মিউনিখ অটো শোতে চীনের ইলেকট্রিক গাড়ির ঝলক
মার্কিন প্রতিষ্ঠান টেসলা এ খাতে বিপ্লব তৈরি করলেও অল্প সময়ের মধ্যে চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইলেকট্রিক গাড়ি উৎপাদনকারী দেশে রূপান্তরিত হয়েছে।
মিউনিখ অটো শো ২০২৩।
ইলেকট্রিক ভেহিকল (ইভি) বা ইলেকট্রিক গাড়ির জগতে চীন দ্রুত সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি জার্মানির মিউনিখে আয়োজিত অটো শোতে চীনের এই খাতের শক্তিমত্তা প্রকাশ পেয়েছে।
মার্কিন প্রতিষ্ঠান টেসলা এ খাতে বিপ্লব তৈরি করলেও অল্প সময়ের মধ্যে চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইলেকট্রিক গাড়ি উৎপাদনকারী দেশে রূপান্তরিত হয়েছে।
অটো প্রদর্শনীতে চীনের ঝলক
মিউনিখ অটো শোতে নজর কাড়ে চীনের বিওয়াইডি ব্র্যান্ডের গাড়ি।
ইউরোপ নিয়ে চীনের ইলেকট্রিক গাড়ি নির্মাতাদের ব্যাপক আগ্রহের এক ঝলক দেখা গেলো মিউনিখ অটো শো-তে, যেটি আইএএ মোবিলিটি শো নামেও পরিচিত। অটোমোবাইল খাতে এই প্রদর্শনীর স্থান প্রথম সারিতে। এবারের প্রদর্শনীতে চীনা ইলেকট্রিক গাড়ির আধিপত্য চোখে পড়েছে। চীনের নির্মাতারা বেশ প্রস্তুতি নিয়েই ইউরোপের বাজারে প্রবেশ করছে, ফলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে ইউরোপের ইলেকট্রিক গাড়ি নির্মাতাদের আরও কম দামি ও গ্রাহকবান্ধব গাড়ি তৈরি করতে হবে বলে ভাবছেন বিশ্লেষকরা।
চীনের ইলেকট্রিক গাড়ির বাজার
বিশ্বে ইলেকট্রিক গাড়ির সবচেয়ে বড় বাজারও চীন। এ খাতে বেইজিংয়ের সাফল্য অভাবনীয়। গত বছর চীনে যত গাড়ি বিক্রি হয়েছে, তার ২৫ শতাংশই ইলেকট্রিক গাড়ি। যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় এদিক দিয়ে বেশ এগিয়ে চীন। যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হওয়া প্রতি ৭টি গাড়ির ১টি এবং ইউরোপে বিক্রি হওয়া প্রতি ৮টি গাড়ির ১টি ইলেকট্রিক গাড়ি।
এইচএসবিসি ব্যাংক পূর্বাভাষ দিয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে চীনে বিক্রি হওয়া ৯০ শতাংশ গাড়িই হবে ইলেকট্রিক গাড়ি।
টেসলা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লেও চীনের ইলেকট্রিক গাড়িগুলো এখনো সেভাবে চীনের সীমান্ত পার হয়নি। তবে এবার সে চিত্র পাল্টাতে শুরু করেছে।
ইউরোপের বাজারের দিকে চোখ চীনা কোম্পানিগুলোর
মিউনিখ অটো শোতে নজর কাড়ে চীনের লিপমোটর ব্র্যান্ডের গাড়ি।
চীনা ইলেকট্রিক গাড়ি নির্মাতাদের জন্য ইউরোপের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাজ্য।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত চীনা ইভি প্রতিষ্ঠানগুলো ইউরোপে যত গাড়ি বিক্রি করেছে, তার তিন ভাগের এক ভাগই করেছে যুক্তরাজ্যে। এ বছর যুক্তরাজ্যে সব মিলিয়ে যত নতুন গাড়ি বিক্রি হয়েছে, তার পাঁচ শতাংশই চীনা প্রতিষ্ঠানের।
২০২২ সালে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো ইউরোপে যত গাড়ি বিক্রি করেছে, চলতি বছরের সাত মাসেই ছাড়িয়ে গেছে সে বিক্রি।
মিউনিখ অটো শোতে নজর কাড়ে চীনের এক্সপেং ব্র্যান্ডের গাড়ি।
