Hot

এ মৃত্যুর শেষ কোথায়: বেইলি রোডে ভয়াবহ আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যু ভবনে ছড়ানো-ছিটানো সিলিন্ডার যেন মৃত্যুকূপ

২০১০ সালের ৩ জুন রাতে পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিকের গুদাম থেকে ছড়ানো আগুনে ১২৪ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের আগুনে প্রাণ হারান ৭১ জন। একই বছরের ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুনে ২৭ জন প্রাণ হারান। এবার রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ বহুতল ভবনে আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর আহত হয়েছেন ২২ জন। আহতদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী, ব্যবসায়ী ও নারী-শিশু। নিহতদের মধ্যে ৪১ জনের লাশ ইতোমধ্যে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। লাশ নিতে আসা স্বজনদের আহাজারিতে হাসপাতালে বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। এক হৃদয় বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

একের পর এক এই নির্মম মৃত্যু আর কত দেখবে রাজধানীবাসী। নিমতলী থেকে বেইলি রোডের এই ভয়াবহ অগ্নিকা- এর থেকে কি ঢাকাবাসীর রেহাই নেই? এতো মৃত্যুর শেষ কোথায়? প্রতিটি ভয়াবহ অগ্নিকা-ের পর এ নিয়ে হৈ-চৈ শুরু হয়। নিয়ম-অনিয়ম নিয়ে চুল ছেড়া বিশ্লেষণ হয়। প্রশাসনের কর্তারা নড়েচড়ে বসেন। ঘটনার কারণ উৎঘাটনে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর আলোর মুখ দেখে না।

নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকা-ের পর পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক ক্যামিকেলের গুদাম সরিয়ে নেয়ার তোড়জোড় শুরু হয়। দু’-এক বছর তা অব্যাহত থাকে, কিন্তু ধীরে ধীরে প্রশাসন আবার অদৃশ্য কারণে নীরব হয়ে যায় এবং পুরান ঢাকায় ক্যামিকেল গুদাম নিয়ে এ ব্যবসা আগের মতই চলতে থাকে। অগ্নিকা-ের ঘটনার পর ভবন নির্মাণের অনিয়মসহ নানা অনিয়ম বেরিয়ে আসে কিন্তু তা থেকে আমাদের কোন শিক্ষা হয় না। অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থার ব্যাপারেও কোন সচেতনতা নেই। প্রশাসনেরও এ ব্যাপারে কোন নজরদারি চোখে পড়ে না। বেইলি রোডের এই ভবনটিতেও রেস্টুরেন্ট করার কোন অনুমোদন ছিল না। এ ভবনটিতেও অগ্নি নির্গমনের কোন পথ ছিল না তাইতো প্রধানমন্ত্রী নিজে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, সরকার অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রের ব্যবস্থা করেছে তারপরও মানুষ সচেতন নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেইলি রোডের ভবনে অগ্নিকা-ের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেন। আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণকারীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান।

