Hot

‘মডেল’ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে ‘ইসি নিজেই মডেল’

নোটেড, কপিড, রাবিশ, ছাড় দেব না বলে নির্বাচনি সময় পার করেন সবাই

পৌরসভায় মডেল নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত ভোটের ‘মডেলে’ পরিণত হয়েছে স্বয়ং নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচনি অপরাধের বিষয়টি দৃষ্টিতে আনা হলে নোটেড, কপিড, রাবিশ, ছাড় দেব না বলে পুরো নির্বাচনি সময় পার করেছেন নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সবাই।

গত ১৭ জুলাই অনুষ্ঠিত পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া পৌর নির্বাচনে প্রশাসনের সামনেই ভোটারদের মধ্যে টাকা বিতরণ, রিটার্নিং অফিসারের সামনেই উপজেলা চেয়ারম্যাান কর্তৃক সাংবাদিককে টাঙ্গিয়ে পিটানোর হুমকি, ভোট শুরুর আগে ৯টি কেন্দ্রের পাঁচটির সিসি ক্যামেরার তার কর্তন, ক্ষমতাসীন দলের বাইরে অন্য দলের নেতাকর্মীদের ভোটের আগেই গ্রেফতার, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ও নির্বাচনি কর্মকর্তাদের পক্ষপাতিত্ব আচরণের গুরুতর অভিযোগগুলো বিন্দুমাত্র আমলে নেয়নি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বরং ভোটের পরে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলে অপরাধীদের অপরাধকে উৎসাহিত করার অভিযোগ এসেছে ইসির বিরুদ্ধে। 

নির্বাচন

একইভাবে পিরোজপুর-২ আসনের অন্তর্গত কাউখালী উপজেলার শিয়ালকাঠি ইউপি ভোটে মনোনয়নপত্র জমার আগের দিন জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন মহারাজ ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘শেখ হাসিনা নৌকা দিসে, কিসের আবার ইলেকশন।’ নির্বাচন ব্যবস্থাপনা নিয়ে এই ধরনের বক্তব্য দিলেও কার্যত ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি ইসি। ঐ হুমকির ঘটনায় বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান মনোনয়ন দাখিল করতে পারেননি। ঐ বক্তব্যসংবলিত সিডিসহ নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছিলেন মনোনয়ন জমা দিতে না পার প্রার্থী ও বর্তমান চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন। কিন্তু কমিশন পুরো বিষয়টিকে এড়িয়ে গিয়ে ঐ শিয়ালকাঠি ইউপিতে ‘শেখ হাসিনা নৌকা দিসে, কিসের আবার ইলেকশন’—বক্তব্যের পক্ষে অবস্থা গ্রহণ করে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নৌকা বিজয়ী করার সুযোগ করে দেয় ইসি নিজেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম ইত্তেফাককে বলেছিলেন, কে কোথায় কী বক্তব্য দিল তা আমাদের জানার সুযোগ নেই। প্রযুক্তির যুগে অনেক কিছুই বানানো যায়। তবুও বিষয়টি খোঁজখবর নিয়ে দেখবো।

নির্বাচন কমিশন

ইসি সচিবের ‘দেখবো’ বক্তব্যই ছিল সর্বোচ্চ ব্যবস্থা। এরপর আর কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। এই ঘটনার পরপরই দৃশ্যপটে চলে আসে বহুল আলোচিত ভাণ্ডারিয়া পৌরসভার নির্বাচন। শুরু থেকে নির্বাচন কমিশন ঐ পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে শক্ত অবস্থানের কথা বললেও বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। পুরো নির্বাচনটাই কালো টাকায় প্রভাবিত ছিল। গত ৬ জুলাই ভাণ্ডারিয়া ভোট পরিদর্শন করে নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান বলেছিলেন, ভাণ্ডারিয়ায় মডেল নির্বাচন চায় ইসি। এর মধ্যে ভাণ্ডারিয়া পৌর নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার জিয়াউর রহমান খলিফা ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ইসিতে দাখিল করেন জাতীয় পার্টি-জেপি মনোনীত প্রার্থী। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ভোটের মাঠ নেতাকর্মী শূন্য করতে জাতীয় পার্টি-জেপির ভাণ্ডারিয়া উপজেলার সাধারণ সম্পাদক উজ্জলসহ ১০ নেতাকর্মীকে মিথ্যা মামলায় কারাগারে প্রেরণ করা হয়। একই সঙ্গে অন্য দলের নেতাকর্মীদেরও গ্রেফতার করা হয়। জেলখানায় নেতাকর্মীদের দেখতে স্থানীয় সংসদ সদস্য ভাণ্ডারিয়াতে যান। তার আগমনে আচরণ বিধিভঙ্গ হয়েছে মর্মে জেপির প্রার্থীকে উলটো শোকজ করেন রিটার্নিং অফিসার। শোকজ শেষে তাকে সতর্ক করা হয়। এরপরও নির্বাচন কমিশন ভোটের দু্ই দিন আগে ১৫ জুলাই ঢাকায় তলব করে। পরবর্তীকালে প্রার্থীর আবেদনে তলব শুনানি ১৩ জুলাই করা হয়। যে অভিযোগে রিটার্নিং অফিসার প্রার্থীকে সতর্ক করেছে সেই একই অভিযোগে কীভাবে ইসি প্রার্থীকে ঢাকায় তলব করল? এই তলবের ঘটনায় প্রকৃতপক্ষে ইসি নিজেই সরকার দলীয় প্রার্থীকে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। যদিও পরবর্তীকালে তলব শুনানি থেকে নিষ্কৃতি পান জেপির প্রার্থী।