বিওয়াইডি, নিও, এক্সপাংসহ বড় বড় চীনা ইলেকট্রিক গাড়ি নির্মাতার চোখ এখন ইউরোপের বাজারের দিকে। চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে ইউরোপে আট লাখ ২০ হাজার ইলেকট্রিক গাড়ি বিক্রি হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৫৫ শতাংশ বেশি এবং ইউরোপে মোট বিক্রি হওয়া গাড়ির ১৩ শতাংশ।
আগামী বছর ইউরোপের আরও একাধিক বাজারে ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা আছে এক্সপাংয়ের। আর ঝেজিয়াং লিপমোটর টেকনোলজি ঘোষণা করেছে, আগামী দুই বছরে তারা ইউরোপসহ চীনের বাইরের বাজারের জন্য পাঁচটি মডেল বাজারে আনবে।
অটো খাতের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইনোভেভ এর তথ্য অনুসারে, এ বছর ইউরোপের বাজারে যত ইভি বিক্রি হয়েছে, তার আট শতাংশ চীনা কোম্পানির তৈরি। গত বছর এর পরিমাণ ছিল ছয় শতাংশ আর ২০২১ সালে ছিল চার শতাংশ।
এ বছরের মিউনিখ অটো শোতে যত প্রতিষ্ঠান তাদের গাড়ি প্রদর্শন করছে, তাদের ৪১ শতাংশের সদরদপ্তরই এশিয়ায়। এই প্রদর্শনীতে গত বছরের তুলনায় এ বছর চীনা কোম্পানির উপস্থিতি বেড়েছে দ্বিগুণ। বিওয়াইডি ও এক্সপাংয়ের মতো কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি এতে অংশগ্রহণ করেছে চীনের শীর্ষ ব্যাটারি উৎপাদক প্রতিষ্ঠান সিএটিএল।
ইউরোপের বাজারে চীনা ইলেকট্রিক গাড়ির আগমনের ফলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে যে তারা ইলেকট্রিক গাড়ির বিক্রিতে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে।
তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলো
জার্মান অ্যাসোসিয়েশন অব দ্য অটোমোটিভ ইন্ডাস্ট্রির (ভিডিএ) প্রেসিডেন্ট হিলডেগার্ড মুলার বলেন, ‘আমরা (জার্মানি) আমাদের প্রতিযোগিতামূলক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছি’। তিনি আরও বলেন, মিউনিখের অটো শোতে ‘আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার উচ্চ চাপ’ দেখা গেছে। এ খাতে টিকে থাকতে হলে জার্মানির আরও বিনিয়োগ প্রয়োজন।’
২০২২ সালের প্রথমার্ধে চীনে একটি সাধারণ ইলেকট্রিক গাড়ির দাম ছিল ৩৫ হাজার ইউরোরও কম, অথচ একই সময়ে ইউরোপে একটি ইভির দাম ছিল ৫৬ হাজার ইউরো।
ইউরোপের বাজার ধরতে চীনা কোম্পানিগুলোর তীব্র আকাঙ্ক্ষার দিকে ইঙ্গিত করে বিএমডব্লিউর প্রধান নির্বাহী অলিভার জিপসা বলেন, ‘ভিত্তিমূল্যের ইভির বাজার (বেস কার মার্কেট সেগমেন্ট) হয় পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, অথবা কোনো ইউরোপীয় কোম্পানির হাতে এর নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।’
বিএমডব্লিউ এনেছে তাদের নতুন মডেলের গাড়ি, যার নাম ‘নয়্যা ক্লাসা’।
এবারের প্রদর্শনীতে মার্সিডিজ বেঞ্জ তাদের নতুন উদ্ভাবিত ইভি আর্কিটেকচারের সিএলএ কমপ্যাক্ট ক্লাস সেডান নিয়ে এসেছে আর বিএমডব্লিউ এনেছে তাদের নতুন মডেলের গাড়ি, যার নাম ‘নয়্যা ক্লাসা’। দুটি গাড়িই হায়ার রেঞ্জ এবং দক্ষতাকে লক্ষ্য করে তৈরি করা হয়েছে।
ভক্সওয়াগনের প্রধান নির্বাহী অলিভা ব্লুম বলেন, চীনের সঙ্গে অংশীদারিত্ব থাকা স্বত্বেও তারা ব্যাটারির খরচ ৫০ শতাংশ কমানোর পরিকল্পনা নিয়েছে।
অটোখাতের বিশ্লেষক ফার্ডিনান্ড ডুডেনহফার বলেন, চীন ব্যাটারি উৎপাদনে ‘বিশ্বসেরা’। ইভি তৈরিতে যত খরচ হয়, তার প্রায় ৪০ শতাংশই খরচ হয় ব্যাটারি তৈরিতে।