Hot

হাসপাতালে অনুপস্থিত থাকেন ৪৬% চিকিৎসক-কর্মকর্তা

দেশের সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে চিকিৎসক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও তা কাজে আসছে না। এসব প্রতিষ্ঠানে এখনও প্রতিদিন অনুপস্থিত থাকেন গড়ে ৪৬ শতাংশ চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় রোগীদের, পোহাতে হয় দুর্ভোগ। নিরুপায় হয়ে অনেকে বেসরকারি হাসপাতালে যেতে বাধ্য হন। খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণে ফুটে উঠেছে এমন চিত্র।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দায়িত্ব পালনে অবহেলাকারীদের শাস্তি না হওয়ায় উদ্বেগজনক এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে শক্ত তদারকির অভাব। দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের দক্ষতায়ও ঘাটতি রয়েছে। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেছেন, দেরিতে কর্মস্থলে আসা, দ্রুত অফিস ত্যাগ ও অনুমতি ছাড়া কোনো চিকিৎসক কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে তাঁকে অবশ্যই শাস্তি ভোগ করতে হবে। দায়িত্ব পালনে অবহেলাকারীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। সরকার এ ব্যাপারে তদারকি আরও জোরদার করবে বলেও জানান তিনি।

ছুটির দিন ছাড়া সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের বহির্বিভাগে সেবা প্রদান শুরু হয় সকাল ৮টায়, চলে বেলা ২টা পর্যন্ত। আর ছুটির দিনগুলোতে চালু থাকে শুধু জরুরি বিভাগ, থাকেন স্বল্পসংখ্যক চিকিৎসক।

বেলা ১১টা পর্যন্ত চিকিৎসকের দেখা নেই

গত ৩ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টায় বগুড়া ২৫০ শয্যার মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বহির্বিভাগে রোগীর লাইন। কিন্তু বেলা ১১টা পর্যন্ত চিকিৎসকের দেখা নেই! শহরের আকাশতারা এলাকা থেকে আসা বৃদ্ধা শামসুন্নাহার বেগম বলেন, ‘আগে একদিন এসে ফিরে গেছি, ডাক্তার পাইনি, আজও পেলাম না। এখন ক্লিনিকে যাচ্ছি।’ ওই নারী জানান, তিনি এসেছিলেন মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক রত্না রানী সরকারের কাছে।

সার্জারি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. এস এম বেলালও দু’দিন ধরে অনুপস্থিত বলে অভিযোগ করেন এদিন তাঁর কাছে আসা কয়েকজন রোগী। অর্থোপেডিক বিভাগের ডা. জাহিদুল কবির সুজন হাসপাতালে আসেন বেলা ১১টায়। ৬২ জন চিকিৎসকের মধ্যে প্রতিদিন এ হাসপাতালে অন্তত ২০ জন অনুপস্থিত থাকেন বলে অভিযোগ রোগীদের।

কর্মস্থলে অনুপস্থিতির বিষয়ে ডা. রত্না রানী সরকার বলেন, “আমি নিয়মিত হাসপাতালে যাই। তবে জরুরি একটি কাজের জন্য দু’দিন যেতে পারিনি।” একই কথা বলেন ডা. এস এম বেলাল হোসেন। হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক ডা. কাজী মিজানুর রহমান বলেন, চিকিৎসকরা কেন মাঝে মধ্যে ছুটি ছাড়া অনুপস্থিত থাকছেন, সে বিষয়ে তদন্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

চিকিৎসকের দেখা পান না রোগীরা

খুলনার কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গত ১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টায় গাইনি ডাক্তারের কাছে আসেন রাবেয়া খাতুন। তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পর জানতে পারেন চিকিৎসক হাসপাতালে আসেননি। পরে চিকিৎসক না দেখিয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি। একই দিন নাতির শ্বাসকষ্টের চিকিৎসায় ১০ কিলোমিটার দূর থেকে হাসপাতালে আসেন বৃদ্ধ আব্দুল মাজেদ। বহির্বিভাগের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন দীর্ঘক্ষণ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ডাক্তারের দেখা পাননি। তারাও চিকিৎসা না নিয়েই ফিরে যান। এই ঘটনা জানার পর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক রেজাউল করিম বলেন, তদন্ত করে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দুপুর হলেই শূন্য হাসপাতাল

মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে বেলা ১টার পর চিকিৎসক পাওয়া কঠিন। আবার বেলা ১১টার আগে বহির্বিভাগে আসেন না কেউ। সদর উপজেলার বাসিন্দা আফতাব উদ্দিন সরকার হাড়ের সমস্যা নিয়ে গত ৩ ফেব্রুয়ারি এ হাসপাতালে আসেন। একই সমস্যা নিয়ে আসেন রোশনা বেগম ও চা শ্রমিক বধূ ভৌমিক। কিন্তু বেলা ১১টা পর্যন্ত হাসপাতালের বহির্বিভাগে তালা ঝুলতে দেখা যায়। তখন চিকিৎসক না দেখিয়েই চলে যান অনেকে।

