নির্বাচনের আগে গ্রামীণ সড়ক তালিকাভুক্তির প্রস্তাবের হিড়িক
নির্বাচনের আগে নতুন গ্রামীণ সড়ক নির্মাণের তালিকা প্রস্তুত ও পুরোনো সড়ক সংস্কারের চাপে রয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। এই অবস্থায়, নতুন সড়ক তৈরির বিপুল প্রস্তাবও আসছে পরিকল্পনা কমিশনে।
সারা দেশে নতুন করে ৭৩ হাজার ৩৭৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ৬০ হাজার ১৭৭টি পল্লী সড়ক তালিকাভুক্ত করার প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য জমা দিয়েছে এলজিইডি, যা গত বছরের তুলনায় আটগুণ বেশি।
এলজিইডির প্রতি কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে গড় ব্যয় এখন ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা। সে হিসাবে, মোট ব্যয় চলতি বছরের বাজেটে গ্রামীণ সড়কের জন্য যে বরাদ্দ, তার চেয়েও অনেক বেশি দাঁড়ায়। তারপরও সরকারি সংস্থাটি, শহরের সকল সুবিধা প্রত্যন্ত গ্রামগুলোয় পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকা ‘আমার গ্রাম-আমার শহর’ কর্মসূচির সাথে সামঞ্জস্য করে এই তালিকা প্রস্তুত করেছে বলে মতপ্রকাশ করেন এলজিইডির কর্মকর্তারা।
তবে পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা তাদের উদ্বেগ তুলে ধরে জানান, সবগুলো প্রস্তাব একসাথে অনুমোদন দেওয়া হলে তা জাতীয় বাজেটকে চাপের মধ্যে ফেলবে।
২০২২ সালে এলজিইডি মোট ৯ হাজার ৯৫ কিলোমিটারের ৬ হাজার ২৫৭টি পল্লী সড়ক তালিকাভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিল।
২০২১ সালে ২ হাজার ৫৯৩.৭৫ কিলোমিটারের ১ হাজার ৭০০টি পল্লী সড়ক তালিকাভুক্ত করা হয়। এর আগের তিন বছর (২০২১৮-২০) নতুন করে কোনো সড়ক তালিকাভুক্ত করা হয়নি।
সড়কের তালিকা যেভাবে দীর্ঘ হয়েছে
সংশ্লিষ্টরা উল্লেখ করেন, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে সরকারের যে অঙ্গীকার রয়েছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তার প্রস্তুতির আলোকেই এত বেশি সড়ক তালিকাভুক্তির প্রস্তাব এসেছে।
এর আগে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে, ২০১৭ সালের নভেম্বরে এলজিইডি ৩ লাখ ৫২ হাজার ৯৪৩.২৯ কিলোমিটারের ১ লাখ ৫০ হাজার ৬৭৮টি সড়কের শ্রেণিবিন্যাস করে। ওই সময় সংস্থাটি সড়কের দৈর্ঘ্য ও প্রশস্ততা বাড়াতে গুরুত্ব দিয়েছিল। আর এবার সড়ক এলজিইডির তালিকাভুক্তির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
চলতি বছরের শেষে বা আগামী বছরের জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। জানা যায়, গত রোববার এলজিআরডি মন্ত্রী তাজুল ইসলাম– নির্বাচনের আগে দেশের সব গ্রামীণ সড়ক মেরামতের কাজ শেষ করার নির্দেশ দেন।
কিন্তু, অপ্রতুল বরাদ্দের কথা উল্লেখ করে এলজিইডি বলেছে, তাদের সক্ষমতা অনেকটাই সীমিত। চলতি অর্থবছরে সড়ক মেরামতে ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়।
এলজিইডির কর্মকর্তারা জানান, সড়ক মেরামতের এখনই অতিরিক্ত এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। আলোচনার পর অর্থ বিভাগ এই বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছে বলে জানান তারা।
অর্থায়নের চাপ বাড়বে
কর্মকর্তাদের মতে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে এসব সড়কের উন্নয়নে চাহিদা অনুযায়ী তহবিল বরাদ্দ দেওয়াটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, এলজিইডির প্রতি কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে এখন ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা টাকা ব্যয় হয়।
কিন্তু, পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাবে ২০১৭ সালে গেজেটভুক্ত বেশিরভাগ সড়কের উন্নয়নে পরিকল্পিত অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হয়নি। ফলে এখন নতুন সড়কের কারণে উন্নয়ন কার্যক্রমে অর্থ ব্যয় করা কঠিন হয়ে পড়বে। এছাড়া অগুরুত্বপূর্ণ সড়কও তালিকাভুক্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এতে অর্থের অপচয় হবে।
একসঙ্গে এত বেশি সংখ্যক সড়কের তালিকাভুক্তির প্রস্তাবকে ‘অস্বাভাবিক’ বলে অভিহিত করেন অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা জিল্লুর রহমান।
তিনি বলেন, সঠিকভাবে যাচাইয়ের পর পর্যায়ক্রমে গ্রামীণ সড়কগুলো এলজিইডির তালিকাভুক্ত করা গেলে পরিকল্পিত উন্নয়ন করা সম্ভব হবে। অনেক বেশি সড়ক তালিকাভুক্তিতে অগুরুত্বপূর্ণ সড়কও এতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ পাবে। অগুরুত্বপূর্ণ সড়কের উন্নয়নে বিনিয়োগ হলে- তাতে সম্পদের অপচয় হবে।