তলবের বিষয়ে ইসি বলছে, ডিসি, এসপি ও রিটার্নিং অফিসারের তদন্ত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রার্থীকে ঢাকায় তলব করা হয়। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর আচরণবিধিভঙ্গ, লেমিনেটিং করা পোস্টার ছাপানো, ভোটের মাঠে প্রভাব বিস্তার, রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে সাংবাদিক পেটানো, সিসি ক্যামেরার তার কর্তনের সময় এই রিটার্নিং অফিসার, ডিসি কিংবা এসপিরা কার্যকর ভূমিকা রাখেননি।

নির্বাচন

গত ১৬ জুলাই রাত ৯টায় উপজেলা চত্বরে অবস্থিত ভাণ্ডারিয়া উপজেলা নির্বাচন অফিসে ঢাকা থেকে আগত সাংবাদিকরা রিটার্নিং অফিসারের সাথে মতবিনিময় করছিলেন। হঠাৎ মতবিনিময়ের সময় কক্ষে প্রবেশ করেন স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান মো. মিরাজুল ইসলাম মিরাজ। চেয়ারে বসেই ইত্তেফাক পত্রিকার স্থানীয় প্রতিনিধি সঙ্করকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তোকে সারা দিন বেশ কয়েক বার এ কার্যালয়ের এখানে ঘুরতে দেখছি, তোর এখানে কাজ কী? আবার যদি তোকে এখানে দেখি, তাহলে তোকে উপজেলা চত্বরে টাঙ্গিয়ে পেটাব। এ কথার পর সঙ্করকে ঐ অফিস থেকে বের করে দেয় চেয়ারম্যানের সঙ্গে আসা দুই ব্যক্তি। পরে ঐ ঘটনার সংবাদ প্রকাশ হলে সোমবার সকালে সঙ্করকে পুনরায় টেলিফোন দিয়ে আঙুল কেটে নেওয়ার হুমকি দেন মিরাজ। একই সাথে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেন, যার অডিও নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হয়। 

উপজেলা চেয়ারম্যানের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ নিয়ে বিভিন্ন অনলাইনে সংবাদ প্রকশিত হয়। তাত্ক্ষণিকভাবে ঘটনাটি জানানো হয় নির্বাচন কমিশনে। অপরাধের বিষয়টি জেলা প্রশাসকে জানানো হলে, তিনি লেখেন, ‘নোটেড’, এসপি লেখেন, ‘কপিড’ আর র‌্যাব লেখেন, ‘রাবিশ’। ইসি থেকে বলা হয়, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না, দেখছি। কারোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে এভাবেই পুরো নির্বাচনি সময় পার করে দেন স্থানীয় প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন।

নির্বাচন ভবন

ভাণ্ডারিয়ার ভোটের সাংবাদিক পেটানোর হুমকিদাতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান বলেন, সাংবাদিককে টাঙ্গিয়ে পেটানোর হুমকিদাতা পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মিরাজুল ইসলাম মিরাজকে ছাড়ব না। আমরা বিষয়টি কমিশন বৈঠকে তুলে ব্যবস্থা নেব। তিনি বলেন, আমরা এটি ছাড়ব না। আমরা কমিশনে ওঠাবো। সেই চেয়ারম্যান ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছেন। গত ১৭ জুলাই ভোট হয়েছে, এখনো বিষয়টি কমিশনে ওঠেনি। এত বড় ঘটনাটি কেন ভোটের আগে ব্যবস্থা নেওয়া হলো না? প্রতিপক্ষে প্রতি এত কিসের দুর্বলতা ইসির? এ ধরনের প্রশ্ন সংশ্লিষ্টদের। 

ভাণ্ডারিয়া পৌরসভার নির্বাচন শুরুর আগেই ৯টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে পাঁচটি কেন্দ্রের সিসি ক্যামেরার তার কর্তন করে ফেলে দুর্বত্তরা। তিনটি সচল করতে পারলেও বাকি দুটি অচল ছিল। তারগুলো কেটে নিয়ে যায় তারা। সিসি ক্যামেরা কর্তনের মূল উদ্দেশ্যে ছিল কেন্দ্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ। সেটি তার কর্তন করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে উপজেলা চেয়ারম্যানের অনুসারীরা। একইভাবে প্রতিটি ভোটকেন্দ্র নিজে উপস্থিত থেকে নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ দেওয়া হলেও নির্বাচন কমিশন থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিরোজপুর-২ আসনের সংসদীয় আসনের কর্তন থেকে ইউপি ও পৌরসভার নির্বাচনে একটি সংঘবদ্ধ চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে ইসি। এ ক্ষেত্রে ইসির সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ ওঠে। নিয়ন্ত্রিত ভোটের মডেলে পরিণত হয়েছে স্বয়ং ইসিই।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto