Hot

বিদেশে মূল্যহ্রাস দেশে দীর্ঘশ্বাস

এবার একটু আগেভাগেই হ্রাসকৃত মূল্যে আসন্ন রমজানের প্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি শুরু করেছে ব্রিটিশ সুপার মার্কেট চেইন আসদা স্টোরস লিমিটেড। ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডে ব্যবসা করা প্রতিষ্ঠানটি রমজানের অন্তত দেড় মাস আগে থেকেই মুসলিম ভোক্তাদের কাছে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ হ্রাসকৃত মূল্যে ভোজ্য তেল, চালসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করছে। আসন্ন রমজানে রোজাদারদের স্বস্তি দিতে মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়া ও ইউরোপের অনেক দেশেই হাজার হাজার পণ্যে বিশেষ ছাড় থাকবে।

শুধু বাংলাদেশই এর ব্যতিক্রম। রমজান কেন্দ্র করে এ দেশের ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা করার প্রবণতা দেখা যায়। আর পণ্যমূল্য সহনীয় রাখতে ব্যাপক তোড়জোড় চালাতে হয় সরকারকে। রোজার সময়টাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা যখন হ্রাসকৃত মূল্যে পণ্য কেনার সুযোগ পাচ্ছেন, সেখানে বাংলাদেশের ভোক্তাদের দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হচ্ছে, উচ্চমূল্যে নিত্যপণ্য কিনতে গিয়ে।

গত দুই বছর ধরে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে এমনিতেই নাকাল অবস্থা জনসাধারণের। ডলারের উচ্চমূল্য, আমদানি ঋণপত্র কমে যাওয়ার পাশাপাশি অতি মুনাফালোভী একশ্রেণির ব্যবসায়ীর কারসাজির কারণে প্রায় সব পণ্যই বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে। ডলার সংকট, এলসি (্ঋণপত্র) খুলতে না পারাসহ আমদানিতে নানা সীমাবদ্ধতার দোহাই দিয়ে পণ্যের উচ্চমূল্য ধরে রাখা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পণ্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে এলেও বাংলাদেশে তা কমেনি। বরং আসন্ন রোজায় বাড়তি চাহিদা কেন্দ্র করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়াতে নানান সিন্ডিকেট তৎপরতা শুরু করেছে। এবার দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান রোজায় দেশের চাহিদার অর্ধেক পণ্য একাই আমদানি করেছে বলে জানিয়েছে।

শুধু আমদানি পণ্যই নয়, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যও অস্বাভাবিক মূল্যে কিনতে হচ্ছে। এবার ভরা মৌসুমে আলু-পেঁয়াজের মূল্যও অস্বাভাবিক। একইভাবে শীতকালীন সবজি এবার যে মূল্যে বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন সময় কখনই তা দেখা যায়নি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে উৎপাদন বেশি হওয়ার পরও চালের দাম নিয়ে কারসাজি চলছে। ঘোষণা ছাড়াই বাড়ানো হয়েছে সয়াবিন তেলের দাম। নির্বাচনের আগে গরুর মাংসের দাম কেজি ৬৫০ টাকা বেঁধে দিলেও সেটা এখন আবার আগের মতো ৭৫০-৮০০ টাকা কেজিতে ফিরে গেছে।

নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরই বাজার নিয়ন্ত্রণকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে। আসন্ন রোজায় যাতে জরুরি পণ্যের দাম না বাড়ে, সেজন্য সোমবার চার পণ্যে শুল্ক কমানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, রোজায় যাতে পণ্যমূল্য নিয়ে কারসাজি কিংবা সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত না ঘটে এমন উদ্যোগ ইতিমধ্যেই নেওয়া হয়েছে। ডলার সংকট, ঋণপত্র খুলতে না পারাসহ যেসব অভিযোগ ছিল, রোজায় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে তা সহজ করে দেওয়া হয়েছে। কেউ কারসাজি, মনোপলি, সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ইত্যাদির মাধ্যমে মূল্য বাড়িয়ে দেওয়া বা অস্থিরতা তৈরি করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে ইতিমধ্যেই এ মেসেজটি সব ব্যবসায়ী, আমদানিকারকের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এটি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা।

তিনি বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যেই রোজার পণ্যমূল্য, চাহিদা-সরবরাহ ইত্যাদি বিষয়ে শীর্ষ করপোরেটদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তারা কমিটমেন্ট করেছে, এবারের রোজায় ব্যবসায়ীরা খোলাবাজারে কিছু পণ্য ছাড়ে বিক্রি করবেন। এ ছাড়া টিসিবির মাধ্যমে কম দামে এক কোটি পরিবারকে রোজার দুই-তিনটি পণ্য দেওয়া হবে।’

বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, হঠাৎ করে যাতে আমদানি বন্ধ না হয়ে যায়, সে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। রোজার আগে ভারত থেকে পেঁয়াজ ও চিনি আসবে। উৎপাদন, আমদানি থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত এমনভাবে সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে, যাতে চাইলেই কেউ কারসাজি করতে না পারে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের শীর্ষস্থানীয় অনলাইন শপিং প্ল্যাটফর্ম নুনডটকম অনেক পণ্যের ওপর ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি শুধু নিত্যপণ্য নয়, রমজান উপলক্ষে মোবাইল ফোন, টিভি, ল্যাপটপ, হোম অ্যাপ্লায়েন্সসহ বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের হাজারো পণ্যে বড় ধরনের ছাড় দিয়ে থাকে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে রমজান মাস শুরু হওয়ার এক মাস আগে থেকেই মূল্যছাড় দেওয়া হয়। তবে রমজানের ১০ দিন আগে সেটি বেড়ে যায় অনেকাংশে। গত বছর দেশটির প্রায় ছয় হাজার পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হয়। অনলাইনে পণ্য কিনলেও দামে ছাড় পাওয়া যায়। গত বছর রমজান উপলক্ষে প্রায় ৮০০ নিত্যপণ্যের দাম কমিয়ে দেয় কাতার সরকার। প্রতিবছর রমজানে প্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর ২০-৩০ শতাংশ মূল্যছাড় দেওয়া হয় ওমানে।

একইভাবে মালয়েশিয়ার সব ছোট-বড় দোকানে চলে বিশেষ মূল্যছাড়। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসসহ সব পণ্যের দাম কমানো হয় অন্যান্য সময়ের চেয়ে। কত টাকা কমানো হয়েছে ক্রেতাদের দেখানো হয় সেই মূল্যতালিকা। ত্যাগের এই মাসে মানুষকে স্বস্তি দিতে নিত্যপণ্যে ৩০-৭০ শতাংশ দাম কমান সৌদি আরবের ব্যবসায়ীরা। বাহরাইনেও রমজান মাসে প্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর ২০-৬০ শতাংশ মূল্য ছাড় পান ক্রেতারা। শুধু মুসলিম দেশই নয়, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, কানাডায় মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় রমজানে নিত্যপণ্যের ওপর বিশেষ মূল্যছাড় দেওয়া হয়।

জার্মানির ফ্রাংকফুর্টে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশি মরিয়ম হালদার জানান, এখানকার খুচরা দোকানে সারা বছরই বিভিন্ন পণ্যে ছাড় থাকে। তবে রোজা কিংবা মুসলমানদের অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবে তুরস্ক ও মরক্কোর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো মাংস, সবজি, ফলমূলসহ রোজায় প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যে ২৫-৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিয়ে থাকে।

অথচ বাংলাদেশের বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, রমজানের দুই-তিন মাস আগে থেকেই দ্রব্যমূল্য বাড়তে শুরু করে। আর রোজা শুরু হলে সর্বোচ্চ দামের দেখা মেলে। এ সময়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়, কে কত বেশি মূল্য নিতে পারছে।

সরকারি বিপণনকারী সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছর রমজানে ঠিক দুই-তিন মাস আগে থেকেই তেল, ছোলা, পেঁয়াজ ও খেজুরের দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে যায়। সেই হিসেবে ২০২১ সালে রোজার সময়ে সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, ছোলা, চিনি, খেজুরের দাম ১০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তে দেখা যায়। ২০২২ সালে রোজায় সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে ১০ টাকা বেড়ে ১৬০-১৬৫, পেঁয়াজ ২৫ টাকা থেকে ৩৫, চিনি ৭৫ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। রোজায় দাম বৃদ্ধির এ চিত্র অপরিবর্তিত ছিল ২০২৩ সালেও। ডলারের কারণে আগেই দাম বেড়ে যাওয়া পণ্য রোজায় আরও বেশি দামে কিনতে হয়েছে জনসাধারণকে।

বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের বাজার তদারকি সংস্থাগুলোর দুর্বলতার কারণে বছর জুড়েই মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা পণ্যের দামে অরাজকতা তৈরি করে রাখে। কিন্তু সরকার যদি কৃষক পর্যায় থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত পণ্যের দামের সঠিক তথ্য সংগ্রহ করত, তাহলেই সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারত। আর সেটা হলে বছর জুড়েই দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল থাকত।

কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা মনে করেন বছরের বাকি ১১ মাসের ব্যবসা রমজানের এক মাসেই করে ফেলবেন। এমন প্রবণতার মূল কারণ, আমরা যতটা ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী, কর্মে ততটা বিশ্বাসী নই। যার ফলে সংযমের মাস রমজানকে মোক্ষম সময় ধরে ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা করে পুরো বছরের আয় করে নিতে চান।’

তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের বাজার তদারকি সংস্থাগুলো মাঠপর্যায়ে থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত পণ্যমূল্যের সঠিক হিসাব রাখে না। তাদের দুর্বলতার কারণে ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিচ্ছেন বারবার।’

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘রমজান মাসে দ্বিগুণ পণ্যের দরকার পড়ে। সেই সুযোগ কাজে লাগায় অসাধু ব্যবসায়ীরা। এর জন্য তারা রমজানকে সর্বোচ্চ মুনাফার লক্ষ্য ধরে রাখে। বছর জুড়ে পণ্যের যে পরিমাণ মুনাফা করে, রমজান এলেই তার থেকে বেশি লাভের প্রবণতা তাদের মধ্যে দেখা যায়। ব্যবসায়ীদের এমন প্রবণতা রোধে আমরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছি।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d