বেইলি রোডের যে ভবনে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে সেটি সাত তলা ভবন। অধিকাংশ তলাতেই রেস্তোরাঁ। রয়েছে একটি মোবাইলের শোরুম, একটি পোশাকের শোরুমও। অবস্থান বেইলি রোডে, বলা যায় রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্রেই। স্বাভাবিকভাবেই জনসমাগমে সবসময়ই জমজমাট গ্রিন কোজি কটেজ। ছুটির দিন তো বটেই, এখানকার রেস্তোরাঁগুলো সন্ধ্যার পর প্রায় সব দিনেই ভরপুর ভোজনরসিকদের উপস্থিতিতে। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর সাপ্তাহিক ছুটির দিনের আগে যেন মানুষের ঢল নামে এই ভবনে। এর কারণ সাত তলা ভবনটিতে যেসব রেস্তোরাঁর অবস্থান, তার সবগুলোই জনপ্রিয় ব্যান্ড। কাচ্চি ভাই, খানা’স, বার্নওয়েল, ওয়াফল অ্যান্ড জুস বার, ফুওকো হটের মতো খাবারের ডেরায় কে না ঢুঁ মারতে চায়! সঙ্গে পোশাকের অভিজাত ব্যান্ড ইল্লিয়িন আর গ্যাজেটস অ্যান্ড গিয়ারের শোরুম ভবনটিকে করে তুলেছে আকর্ষণীয় গন্তব্য। কিন্তু গন্তব্যই যে সবার অগোচরে পরিণত হয়ে আছে মৃত্যুকূপে, তা কে ভাবতে পেরেছিল?
হলো ঠিক তাই। মৃত্যুকূপে পরিণত হওয়া প্রিয় গন্তব্যে ঠিক ঘটল বিস্ফোরণ। উত্তাপে পুড়ল গ্রিন কোজি কটেজ। আগুনের লেলিহান শিখা কেড়ে নিল ৪৬টি প্রাণ। এখানেই শেষ নয়, সেই মৃত্যুকূপ থেকে বের হয়ে আসা আরও অনেকেই এখনো মৃত্যুর প্রহর গুনছেন হাসপাতালের শয্যায়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে সেই আগুনের সূত্রপাত গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে। ধারণা কর হচ্ছে, কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁর নিচতলা থেকে আগুনের সূত্রপাত। ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিটের পাশাপাশি আনসারের তিন ব্যাটেলিয়ন, এজিবির এক ব্যাটেলিয়ন আর বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ সদস্যদের দুই ঘণ্টার চেষ্টায় যখন আগুন নিয়ন্ত্রণে, ততক্ষণে ঝরে গেছে ৪৬টি তাজা প্রাণ।

এ রকম একটি অভিজাত ভবনের এই হাল কেন? ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মইন উদ্দিন ভবনটি নিয়ে গণমাধ্যমকে যে তথ্য দিয়েছেন, তাতে ফের উঠে এসেছে ঢাকা শহরের আরও শত সহস্র ভবনের পুরনো ‘রোগে’র কথা অগ্নিনিরাপত্তার দিক থেকে একেবারেই শূন্য প্রস্তুতি ছিল এই ভবনের।
মইন উদ্দিন বলেন, দ্বিতীয় তলা ছাড়া ভবনটির প্রতিটি তলায় সিঁড়িতে রাখা ছিল গ্যাস সিলিন্ডার। এটা খুবই বিপজ্জনক ব্যাপার। কারণ এ রকম একটা জায়গায় আগুন লাগলে একের পর এক সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে এক ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। হয়েছেও তাই। গ্যাস সিলিন্ডারগুলোর কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে এবং দাউদাউ করে জ্বলেছে। প্রায় সব তলাতেই আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। সাত তলা এই ভবনে সিঁড়ি মাত্র একটি। তবে ভবনটিতে ওঠা-নামার জন্য সবাই লিফট ব্যবহার করে থাকেন। সিঁড়িটি বরং যেন সিলিন্ডারের গুদাম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। নেই জরুরি বহির্গমন পথও। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মইন বলেন, আমরা তদন্ত করে দেখছি, ভবনটি অত্যন্ত বিপজ্জনক বা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এ ভবনে মাত্র একটি সিঁড়ি। আমাদের কাছে ভবনটিকে মনে হয়েছে অনেকটা আগুনের চুল্লির মতো। এই ভবনটিতে অগ্নিকা-ের ঘটনায় যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের মধ্যে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করার চেয়ে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণের হারই বেশি।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকা মেডিক্যালে ১৪ জন ও বার্ন ইনস্টিটিউটে আটজন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের বেশির ভাগের শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। তাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর। এর বাইরেও কেউ কোথাও ভর্তি আছেন কি না, এ তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি।

আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ঢামেক হাসপাতালে সাংবাদিকদের বলেন, বেইলি রোডে অগ্নিকা-ে মোট ৪৬ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে রাজারবাগের কেন্দ্রীয় পুলিশ লাইন্স হাসপাতালে ১ জন, ঢামেক হাসপাতালে ৩৫ জন ও শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ১০ জনের মৃত্যু হয়। ভবনটিতে অগ্নিনিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা ছিল না বললেই চলে। আমরা প্রাণপণে চেষ্টা করেছি সবাইকে নিরাপদে বের করে আনার জন্য। হতাহতের ঘটনা আছে। কেউ কেউ আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। এর বাইরে অনেকেই দম বন্ধ হয়ে বা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

