International

যেভাবে ‘জেলেপল্লি’ থেকে উন্নয়নের শিখরে সিঙ্গাপুর

স্বাধীনতা অর্জনের ৪০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে সিঙ্গাপুর বিশ্বের প্রথম সারির ধনী দেশ হয়ে ওঠে

বাংলাদেশের প্রায় কাছাকাছি বয়সের রাষ্ট্র সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুরকে একসময় বলা হতো ‘জেলেপল্লি’। কিন্তু সেই সিঙ্গাপুর এখন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ধনী দেশ।

সিঙ্গাপুর ১৯৬৫ সালের ৯ আগস্ট মালয়েশিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। ওয়ার্ল্ড ডেটা ইনফোর তথ্য অনুযায়ী, সিঙ্গাপুরের মোট ভূমির পরিমাণ ৭১৯ বর্গকিলোমিটার। উপকূলরেখা রয়েছে ১৯৩ কিলোমিটার। পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করা জার্মানভিত্তিক অনলাইন প্ল্যাটফর্ম স্ট্যাটিসটার ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, সিঙ্গাপুরের মোট জনসংখ্যা ৫৭ লাখের মতো। দেশটিতে প্রাকৃতিক সম্পদ নেই বললেই চলে।

এমন একটি দেশ ঠিক কোন তরিকায় ‘জেলেপল্লি’ থেকে উন্নয়নের শিখরে আরোহণ করল? ‘আলাদিনের চেরাগ’ নাকি টেকসই পরিকল্পনা? স্বাধীনতা অর্জনের ৪০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে সিঙ্গাপুর কীভাবে বিশ্বের প্রথম সারির ধনী দেশ হয়ে উঠল, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক।

বিনিয়োগ আকর্ষণ

বাণিজ্য-কৌশলগত দিক দিয়ে বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে সিঙ্গাপুর। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঠিক মাঝে দেশটির অবস্থান। ফলে আশপাশের দেশগুলোর অন্যতম প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে সিঙ্গাপুর। বর্তমানে গুগল, মেটা থেকে শুরু করে বৈশ্বিক অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানের আঞ্চলিক সদর দপ্তর বা কার্যালয় রয়েছে সিঙ্গাপুরে।

অল্প সময়েই সিঙ্গাপুর বিশ্বের এয়ারলাইনগুলোর ‘ট্রানজিট হাবে’ পরিণত হয়। আকাশ পরিবহনের উপাত্ত বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান ওএজির ২০২৩ সালের জুলাইয়ের তথ্যমতে, আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ক্যাটাগরিতে সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম।

দেশটির জাহাজশিল্পের প্রশংসা বিশ্বজোড়া। তেল উৎপাদন না করলেও সিঙ্গাপুর বিশ্বের অন্যতম তেল সরবরাহ কেন্দ্র। ২০২২ সালে দেশটির মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) তেলশিল্পের অবদান ছিল ৫ শতাংশ।

এর সবই সম্ভব হয়েছে দেশটির সুশাসনের কারণে। সঙ্গে ছিল উন্নত প্রযুক্তিভিত্তিক অবকাঠামো, দক্ষ শ্রমিকের প্রাপ্যতা, অনুকূল অভিবাসন আইন ও নতুন নতুন ব্যবসার সুপরিকল্পিত উদ্যোগের বাস্তবায়ন।

একটি বিষয় স্বীকার করে নিতেই হবে, সুশাসন না থাকলে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ টিকিয়ে রাখা যায় না।

শিক্ষা খাতে জোর

বর্তমানে বিশ্বের প্রথম সারির একটি বিশ্ববিদ্যালয় ধরা হয় ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরকে (এনইউএস)। চলতি বছরের জুনে প্রকাশিত কিউএস র‌্যাঙ্কিংয়ে এটির অবস্থান বিশ্বে অষ্টম আর এশিয়ায় শীর্ষে। গবেষণার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়টি নাম করে আসছে। গত ৩১ জুলাই থেকে ৬ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত রোবোসাব ২০২৩-এ চ্যাম্পিয়ন হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিযোগী দল।

শুধু এনইউএস-ই নয়, পুরো সিঙ্গাপুরের শিক্ষাব্যবস্থাকেই অনন্য বলা যায়। আর এটি সম্ভব হয়েছে স্বাধীনতার পরপরই দেশটির শিক্ষা খাতকে ঢেলে সাজানোর মধ্য দিয়ে। তারা ‘উদার শিক্ষা বৃত্তি নীতি’ গ্রহণ করে। এই নীতির আওতায় তারা তাদের মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিশ্বের সবচেয়ে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করে। শর্ত দেওয়া হয়, বিদেশ থেকে পড়ালেখা শেষে কমপক্ষে দুই বছর সিঙ্গাপুরে সরকারি চাকরি করতে হবে।

মিলিয়নিয়ার-বিলিয়নিয়ার

সিঙ্গাপুরে দরিদ্র নাগরিক বলতে কিছু নেই। বরং সেখানে ‘মিলিনিয়ার-বিলিয়নিয়ারের’ ছড়াছড়ি। এইচএসবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশটির প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ৩০ শতাংশের বেশি হবে মিলিনিয়ার। ২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী, দেশটিতে মাথাপিছু আয় ৬৭ হাজার ৩৫৯ মার্কিন ডলার। আর এসব কিছু হয়েছে দেশটির সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দরসহ সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো উন্নয়নের দিকে নজর দেওয়ার মধ্য দিয়ে।

মাদকবিরোধী কঠোর আইন

বিশ্বের সবচেয়ে কঠোরতম মাদকবিরোধী আইন রয়েছে সিঙ্গাপুরে। দেশটিতে আধা কেজির বেশি গাঁজা বা ১৫ গ্রাম হেরোইন পাওয়া গেলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ ও চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে এক নারীসহ দেশটিতে তিনজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে মাদক পাচারের দায়ে। অর্থাৎ দ্বীপরাষ্ট্রটি মনে করে, মাদক তাদের সমাজব্যবস্থা ধ্বংস করে দিতে পারে। কোনো স্থানে মাদকের ব্যবসা রমরমা হলে সেখানকার অধিবাসীদের মধ্যে তার প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে, সেখানকার তরুণসমাজ মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ে, যা সমাজকে ধ্বংস করে দিতে পারে।

ভূমিনীতি

সিঙ্গাপুরের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম অবদান এর ভূমিকেন্দ্রিক পরিকল্পনার। সেখানে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জমির সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রথমে ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। পাঁচ বছর পরপর সেই পরিকল্পনার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে, তা সরকারের উচ্চ পর্ষদে পর্যালোচনা হতো। ধীরে ধীরে তা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় রূপ নেয়।

রাজনৈতিক নেতৃত্ব

সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বড় দলটি হলো পিপলস অ্যাকশন পার্টি (পিএপি)। দলটি টানা ৬৪ বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছে। ১৯৫৪ সালে একটি ছাত্রসংগঠন থেকে স্বাধীনতাপন্থী এই দলের জন্ম হয়েছিল। পিএপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা লি কুয়ান ইউ (১৯২৩-২০১৫)। তিনি সিঙ্গাপুরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি টানা তিন দশক ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি কঠোর, সুশৃঙ্খল ও স্থিতিশীল শাসনের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরকে তৃতীয় থেকে প্রথম বিশ্বে নিয়ে যান।

২০০৭ সালে নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে লি বলেছিলেন, সিঙ্গাপুরের টিকে থাকার কথা নয়। জাতি হয়ে ওঠার আবশ্যকীয় উপাদান, যেমন সমধর্মী জনসংখ্যা, একই ভাষা, একই সংস্কৃতি ও একই নিয়তি সিঙ্গাপুরে নেই। তবে বাস্তবে লি তা করে দেখান। এর মূলে ছিল তাঁর নেতৃত্ব।

পিএপি এখনো তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। সম্প্রতি এক দুর্নীতির তদন্তের অংশ হিসেবে দলটি শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতা ও মন্ত্রীকে গ্রেপ্তার পর্যন্ত করা হয়। আবার অনৈতিক সম্পর্ক রাখার অভিযোগে কয়েক দিন আগে দেশটির স্পিকার ও একজন নারী আইনপ্রণেতাকে পদত্যাগ করতে হয়। এভাবেই সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা, উদ্ভাবন ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে দেশটি। বিশ্ববাসীর কাছে এক ‘মডেলের’ নাম সিঙ্গাপুর।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d