পরে বিষয়টি নিয়ে সমকালের সঙ্গে কথা হয় অর্থোপেডিক কনসালট্যান্ট ডা. জুনাইদ হোসেনের। তিনি বলেন, ‘ওটি ও অন্য বিভাগে চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। তাই বহির্বিভাগের চেম্বারে যেতে পারিনি।’ ওই দিন অর্থোপেডিক বিভাগের অন্য চিকিৎসক ছুটিতে থাকার কথা জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা অভিযোগ করেন, দুপুর হলেই এ হাসপাতালে ডাক্তার পাওয়া কঠিন। তারা নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন অথবা হাসপাতাল থেকে চলে যান।

সেবা দেন পরিচ্ছন্নতাকর্মী

গত ১ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় নাটোর সদর হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বুকের যন্ত্রণা নিয়ে করিডোরে বিছানা পেতে শুয়ে আছেন রবিউল আলম। আগের রাতে হাসপাতালে আসেন তিনি। পরদিন বেলা ১১টা পর্যন্ত ডাক্তারের দেখা পাননি। আরেকটু ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, অঞ্জলি নামে এক পরিচ্ছন্নতাকর্মী এক শিশুর ক্যানোলা খুলে দিচ্ছেন। মাঝে মধ্যেই তিনি এমন সেবা দেন। এটি তাঁর দায়িত্ব কিনা জানতে চাইলে দ্রুত সটকে পড়েন ওই নারী।

নাটোরের সিভিল সার্জন ও সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মুহাম্মদ মশিউর রহমান বলেন, হাসপাতালটি আড়াইশ শয্যায় উন্নীত হলেও জনবল বাড়েনি। তাই রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কোনো ডাক্তার দেরিতে হাসপাতালে এলে বা নির্ধারিত সময়ের আগে চলে গেলে তাঁকে প্রথমে মৌখিক সতর্ক করা হয় বলে জানান তিনি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অভিযোগের পাহাড়

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ জানুয়ারি থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১০ দিনে অধিদপ্তরে অভিযোগ এসেছে ৭১৩টি। এর মধ্যে ৪১৭টি অভিযোগই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে। একই সময়ে অধিদপ্তরে পরামর্শ আসে ১২৭টি।

এক অভিযোগকারী লেখেন, ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে তিনি চোখের চিকিৎসক পাননি। গত ৬ ফেব্রুয়ারি মোবাইল ফোনে মেসেজ করে অভিযোগটি দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। মেসেজে তিনি লিখেছেন, ‘এই হাসপাতালে চোখের কোনো চিকিৎসক নাই। প্রতিদিন ৫ থেকে ১০ জন সেবা প্রত্যাশী ফিরে যাচ্ছেন।’

অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের তথ্য বলছে, সারাদেশে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মোট চিকিৎসকের গড়ে ৪৬ শতাংশ প্রতিদিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন। তাদের ডিজিটাল হাজিরার এক সপ্তাহের উপাত্ত (১ থেকে ৮ জানুয়ারি) বিশ্লেষণ করে এই চিত্র পাওয়া যায়। আট বিভাগের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা সদর ও জেনারেল হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতালে কর্মরত ৩৪ হাজার চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে ১৮ হাজার ৩৬০ জন কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন; যা মোট জনবলের ৪৬ শতাংশ। এমআইএসের উপাত্ত অনুযায়ী, উল্লিখিত সময়ে সবচেয়ে বেশি উপস্থিতি ছিল ময়মনসিংহ বিভাগে ৫৬ দশমিক ৩০ শতাংশ, এরপর রয়েছে সিলেট বিভাগ ৫৬ দশমিক ১৮ শতাংশ। চট্টগ্রামে এ হার ৫৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ, বরিশালে ৫৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ, খুলনায় ৫১ দশমিক ৮২ শতাংশ, রংপুরে ৫১ দশমিক ৭৭ শতাংশ, ঢাকায় ৫১ দশমিক ৬৬ শতাংশ এবং রাজশাহীতে ৫১ দশমিক ৫১ শতাংশ। এ হিসাবে কর্মস্থলে অনুপস্থিতি সবচেয়ে বেশি রাজশাহী বিভাগে।

২০১৯ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘যে ডাক্তার জেলায় যাবেন না বা কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকবেন, তাঁকে ওএসডি করে নতুন ডাক্তার নিয়োগ দেওয়া হবে।’ কিন্তু পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর থেকে কারও বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসকদের শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করতেই ডিজিটাল হাজিরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে হাসপাতালপ্রধান অথবা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মস্থলে অনুপস্থিত চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর তালিকা দেখতে পারেন; ব্যবস্থাও নিতে পারেন। তাঁর দাবি এভাবে মাঝে মধ্যে কিছু চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

অনেক হাসপাতালেই ডিজিটাল হাজিরা মেশিন ব্যবহার হচ্ছে না। কোথাও কোথাও আবার সেটি অনেক দিন ধরে নষ্ট। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন মনে করেন, কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে শক্ত তদারকি দরকার। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রশাসন শাখা ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের আরও কঠোর হতে হবে। যারা দায়িত্ব পালনে গাফিলতি করছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, প্রতিদিন ৪৬ শতাংশ চিকিৎসক-কর্মকর্তার হাসপাতালে অনুপস্থিতি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সরকার যেহেতু বেতন দেয়, তাই প্রত্যেক চিকিৎসককে অবশ্যই হাসপাতালে উপস্থিত থাকতে হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto