Bangladesh

বৈষম্য ও সুশাসনের ঘাটতি অর্থনীতির প্রধান বাধা

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বৈষম্য ও সুশাসনের ঘাটতি। ফলে সমাজ অন্যায্য হয়ে পড়েছে। সর্বত্র চলছে সুবিচারের সংকট। এ ছাড়া দেশে এখনও গণতন্ত্র স্থিতিশীল হতে পারেনি। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত ‘আগামীর বাংলাদেশের জন্য ১০ করণীয়’ শীর্ষক আব্দুল গফুর স্মৃতি বক্তৃতায় এসব কথা বলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা। গতকাল বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে সংস্থার নিজস্ব কার্যালয়ে বিআইডিএস এর আয়োজন করে। এতে জাপানের এশিয়ান গ্রোথ ইনস্টিটিউটের (এআইজি) ভিজিটিং প্রফেসর নজরুল ইসলাম মূল বক্তব্য দেন। আলোচনায় অংশ নেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. রেহমান সোবহান, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. রওনক জাহান, বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক ড. কাজী ইকবাল প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন। 

মূল বক্তৃতায় অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের আগামীর করণীয় হিসেবে ১০ প্রস্তাব করেন। তার মধ্যে রয়েছে– অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস, সুশাসন অর্জন, গণতন্ত্রের মানোন্নয়ন ও আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থার প্রবর্তন, পরিবেশ রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং গ্রাম পরিষদ গঠন। এ ছাড়া ভৌগোলিক বৈষম্যের অবসান, সামাজিক সংহতি বৃদ্ধি, নারী, শিশু, তরুণ ও বৃদ্ধদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ, সর্বজনীন সামরিক শিক্ষা প্রবর্তন ও সার্বভৌমত্ব শক্তিশালীকরণ এবং নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করা। 

তিনি বলেন, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়– এই স্লোগানের বাস্তবতা প্রশ্নসাপেক্ষ। এবার নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন দেশের টানাটানির ঘটনা দেখা গেছে। বৈদেশিক নীতির স্বচ্ছতা থাকা দরকার। কোন দেশকে আমরা কী সুবিধা দিচ্ছি, তার স্বচ্ছতা থাকা দরকার। এসবের জন্য জনগণকে আস্থায় নিতে হবে। তাদের বাদ দিয়ে কোনো সিদ্ধান্তের সুফল আশা করা যায় না। মোটকথা, আমাদের প্রকৃতই একটি বৈদেশিক নীতি প্রয়োজন। যেখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকবে। 

এই ১০ প্রস্তাবের প্রতিটির বাস্তবতা এবং কেন প্রবর্তন করতে হবে, তার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। রাজনীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশে এখনও গণতন্ত্র স্থিতিশীল হতে পারেনি। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি; বরং রাষ্ট্রক্ষমতা প্রভাবশালী গোষ্ঠীকে সুবিধা দিচ্ছে। এতে অবৈধ ও অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। এসব কারণে গণতন্ত্রের গুণগত মানের উন্নয়ন হয়নি। রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা আসেনি। এ ক্ষেত্রে সংস্কার হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠতাভিত্তিক নির্বাচনী ব্যবস্থা ত্যাগ করে আনুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থায় যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। 

অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশে অর্থনৈতিক অসমতা বেড়েছে। বিশেষ করে আয় বিতরণ অত্যন্ত বৈষম্যপূর্ণ পর্যায়ের। অর্থনৈতিক বৈষম্য রাজনৈতিক বৈষম্য ডেকে আনে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর উচ্চবিত্ত শ্রেণির প্রভুত্ব কায়েম হয়। এ কারণে সরকারের বিভিন্ন নীতি সিদ্ধান্ত বিত্তবান শ্রেণির স্বার্থে ব্যবহার হয়। এসবের ফলে সাধারণ মানুষ এবং রাষ্ট্রের কল্যাণকামিতা কমতে থাকে। এ বাস্তবতায় বৈষম্য হ্রাস শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং অত্যন্ত জরুরি। বৈষম্য কমানো সম্ভব না হলে দেশের রাজনৈতিক ও নীতিনির্ধারণী কাঠামোতে বিত্তশালীদের প্রভাব বাড়তেই থাকে। বৈষম্য কমানো কঠিন হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিকে তিনি ‘বৈষম্য ফাঁদ’ হিসেবে উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, অসম আয় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বিদেশি বিলাসী পণ্যের চাহিদা তৈরি করেছে। এতে আমদানিতে চাপ বেড়েছে। বৈষম্যের কারণে সামাজিক অসন্তোষ তৈরি হয়। বিনিয়োগের পরিবেশের ক্ষতি করে।