পাইকারি হারে সড়ক গেজেটভুক্তির অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।
সূত্রগুলো জানায়, নতুন সড়ক তালিকাভুক্তির প্রস্তাব বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের নিরীক্ষাধীন রয়েছে।
ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান টিবিএসকে বলেন, নতুন সড়ক তালিকাভুক্তির চেয়ে বর্তমান সড়কগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণে জোর দেওয়া হয়েছে। এখন যে সড়কগুলো নতুন করে তালিকাভুক্তির জন্য এসেছে, সেগুলো একসঙ্গে তালিকাভুক্ত করা হলে- সরকারের বাজেটের ওপর চাপ পড়বে। এ কারণে যাচাই-বাছাই করে গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোকে অগ্রাধিকার পর্যায়ক্রমে তালিকাভুক্তি করা হবে।’
পরিবেশের জন্যও হুমকি
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ পল্লী সড়ক তালিকাভুক্তির আগে তার যথাযথ সমীক্ষা করার ওপর গুরুত্ব দেন। সমীক্ষা ছাড়া রাস্তা নির্মাণের কারণে পরিবেশগত ঝুঁকি সৃষ্টি হয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, হাওর এলাকায় যথাযথ সমীক্ষা ছাড়া সড়ক উন্নয়নের কারণে এখন বন্যা হচ্ছে। গ্রামেও অপরিকল্পিত সড়কের জন্য এখন জলাবন্ধতা দেখা দিয়েছে।
এলজিইডি কেন আরো সড়ক চায়
এলজিইডি’র কর্মকর্তারা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, সারা দেশে এলজিইডির উপজেলা অফিসের তথ্যের ভিত্তিতে প্রস্তাবিত সড়কের তালিকাটি করা হয়েছে। তবে প্রস্তাব পাঠানোর আগে সড়কগুলো এলজিইডির স্থানীয় অফিসের মাধ্যমে যাচাই করা হয়েছে।
এলজিইডি’র প্রধান প্রকৌশলী সেখ মোহাম্মদ মহসিন টিবিএসকে বলেন, এলজিইডি সারা দেশে ‘আমার গ্রাম-আমার শহর’ প্রকল্পের অধীনে গ্রামীণ যোগাযোগ উন্নয়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। প্রকল্পের কারিগরি দিকগুলোর সমীক্ষায় সারা দেশের গ্রামগুলোয় উন্নত সড়ক যোগাযোগ স্থাপনে প্রচুর সড়কের তালিকা এসেছে, যা এলজিইডি’র তালিকাভুক্ত করতে হবে। সম্প্রতি করা সমীক্ষার ভিত্তিতেই নতুন প্রস্তাবটি দেওয়া হয়েছে।
উপযোগিতা নিশ্চিত করতে জরুরি ভিত্তিতে এসব সড়কের আরো উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দেন এলজিইডির কর্মকর্তারা।
অনেক গ্রাম এখনও পাকা সড়কের নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন। তাই পল্লী সড়কগুলোর নতুন আইডি যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে তারা আরো বলেন, বরাদ্দের যোগ্য হতে হলে প্রতিটি সড়ক শনাক্তকারী ইউনিক নম্বর থাকতে হয়।
দুর্বল কাজের মান, উচ্চ মেরামতের খরচ
বিগত কয়েক দশকে দেশের গ্রামীণ এলাকায় সড়ক সংযোগে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু, নির্মাণের এক বছরের মধ্যেই এগুলোর অধিকাংশ চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। তাই সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার কাজে বার্ষিক বরাদ্দের অন্তত এক-পঞ্চমাংশ ব্যয় করতে হয় এলজিইডি-কে।
সড়ক প্রকৌশলীরা এজন্য বন্যা ও ভারী যানবাহনকে চলাচল দায়ী করে বলেছেন, একারণে সড়কগুলো খানাখন্দে ভরে যায়। কিন্তু, এর পেছনে নির্মাণ কাজের মান ও উপকরণও দায়ী।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন প্রকল্প তরারকির সংস্থা- বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, নিম্ন-মানের ইট ও বালু দিয়ে হয় গ্রামীণ সড়কের নির্মাণ কাজ। একারণেই স্বল্পস্থায়ী হয়। ‘অনেক সময় দেখা গেছে, টেন্ডারে জেতা ঠিকাদার সাব–কন্ট্রাক্টরের কাছে কাজ বিক্রি করে দেয়, তখন তারা খরচ কমাতে নিম্ন-মানের উপকরণ ব্যবহার করে। এলজিইডির উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও এর পেছনে হাত থাকে।’
তিনি আরো জানান, সাম্প্রতিক সময়ে নির্মাণসামগ্রীর মূল্য বাড়ার কারণেও নিম্ন-মানের সামগ্রীর ব্যবহার বেড়েছে। এক্ষেত্রে উপজেলা পর্যায়ে তদারকিরও অভাব রয়েছে।
সড়ক নির্মাণের নিম্ন মানের জন্য অদক্ষ ঠিকাদার ও দুর্নীতি দায়ী বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক আকতার মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক লবিংয়ের কারণে গ্রামীণ সড়কের কাজ পায় নিম্ন-মানের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। স্থানীয় পর্যায়ের এলজিইডি প্রকৌশলীরাও ঠিকভাবে তদারকি করেন না।’
তবে মাদারীপুরের শিবপুর উপজেলার এলজিইডি প্রকৌশলী খন্দকার গোলাম শওকত দাবি করেন, উপজেলা পর্যায়ে মান পরীক্ষার জন্য ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হলে- নিম্ন মানের নির্মাণ উপকরণ ব্যবহারের প্রবণতা কমবে। ইতোমধ্যেই তার উপজেলায় এই প্রবণতা কমেছে বলেও জানান তিনি।