন্য একটি প্রতিযোগিতামূলক বিকল্প হতে পারে। কারণ অফশোর বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ প্রায় ০.০৭৫ মার্কিন ডলার—বর্তমান বিনিময় হারে যা ৭.৮৬ টাকা। এ ব্যয় কয়লা কিংবা বা এলএনজি ও তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর চেয়ে অনেক কম।
কোপেনহেগেন অফশোর পার্টনারস (সিওপি) শুধু কোপেনহেগেন ইনফ্রাস্ট্রাকচার পার্টনারসের (সিআইপি) জন্য অফশোর বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। সিআইপি বিশ্বের অন্যতম প্রধান সবুজ অবকাঠামো তহবিল ব্যবস্থাপক।
অফিশিয়াল তথ্যানুসারে, এখন পর্যন্ত সিআইপি বিশ্বব্যাপী ১২০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে ১৯ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছে।
সিওপির ডিরেক্টর অভ নিউ মার্কেটস রেনে ভন বুলো বলেন, ‘আমরা প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন করেছি। এখন বিপিডিবির কাছ থেকে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শুরু করার অনুমতির পাওয়ার অপেক্ষায় আছি। অফশোর বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প উন্নয়নের জন্য এটি ব্যয়বহুল। বায়ু পরিমাপ, পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন ও ভূমির অবস্থার জরিপ রয়েছে এর মধ্যে।’
কক্সবাজার ও টেকনাফের গ্রিড সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্পটি ২০২৮ সালে চালু হবে বলে আশা করা হচ্ছে বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের একটি ইমেইলের জবাবে তিনি নিশ্চিত করেছেন।
বাংলাদেশে ডেনমার্কের দূতাবাস সূত্র জানিয়েছে, প্রস্তাবটি নিয়ে আলোচনার জন্য ১৩ ও ১৯ জুলাই বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার কথা রয়েছে ড্যানিশ রাষ্ট্রদূত উইনি এস্ট্রুপ পিটারসেনের।
প্রস্তাবটি এমন এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এল, যখন পরিচ্ছন্ন শক্তি ব্যবহারের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা থাকা সত্ত্বেও জমি সংকটের কারণে বাংলাদেশের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, পাশাপাশি জলবিদ্যুতেও অগ্রগতি কম।
প্রাথমিক বিনিয়োগ প্রস্তাব ও কনসোর্টিয়ামটির দেওয়া অব্যাহত সহযোগিতার প্রস্তাব মঙ্গলবার সিওপির ইস্যু করা এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়েছে, প্রাথমিকভাবে ৫০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার ইউটিলিটি-স্কেল অফশোর বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পটি বাংলাদেশের সবুজ রাষ্ট্র হওয়ার দিকে এগিয়ে যাওয়ার মূল চালিকাশক্তি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রেস বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, এই অফশোর বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প বিশেষ করে দেশের উপকূলীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করার অনন্য সুযোগ করে দেবে এবং সুনীল অর্থনীতির উন্নয়নে সহায়ক হবে।
বাস্তবায়িত হওয়ার পর এই অফশোর বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পটি হবে বাংলাদেশে—এবং সম্ভবত দক্ষিণ এশিয়ায়—এ ধরনের প্রথম বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প। এ প্রকল্পে প্রযুক্তি হস্তান্তরের ব্যবস্থা থাকবে, যার ফলে নতুন এ শিল্পের অগ্রগতি বেগবান হবে এবং ভবিষ্যৎ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের বাধা কমবে।
প্রাথমিক সমীক্ষার ফলাফল অনুসারে, ৩০ বছর আয়ুষ্কালের প্রকল্পটি কয়েক ডজন স্থায়ী পদ ছাড়াও নির্মাণ পর্যায়ে কয়েকশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে।
বায়ু ও নবায়নযোগ্য শক্তিতে বাংলাদেশ যেখানে দাঁড়িয়ে
২০১৬ সালের বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা অনুসারে, ২০৩০ সাল নাগাদ মোট বিদ্যুতের ১০ শতাংশ ও ২০৪১ সাল নাগাদ ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। আলোচ্য সময়ে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা হবে যথাক্রমে ৪০ ও ৬০ গিগাওয়াট।
বর্তমানে বাংলাদেশের মোট সক্ষমতার মাত্র ৪.৩৪ শতাংশ হলো নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা, যার প্রধান উৎসই হলো সৌরবিদ্যুৎ।
শতকরা হিসাবে বায়ুবিদ্যুতের পরিমাণ একেবারেই কম। কক্সবাজারে ৬০ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প সম্প্রতি চালু হয়েছে। সেখান থেকে দৈনিক ২০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ আসছে।
এর আগে ২০১৭ সালে জাতীয় নবায়নযোগ্য জ্বালানি পরীক্ষাগারের এক গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে বাতাসের গতিবেগ প্রতি সেকেন্ডে ৫.৭৫ থেকে ৭.৭৫ মিটার, যা কাজে লাগিয়ে দিনে ৩০ হাজার মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা আছে।
বাংলাদেশ এর আগে কক্সবাজার ও ফেনীতে উপকূলীয় দুটি উইন্ডমিলের সাহায্যে বায়ুশক্তি ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। তবে নিম্ন উচ্চতার মতো কারিগরি ত্রুটির কারণে এসব স্থাপনা অলস পড়ে রয়েছে।
বর্তমানে বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে আটটি উইন্ডমিল প্রকল্প। তাদের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৩৫৭ মেগাওয়াট।
অফশোরের বাতাস কাজে লাগাতে সরকারের উদ্যোগ
জমি সংকটের কারণে দেশে সৌর বিদ্যুতের প্রসার ব্যাহত হচ্ছে। ফলে শক্তির বিকল্প উৎস হিসেবে সরকার এখন অফশোর বিদ্যুতের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে।
বঙ্গোপসাগরে অফশোর উইন্ড ফার্ম গড়ে তোলার প্রাক-সম্ভাব্যতা ও পূর্ণাঙ্গ সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য ইটালিয়ান প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রো ইলেট্রোটেকনিকো স্পেরিমেন্টালে ইটালিয়ানো (সিইএসআই) ও তাদের যৌথ উদ্যোগের অংশীদারদের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।
চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছে এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই, এতে অর্থায়ন করছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। এর আওতায় বায়ুবিদ্যুৎ উন্নয়নের জন্য সম্ভাব্য অফশোর স্থানগুলোকে চিহ্নিত করার লক্ষ্য আছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) এবং প্রি-ফিজিবিলিটি অ্যান্ড ডিটেইল ফিজিবিলিটি স্টাডি টু ডেভেলপ অফশোর উইন্ড ফার্ম ইন বাংলাদেশ-এর প্রকল্প পরিচালক মো. নুরুল আলম বলেন, ইটালিয়ান পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যে প্রথম ধাপের কাজ সম্পন্ন করে দ্বিতীয় ধাপের কার্যক্রম শুরু করেছে।
দ্বিতীয় ধাপের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে: সবচেয়ে উপযুক্ত দুটি সাইট চিহ্নিত করা এবং সাবস্টেশন ও ট্রান্সমিশন সিস্টেম নির্মাণের জন্য সেরা মডেল খুঁজে বের করা।
এছাড়া টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় দেশের চারটি স্থানে বায়ুসম্পদ যাচাইয়ের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দেশে এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত বা বাস্তবায়নাধীন বড় আকারের সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বেশির ভাগই নদী বা সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় নির্মিত হয়েছে বা হচ্ছে। ভবিষ্যতে সমুদ্রের তীর থেকে দুই-চার কিলোমিটার গভীরে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের উপায় খুঁজছে সরকার। দেশে জমির স্বল্পতার কারণে এই পথে হাঁটা শুরু হয়েছে। তবে পরিবেশ, মাছের বংশবিস্তার-চলাচল-আহরণ এবং জাহাজ চলাচলে যেন ক্ষতি না হয়, তা বিবেচনায় নিয়ে এ ধরনের বায়ুকল স্থাপন করা হবে। এছাড়া সমুদ্রের তলদেশ টারবাইন স্থাপনে উপযোগী কি না এবং কেন্দ্রের কাছাকাছি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ-সম্প্রসারণের উপযোগিতাও বিবেচনা করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল রিনিউয়েবল এনার্জি ল্যাবরেটরি (এনআরইএল) ২০১৮ সালে এক প্রতিবেদনে জানায়, বাংলাদেশে দৈনিক গড়ে ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বায়ু থেকে উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী ১৮ বছরে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের সব সুযোগ ব্যবহার করতে চায় সরকার। দেশে বায়ুকল নির্মাণের আটটি প্রকল্প বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন বা পরিকল্পনাধীন রয়েছে। নির্মাণ সম্পন্ন হলে এগুলোর সম্মিলিত উত্পাদনক্ষমতা দাঁড়াবে ৩৫৭ মেগাওয়াট।