সুশাসন প্রসঙ্গে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, সুশাসনের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন ঘটনায় দেখা যায়, সুশাসনের ঘাটতি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকিং এবং আর্থিক খাতের অনিয়ম, পুঁজি পাচার– সব ক্ষেত্রেই ব্যবস্থাপনা মানের অবনমন হয়েছে। 

অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, সমাজ আজ অতিমাত্রায় অন্যায্য হয়ে পড়েছে। সর্বত্র সুবিচারের সংকট। সমাজে আর্থসামাজিক বৈষম্য বিরাজমান। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কিংবা প্রশাসন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের নামে ব্যবসায়ী সমাজ নির্বাচনী কার্যক্রম করায়ত্ত করেছে। দলীয় মনোনয়নকে ভাগ্যবদলের হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছেন তারা। এখানে বিনিয়োগ করেন তারা। এর পর নির্বাচিত হয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের নীতিনির্ধারণে প্রভাব খাটান। অথচ কে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছেন, তা একটি বড় বিষয়। সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা যাতে সম্ভব হয়, সেই চেষ্টা চালাতে হবে। 

সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের সুশাসনের ঘাটতির উদাহরণ হিসেবে ড. রেহমান সোবহান বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন অভিযোগ পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রেও বাছাই পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে। কার ফাইল তলব করা হবে এবং কার ফাইল এড়িয়ে যাওয়া হবে– সে ক্ষেত্রে এখনও সবর্জনীন হতে পারেনি। পুলিশ প্রশাসনও যে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার আগে রাজনৈতিক পরিচয় দেখে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। অন্যায়ভাবে কারও ঋণ পুনঃতপশিলীকরণের সুযোগ দেওয়া হয়। আবার কারও ক্ষেত্রে এই সুযোগ নেই। 

অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, আমাদের সামাজিক সংহতিতে রাজনৈতিক বিভাজন বড় সমস্যা। দলীয় বিভাজনের কারণে এক সরকারের নেওয়া ভালো উদ্যোগ অন্য সরকার বাতিল করে দিচ্ছে। রাজনীতিকরা আসলে সুশাসন চান কিনা– তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সমাজে বৈষম্য চলছে। সামাজিক অনাচার চলছে। প্রশাসনের রাজনীতিকীকরণ হচ্ছে। যাদের হাতে অস্ত্র আছে, তারাই দাপট দেখাচ্ছে। এগুলো বন্ধ না হলে কোনোদিন সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না। 
তিনি বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দলীয় প্রধানের কাছে সব ক্ষমতা। নির্বাচনে তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে মনোনয়ন দিতে পারেন। হোক সে ভালো লোক কিংবা চাটুকার। সরকার দলীয় প্রধানের হাতে রয়ে গেছে। এখানে ভারসাম্য নেই। এ অবস্থার পরিবর্তনের তেমন কোনো সুযোগ দেখা যায় না। 

আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বলেন, সমাজের প্রভাবশালী শ্রেণির রাজনৈতিক ও সামাজিক রূপান্তরের বিষয়টি দেখা দরকার। তিনি বলেন, দেশে গত কয়েক বছরে আয়বৈষম্য বেড়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশে বাংলাদেশের চেয়ে বৈষম্য আরও বেশি। আনুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, বাংলাদেশের বাস্তবতায় এ ধরনের ব্যবস্থা কতটা কার্যকর হবে, তা ভেবে দেখা দরকার।

সভাপতির বক্তব্যে ড. বিনায়ক সেন বলেন, অনেক ক্ষেত্রে হয়তো সফল হওয়া সম্ভব হয়নি। তবে বাংলাদেশের প্রধান সাফল্য হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচন। বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষাবিদ, গবেষক, উন্নয়ন ও পরিকল্পনাবিদরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

Show More

7 Comments

  1. Hello there, I found your blog by the use of Google even as looking for a related subject, your website came up, it seems great.

    I’ve bookmarked it in my google bookmarks.
    Hello there, simply changed into alert to your blog thru Google, and located that it’s truly informative.
    I’m gonna watch out for brussels. I will be grateful if you
    happen to continue this in future. Many people shall be benefited from your writing.
    Cheers!

    Take a look at my web-site – vpn special coupon code (http://vpnspecialcouponcode.wordpress.com/)

  2. I’ve been browsing on-line greater than 3 hours today,
    but I never discovered any attention-grabbing article like yours.
    It is pretty worth sufficient what does vpn stand for me.

    In my opinion, if all webmasters and bloggers made good content as you
    probably did, the web will probably be a lot more useful than ever before.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button