যেভাবে আগুনের সূত্রপাত: গতকাল ক্ষতিগ্রস্ত ভবন পরিদর্শন শেষে পিবিআই ধারণা করেছে, গ্যাসের লাইন থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। আগুন লাগার ঘটনা এবং পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রথমে ভবনের নিচতলায় আগুন লাগে। তারপর দোতলায় লাগে। পরে তা মুহূর্তের মধ্যেই ভবনজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এর কিছুক্ষণের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। এর পাশাপাশি ক্রেনের সাহায্যে ভবনের ওপরের তলা থেকে মানুষদের নামিয়ে আনতে থাকে।

টিটু নামের একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, আগুন দগ্ধ হয়ে ক্ষতি হওয়ার চেয়ে ধোঁয়ায় মানুষ আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যারা এই ভবনে ছিলেন তাদের বেশির ভাগই ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্টে ভুগেছিলেন। তাদের শরীরে পোড়ার ক্ষত তেমন হয়নি। ভবনটির তৃতীয় তলায় একটি পোশাকের দোকান ছাড়া অন্য সব তলায় রেস্তোরাঁ ছিল। এসব রেস্তোরাঁয় অনেক গ্যাস সিলিন্ডার ছিল। সেগুলো বিস্ফোরিত হয়ে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। রাফি নামে আরেকজন বলেন, ভবনের ভেতরে বড় বড় গ্যাস সিলিন্ডার ছিল। সেগুলোতে আগুন ধরে যাওয়ায় লোকজন বের হতে পারেননি। আগুন ধরার কিছু সময় পর এক এক করে সিলিন্ডার ব্লাস্ট হচ্ছিল। ভবনের পুরো ভেতরটা ধোঁয়ায় ঘেরা ছিল বাইরেও ধোঁয়া বেরিয়ে আসছিল।

ভবনের দ্বিতীয় তলায় ‘কাচ্চি ভাই’ নামক রেস্তোরাঁর ম্যানেজার গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, আগুনের সূত্রপাত কোথা থেকে হয়েছে তা আমি বলতে পারব না। কারণ আমি দোতলা থেকে আগুন দেখে নিচে আসছি। ওইখানে চুম্বকের কিচেন ছিল। আমি বের হয়ে দেখি ওই চুম্বকের পুরোটাই আগুন বের হচ্ছে। তারপর ফায়ার ব্রিগেড আসছে। তখন আমি আগুনের ভেতর দিয়ে বের হয়েছি।

তিনি বলেন, আমি যখন রাত ৯টা ৫০ বাজে, তখন আমি দ্বিতীয় তলা থেকে গ্লাসের ফাঁক দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি ধোঁয়া বের হচ্ছে। তখন আমি আগুনের ভেতর দিয়ে নিচে বের হই। তারপর সবাইকে সতর্ক করে বলি বিল্ডিংয়ে আগুন লাগছে। সবাই নিচে নেমে আসুন। তারপর আমার স্টাফদের বলছি এক্সটিংগুইশার নিচে ফালাও। আমি নিজে এক্সটিংগুইশার দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছি। আসলে যে আগুন লেগেছে তা এক্সটিংগুইশার দিয়ে নেভানো সম্ভব হয় নাই। আমার দু’জন স্টাফ মারা গেছে। একজনের নাম কামরুল হাসান রকি, তিনি কাচ্চি ভাইর ক্যাশিয়ার। আরেকজন হলো জিহাদ, সে হলো সার্ভিস ম্যান। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান জানান, এ ঘটনায় মামলা হবে। বিল্ডিং কর্তৃপক্ষ রাজউকের পরিকল্পনা অনুসরণ করেছে কি না এবং প্রয়োজনীয় অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা ছিল কি না এটি তদন্ত করে দেখা হবে।

