Bangladesh

মূল্যস্ফীতির কারণে পুরো অর্থবছরেই চাপে ছিল সাধারণ মানুষ

বিদায়ী অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। বছর শেষে গড় মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ০২ শতাংশ।

এক যুগের মধ্যে সদ্য বিদায় নেওয়া পুরো অর্থবছরেই সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতির চাপে ছিল সাধারণ মানুষ। ২০১০-১১ অর্থবছরের পরে গত এক বছরে (জুলাই থেকে জুন মাস) এত চাপ কখনো দেখা যায়নি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ০২ শতাংশ। যা বছরওয়ারি হিসাবে এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ।

অন্যদিকে মাসওয়ারি হিসাবে গত জুন মাসে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমেছে। এ মাসে মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এর আগের মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। গতকাল সোমবার এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং দেশে ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে আমদানি খরচ বাড়ে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়িয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা। এ ছাড়া জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন খরচও বেড়েছে। কারসাজির মাধ্যমে পণ্যের দাম বাড়ানো ঠেকাতে তদারকির অভাবও ছিল বলে মনে করেন তাঁরা।

গত অর্থবছরের বাজেট ঘোষণায় অর্থমন্ত্রী গড় মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ধরেছিলেন ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। কিন্তু বছর শেষে দেখা গেল, গড় মূল্যস্ফীতি এর ধারেকাছে নেই। গত অর্থবছরের কোনো মাসেই মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি আসেনি।

গত অর্থবছর শুরু (জুলাই মাস) হয়েছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতি নিয়ে। পরে আগস্ট মাসে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে মূল্যস্ফীতি একলাফে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে উঠে যায়। এ ছাড়া গ্যাস, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন পরিষেবার দামও বাড়ানো হয়। এরপর আর মূল্যস্ফীতির গতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি। কখনো বেড়েছে, কখনো কিছুটা কমেছে, আবার বেড়েছে—এভাবে চলেছে পুরো বছর। এর মধ্যেই গত মে মাসে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে পৌঁছায়, যা ছিল গত ১১ বছর ২ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগেই বলেছিলাম জুন মাসে মূল্যস্ফীতি কিছু কমবে, তা–ই হয়েছে। অন্যদিকে মজুরির হারও বেড়েছে। তবে এখনো সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেশি, যা সাধারণ মানুষকে চাপে ফেলছে। চলতি অর্থবছরে উন্নয়ন প্রকল্প ও সরকারি খরচ কমানোর উদ্যোগ অব্যাহত রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে। এখন স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের সুযোগ রয়েছে। তাহলে মূল্যস্ফীতি কমে যাবে। আবার সামনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা না হলে তা মূল্যস্ফীতি কমাতে সহায়তা করবে।’ তাঁর মতে, বর্ষা ও অতিবৃষ্টির কারণে পণ্য আনা-নেওয়া বিঘ্নিত হলে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে।

কেন মূল্যস্ফীতি বেড়েছে

বিদায়ী অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য অর্জিত হবে না, তা বাজেট বক্তৃতায় স্বীকার করে নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলেন, ‘চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখা সম্ভব হবে না।’ এ জন্য দুটি কারণ উল্লেখ করে। যেমন রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং দেশে বৈদেশিক মুদ্রার অবচিতি (ডলারের মূল্যবৃদ্ধি)।

মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য মূলত তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশ মূল্যস্ফীতি কমাতে ওই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এক-দেড় বছর ধরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিষ্ক্রিয় ছিল। মূল্যস্ফীতি যখন ১০ শতাংশের কাছাকাছি চলে গেছে, এখন বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে। আবার প্রতি লিটার জ্বালানি তেলের দামে ৪০-৪৫ টাকা শুল্ক-কর থাকে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলে তা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেয়। যদি সাময়িক সময়ের জন্য শুল্ক-করে ছাড় দেওয়া হতো, তাহলে এত দাম বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ত না। এ ছাড়া খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ানো ঠেকাতে অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনা তদারকির জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সম্প্রতি পেঁয়াজ ও কাঁচা মরিচের মূল্যবৃদ্ধি এর উদাহরণ।

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত বছরের শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি মূলধনি যন্ত্রপাতি, মধ্যবর্তী পণ্য, লোহাসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম কয়েক গুণ বেড়ে যায়। ফলে দেশের আমদানিকারকদের বেশি দামে পণ্য আমদানি করতে হয়। এর প্রভাব পড়ে স্থানীয় বাজারে।

আবার গত বছরের এপ্রিল মাস থেকেই ডলারের দাম বাড়তে থাকে। ডলারের দাম ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে এখন ১০৯ টাকা হয়েছে। এ কারণে এক বছরের ব্যবধানে ডলারের দাম ২৫ শতাংশের মতো বাড়ে; যা আমদানিকারকের খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারের পণ্যের দামও বেড়েছে।

সরকার বিদায়ী অর্থবছরে ব্যাংকঋণও তুলনামূলক বেশি নিয়েছে। গত মধ্য মে মাস পর্যন্ত সব মিলিয়ে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ৭৮ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এটিও মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির আরেকটি কারণ বলে জানা গেছে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ হলো সুদের হার বাড়িয়ে তা বাজারভিত্তিক করা; জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যে শুল্ক-কর কমিয়ে দাম কিছুটা কমানো এবং বাজার ব্যবস্থাপনার অনিয়ম দূর করতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, প্রতিযোগিতা কমিশনসহ সরকারি সংস্থাগুলো আরও বেশি সক্রিয় করা।

খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেড়েছে

খাদ্য মূল্যস্ফীতি চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জুন মাসে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। বিবিএসের হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, গত জুন মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। গত মে মাসে এই হার ছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণ হিসেবে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন পেঁয়াজ ও চিনির দামের প্রভাব পড়েছে।

অন্যদিকে গত জুন মাসে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৬০ শতাংশ। মে মাসে ছিল ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এ ছাড়া গ্রামে এখন সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ, শহরে এই হার ৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ।

বিবিএস এখন মূল্যস্ফীতি গণনায় জাতিসংঘের ‘ক্লাসিফিকেশন অব ইনডিভিজুয়াল কনজাম্পশন অ্যাকোরডিং পারপাস বা কইকপ পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। সেখানে দেখা গেছে, গত জুন মাসে আবাসন, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি পরিষেবা; বিনোদন ও সংস্কৃতি; বাসাবাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত—এই তিন খাতেই ১১ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি হয়েছে।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন অর্থনীতিবিদেরা। কিন্তু গত ১ জুন দেওয়া বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বড় উদ্যোগ দেখা যায়নি। চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির গড় লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে ৬ শতাংশ।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অন্য দেশ পেরেছে

গত এক বছরে বাংলাদেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফল হয়নি। কিন্তু যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে পেরেছে।

ওই সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়ানোর পাশাপাশি আমদানি চাহিদা, ব্যয় হ্রাসসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে। ভারত গত পাঁচ মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে সোয়া ৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। যুক্তরাজ্যে গত অক্টোবর মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ১ শতাংশ, যা আগের ৪১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত মে মাসে যুক্তরাজ্যের মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। গত জানুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। গত মে মাসে তা কমে দাঁড়ায় ৪ দশমিক ০৫ শতাংশ। এভাবেই গত কয়েক মাসে দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি কমেছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button