৩০০ কোটির উন্নয়ন কাজে কপাল পুড়ল ছাত্রলীগের
ছাত্রনেতাদের অপকর্মেই ডুবেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ। তাদের নানা অপকর্মে অতিষ্ঠ হয়েই চবি কমিটি বিলুপ্ত করেছে কেন্দ্রীয় কমিটি। বিভিন্ন উপদলে ভাগ হয়ে ক্যাম্পাসকে তটস্থ রাখতেন ২২ নেতা। যেখানে উন্নয়নকাজ সেখানেই চাঁদা দাবি করতেন তারা। দাবি অনুযায়ী চাঁদা না পেলে বন্ধ হয়ে যেত উন্নয়নকাজ। চাঁদার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলীকে মারধরও করেছেন তারা। তাদের কারণে বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ১৫ প্রকল্পের কাজ। লিখিত অভিযোগ দিয়ে বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও জানিয়েছেন ঠিকাদার সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু ছাত্রলীগের কাছে অসহায় ছিল চবি প্রশাসন। কারণ ছাত্রলীগ নেতাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেলেই ডাকা হতো অবরোধ। তাদের নির্দেশে বন্ধ করে দিতে হতো ক্লাস-পরীক্ষা। চবি অচল করতে যখন ইচ্ছা তখন বন্ধ রাখা হতো শাটল ট্রেন। তাদের ইচ্ছাতেই যেন চলে ২৮ হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন।
ছড়ি ঘোরানো ২২ ছাত্রনেতা
অবরোধ, আন্দোলন ও বিক্ষোভে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ বারবার আসছে শিরোনামে। কখনও পদের জন্য, কখনও হল দখল, কখনও বা অন্তর্কোন্দলে সংঘর্ষে জড়াচ্ছে ছাত্রলীগ। আগে পদের জন্য এমন সংঘর্ষে জড়াতেন রেজাউল হক রুবেল ও ইকবাল হোসেন টিপুর অনুসারীরা। সিক্সটি নাইন ও সিএফসি গ্রুপের হয়ে গত এক বছরে শুধু অবরোধই ডেকেছেন তারা অন্তত ৩০ বার। তাদের মধ্যে আছেন খুনের মামলার আসামি রাজু মুন্সী, টেন্ডারবাজ নাছির উদ্দীন সুমন, ছাত্রলীগ থেকে আজীবন বহিষ্কার সাঈদুল ইসলাম, শামসুজ্জামান সম্রাট ও হল দখলদার মোহাম্মদ ইলিয়াস। তাদের মধ্যে কয়েকজন পূর্ণাঙ্গ কমিটি হওয়ার পর কিছুটা নিষ্ক্রিয় ছিলেন। কিন্তু আগে আতঙ্কের কেন্দ্রে ছিলেন এই পাঁচজন। তাদের মধ্যে রাজু মুন্সীর বিরুদ্ধে খুন, শিক্ষকদের হত্যার হুমকি ও চাঁদাবাজির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণকাজ বন্ধে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। মারামারি, ভাঙচুর ও টেন্ডার কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে বারবার নাম এসেছে নাসির উদ্দিন সুমনের। এখন তিনি ক্যাম্পাসে নেই। মারামারি করে হল দখলে সিদ্ধহস্ত বলে প্রচার আছে ইলিয়াসের বিরুদ্ধে। এখনও তিনি সক্রিয়। গত পাঁচ বছর নানা অপকর্মে জড়িত অন্য নেতাদের মধ্যে রয়েছেন মির্জা খবির সাদাফ, প্রদীপ চক্রবর্তী দুর্জয়, সাদেক হোসেন টিপু, আরাফাত রায়হান, মুজিবুল হক, খালেদ মাসুদ, রকিবুল হাসান দিনার, আবু বকর তোহা, রায়হান রেজা, মোফাজ্জল হায়দার মোফা, শফিকুল ইসলাম, নিজাম উদ্দীন রবিন, শরীফ হোসেন, সুমন খান, নয়ন চন্দ্র মোদক, সাখাওয়াত এবং নজরুল ইসলাম সবুজ। তাদের বেশিরভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়মিত শিক্ষার্থী। ৬ থেকে ১১ বছর পর্যন্ত ক্যাম্পাসে রয়েছেন তাদের অনেকেই। ভার্সিটি এক্সপ্রেস (ভিএক্স), বাংলার মুখ, রেড সিগনাল, কনকর্ড, এপিটাফ, উল্কা ও বিজয়ের শীর্ষ নেতা হিসেবে ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা। বগিভিত্তিক বিভিন্ন গ্রুপ করে ছাত্রলীগের মূল কমিটিকেই এতদিন বেকায়দায় রেখেছেন তারা। গত পাঁচ বছরে তারা বিশ্ববিদ্যালয় অচল করেছেন অন্তত ১০০ বার। নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়েছেন তারা ১৬৫ বার। মূল ফটকে এক ডজনেরও বেশিবার তালা ঝুলিয়েছেন।চাঁদাবাজির মূলে উন্নয়নকাজ
চবিতে ৩০০ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ নিয়ে বেকায়দায় ছিল প্রশাসন। এসব প্রকল্প থেকে চাঁদা দাবি করত ছাত্রলীগের একটি অংশ। চাঁদাবাজির ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যাওয়া ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের হুমকির অভিযোগও এসেছে। গত ২৮ আগস্ট দাবি করা চাঁদা না দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী ও প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে মারধর করেন ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাজু মুন্সি। এর আগে ২৬ আগস্ট চাঁদা না পেয়ে নির্মাণাধীন দ্বিতীয় কলা ও মানববিদ্যা ভবনের কাজ বন্ধ করে দেন তিনি। এমন চাঁদাবাজির কারণে নির্ধারিত সময়ে শেষ করা যাচ্ছে না কোনো প্রকল্পই। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫টি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলমান আছে। এর মধ্যে ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে নেওয়া হয়েছে ১১টি প্রকল্প। এসব প্রকল্পের মধ্যে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে পাঁচটির। ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে তিনটির। ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে দুটির। এ ছাড়া অন্য প্রকল্পটির কাজ আটকে আছে ৬০ শতাংশেরও নিচে। এর মধ্যে আছে ৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে দ্বিতীয় কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ ভবন, ৪ কোটি ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে নেওয়া বঙ্গবন্ধু হলের প্রভোস্ট এবং হাউস টিউটর কোয়ার্টারের নির্মাণকাজ। ৪ কোটি ৪১ লাখ টাকা ব্যয়ে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান হলের দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্মাণকাজ, ১৯ কোটি ২৭ লাখ টাকার জননেত্রী শেখ হাসিনা হলের দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্মাণকাজ, ৩৫ কোটি ৬ লাখ টাকার ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজের একাডেমিক ভবন নির্মাণকাজ, ৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকার বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব হলের দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্মাণকাজ, ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকায় ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজের সম্মুখে গার্ডার ব্রিজ নির্মাণকাজ, ৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকৌশল দপ্তরের ভবন নির্মাণকাজ, ১৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে জীববিজ্ঞান অনুষদের চতুর্থ পর্যায়ের নির্মাণকাজ, ৯ কোটি ৭১ লাখ টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের চারদিকে সীমানা প্রাচীর নির্মাণকাজ।
সরেজমিন দেখা যায়, বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ এখনও বন্ধ রয়েছে। নির্মাণ প্রকল্পে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে এর আগে প্রশাসনকে লিখিত চিঠিও দিয়েছিলেন ঠিকাদাররা। চিঠিতে বলা হয়, প্রশাসন ব্যবস্থা না নেওয়ায় মানহানিসহ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা।
অতিষ্ঠ শিক্ষার্থীরা
গত এক সপ্তাহে তিনবার সংঘর্ষ হয়েছে চবিতে। এর আগে গত আগস্টে কমিটি সম্প্রসারণের দাবিতে হয়েছে অবরোধ। সেই অবরোধে ১১টি পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় ৪৮টি বিভাগ ও ছয়টি ইনস্টিটিউটের শতাধিক ক্লাস। এর দেড় মাস আগে আরেক দফা অবরোধে স্থগিত হয় ৯টি বিভাগের ১১টি শিক্ষাবর্ষের পরীক্ষা। সেবারও ক্লাস বন্ধ থাকে ৪৮টি বিভাগ ও ছয়টি ইনস্টিটিউটে।
চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেওয়া প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকাদার সমিতির সভাপতি মো. সেকান্দর হোসেন বলেন, চবির প্রায় সব উন্নয়ন কাজে চাঁদাবাজির অভিযোগ আসে। কিছু অছাত্র ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে এই চাঁদাবাজি করে আসছেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এসব অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া পর্যন্ত আমরা নির্মাণকাজ বন্ধ রাখব বলে চিঠিতে উল্লেখ করেছি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি রেজাউল হক রুবেল বলেন, কোনো ব্যক্তি যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ বা উন্নয়নমূলক কাজে বাধা দেয়, ওই বিশেষ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। তবে ঢালাওভাবে সংগঠনকে দায়ী করা যায় না। চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার বলেন, ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে কিছু অছাত্র চাঁদাবাজি করছে বলে ঠিকাদার সমিতি থেকে অভিযোগ পেয়েছি। এ বিষয়ে আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও গ্রহণ করেছি।