র‌্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) অতিরিক্ত আইজিপি এম খুরশীদ হোসেন বলেন, নিচতলায় একটা ছোট দোকান ছিল, সেখান থেকে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়েছে। সেখান থেকে আগুন ছড়িয়েছে। এখানে অধিকাংশ যেহেতু রেস্টুরেন্ট ছিল, সেহেতু অনেক গ্যাস সিলিন্ডারও ছিল। সেগুলোতেই আগুন ছড়িয়েছে। প্রাথমিকভাবে তাই ধারণা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, অধিকাংশ মানুষই ধোঁয়ার কারণে শ্বাসরোধে মারা গিয়েছেন। ভবনটিতে একটি মাত্র সিঁড়ি ছিল। দুইটি লিফট ছিল। ফলে আগুন লাগার পর কেউ নামতে পারেনি। কেউ বলছিলেন উপরে আগুন লেগেছে, কেউ বলেছেন নিচে। ফলে মানুষ কোনদিকে যাবে তা বুঝতে পারেনি।

তিনি আরও বলেন, যে ঘটনা ঘটেছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা এখনো তদন্ত শুরু করিনি। কারা সিঁড়িতে সিলিন্ডার রেখেছে তা বের করা হবে। আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি। একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, তারাও রিপোর্ট দেবে। একটি ভবন তৈরির ক্ষেত্রে রাজউকসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে অনুমোদন নিতে হয়। এজন্য একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। সরকার দায়িত্ব দিলে আমরা এ বিষয়ে তদন্ত করব। প্রকৃত ঘটনার খোঁজ নিয়ে আমরা ইন্টেলিজেন্স ইউংয়ের সহায়তায় একটি রিপোর্ট তৈরি করব যোগ করেন র‌্যাব প্রধান।

চার তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে বেঁচে যান আফজাল হোসেন: শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে চিকিৎসাধীন আফজাল এই প্রতিবেদককে জানান, আগুন, ধোঁয়া ও একের পর এক মানুষকে মারা যেতে দেখে তিনি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তার মতো আরেক শিক্ষার্থী সহকর্মী আসিফ মারা যান। তিনি সিঁড়ি বেয়ে চারতলায় উঠে যান। ছাদের দরজা বন্ধ থাকতে পারে এই ভয়ে ছাদে যাননি। আর আগুনকালো ধোঁয়ায় নিচে নামার কোনো উপায় ছিল না। যেদিকে যান কালো ধোঁয়া। পরে চারতলায় হাত দিয়ে থাই গ্লাস ভেঙে ওপর থেকে লাফ দেন। তার আগে আরও কয়েকজন লাফিয়ে পড়েন। আফজাল জানান, নিচে পড়ার পর তার আর কিছুই মনে নেই। এখন তার কোমরে প্রচ- ব্যথা। শরীর নাড়াতে পারছেন না। থাই গ্লাস ভাঙার কারণে হাত কেটে গেছে।

আফজালের পাশের শয্যায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন আগুন লাগা ভবনের ছয়তলায় অবস্থিত জেস্টি রেস্তোরাঁর শেফ জহিরুল ইসলাম (২৮)। তিনি জানান, ৬ মাস আগে তিনি জেস্টিতে যোগ দেন। কাজ করার সময় পোড়া গন্ধ পান এবং নিচ থেকে মানুষের হইচই শুনতে পান। আগুন লেগেছে জানার পর তিনি সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে যান। আগুনের তাপে চারপাশ গরম হয়ে উঠেছিল। কালো ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ছাদ থেকে তাকে উদ্ধার করেন।

লাফিয়ে পড়ে আহত কাজী নওশাদ আনান (২১) নামের এক শিক্ষার্থী ওই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। ওয়ার্ডের বাইরে নওশাদের বাবা কাজী তসলিম উদ্দিন জানান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাওয়ার কথা ছিল তার ছেলের। এর আগে তার ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে ওই ভবনের একটি রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিলেন। তারও যাওয়ার কথা ছিল। একটি কাজে আটকে যাওয়ায় তিনি যেতে পারেননি। ছেলে তাকে বলছিলেন, আব্বু, মনে হচ্ছিল কেয়ামত এসেছে। এখানে-সেখানে মানুষ মরে পড়ে আছে। বাবা জানান, তার ছেলে পাঁচতলা থেকে একটি তার বেয়ে নিচে নামার চেষ্টা করেন। নিচ থেকে দেড়তলা সমান জায়গা বাকি থাকতে তারটি দৈর্ঘ্যে শেষ হয়ে যায়। ওই উচ্চতা থেকে তার ছেলে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে আহত হন। কোমরে ব্যথা পেয়েছেন। শ্বাসকষ্টও রয়েছে।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের অরেঞ্জ ইউনিটের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক প্রদীপ চন্দ্র দাস ইনকিলাবকে বলেন, বেইলি রোডের বহুতল ভবনে আগুন লাগার ঘটনায় কার্বন মনোক্সাইডের বিষক্রিয়ায় এতো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। রাতে যে ১০ জন মৃত ব্যক্তিকে পাওয়া গেছে, তাদের পরীক্ষা করে দেখা গেছে, তারা আগুনে না পুড়লেও বিষাক্ত ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। এই ইউনিটে চিকিৎসাধীন ১১ জনের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, তাদের নিশ্বাসের সঙ্গে কার্বন মনোক্সাইড দেহে প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে কেউ কেউ বাঁচার জন্য ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত হয়েছেন।

১ মার্চ বড় মেয়ের জন্মদিন পালন উপলক্ষে আগের দিন দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে জেস্টি নামের রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিলেন অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং প্রতিষ্ঠানটির বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান। আহমেদ কামরুজ্জামান সকালে এই প্রতিবেদককে বলেন, ছাদে চলে যাওয়ায় তারা প্রাণে বেঁচে গেছেন। স্ত্রী ও দুই সন্তান এখনো ভীত হয়ে আছে। পরিচিত চিকিৎসকদের কাছ থেকে মুঠোফোনে ওষুধ নিয়েছেন তারা। তিনি বলেন, বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে বলে নাকে গন্ধ আসার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারি এটা সিনথেটিক পোড়া গন্ধ। রেস্তোরাঁর লোকেরা বলছিল, অনেক রেস্তোরাঁ রয়েছে। এটা রান্নার গন্ধ। আমি তাদের ধমকে গ্লাসের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখি, রাস্তায় দাঁড়িয়ে লোকজন ভবনের দিকে আঙ্গুল তুলে চিৎকার করছে। থাই গ্লাস হওয়ায় ভালো করে শোনা যাচ্ছিল না। আগুন বুঝতে পারার পর কোনো দ্বিধা ছাড়া পরিবারের সবাইকে নিয়ে ছাদের দিকে রওনা দিই। ভাগ্যক্রমে ছাদের দরজা খোলা ছিল। তিনি বলেন, ভবনটিতে অনেক রেস্তোরাঁ। কমপক্ষে ৫০টির মতো গ্যাস সিলিন্ডার ছিল সিঁড়ি, করিডোর ও রান্নাঘরগুলোয়। এ রকম কাঁচঘেরা একটি ভবনে অনেক রেস্তোরাঁ, গ্যাস সিলিন্ডার সব মিলিয়ে পুরো ভবনটি সুপ্ত বোমা হয়ে গেছে। ওই ভবনে তিতাসের গ্যাস সংযোগ আছে কি না, তিনি নিশ্চিত নন।

ভবনের সর্বশেষ অবস্থা: সিআইডির সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে রাত ২টা ২০ মিনিটের দিকে ঘটনাস্থলকে ‘ক্রাইম সিন’ ঘোষণা দিয়ে ভবনটির সামনে হলুদ ফিতা আটকে দেন। সকাল থেকে ভবনটির সামনে বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য অবস্থান করতে দেখা গেছে। এছাড়াও ভবনটির সামনে উৎসুক জনতার ভিড় ছিল। অধিকাংশ উৎসুক জনতা পোড়া ভবনটির সামনে সেলফি তুলছিলেন। কেউবা নিজেদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে লাইভে গিয়ে ভবনটি সম্পর্কে বিস্তারিত বলছিলেন।

ভবনের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে ওই ভবনের পাশের ভবনের বাসিন্দা ঋদ্ধ বলেন, আগুন লাগার পর ধোঁয়া চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। আমি আমার আম্মা আর ছোট বোনকে নিয়ে দ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে পড়ি। আগুন লাগা ভবনটিতে আমরা মাঝেমধ্যেই কাচ্চি খেতে যেতাম। চোখের সামনে সবকিছু তছনছ হয়ে গেলো। আগুন নেভানোর পর থেকেই মানুষ এখানে এসে ছবি তুলছেন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
Situs Toto
Toto Gacor
bacan4d
bacansport login
slot gacor
pasaran togel resmi
bacan4d
toto togel
slot toto
Toto slot gacor
bacan4d
slotgacor
bacan4d rtp
bacan4d
bacan4d toto
bacan4d toto
bacan4d
bacan4d
Slot Toto
bacan4d
bacan4d login
totoslotgacor
slot gacor
TOTO GACOR
bacan4d
bacan4d slot gacor
bacan4d login
Bacan4d
bacan4d
bacan4d bonus
Toto gacor
Toto gacor
slot gacor hari ini
bacan4d toto
bacan4d toto
bacan4d
bacan4d
bacan4d
toto slot
bacan4d
bacan4d link alternatif
slot gacor bett 200
situs toto
SITUS TOTO
toto 4d
Slot Toto
Slot Toto
Slot Toto
Situs toto
Slot toto
Slot Dana
Slot Dana
Judi Bola
Judi Bola
Slot Gacor
toto slot
bacan4d toto
bacan4d akun demo slot
bacantogel
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacantoto
bacan4d
Bacan4d Login
slot demo
Bacan4d Toto
toto gacor
Slot Gacor
Live Draw
Live Draw Hk
Slot Gacor
toto slot
Bacan4d slot gacor
toto macau
toto slot
Toto Gacor
slot dana
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
Slot Dp Pulsa
Bacan4d Login
toto slot
Bacansports/a>
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
slot gacor
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
slot demo
toto slot gacor
bacansports Slot toto toto slot Slot toto Slot dana Slot toto slot maxwin slot maxwin toto slot toto slot slot dana
Toto Bola
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
bacan4d
ts77casino
situs toto
slot pulsa
bacansports
situs toto
slot toto
situs toto
slot toto
situs toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansports
slot toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
situs toto
situs toto
xx1toto
toto slot
xx1toto
xx1toto
slot qriss
Slot Toto
slot dana
situs toto
slot toto
slot dana
Situs Toto Slot Gacor
xx1toto
xx1toto
bacan4d
xx1toto
xx1toto
toto slot
situs toto slot gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
situs toto
Slot Toto
Toto Slot
Slot Gacor
Slot Gacor
Slot Gacor
slot toto
Toto Slot
slot gacor
situs togel
Toto Slot
xx1toto
bacansport
bacan4d
toto slot
situs toto
slot gacor
Toto Slot
slot maxwin
slot demo
bacan4d toto slot
bacan4d toto slot
bacan4d slot
bacan4d slot
bacan4d slot
bacansports
bacansports
bacansports
bacan4d slot
bacan4d slot
bacan4d
slot gacor
pasaran togel resmi
situs toto
bacan4d login
pasaran togel
pasaran togel
situs toto
bacan4d
bacan4d gacor
bacan4d slot
bacan4d rtp
bacan4d rtp
bacan4d slot gacor
toto slot
situs toto
bacan4d
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
toto gacor Toto Gacor bacan4d slot toto casino slot slot gacor bacantoto totogacorslot Toto gacor bacan4d login slotgacor bacan4d bacan4d toto Slot Gacor toto 4d bacan4d toto slot bacan4d slot gacor