Bangladesh

‘অজ্ঞাত উৎস’ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলার পেতে চুক্তি, গচ্চা ৩৯ কোটি টাকা ঋণ পায়নি বিএসসি

গচ্চা যাওয়া টাকার দায় কেউ নিতে রাজি নয় * ইআরডির সম্মতি ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভেটিং ছাড়াই চুক্তি * এখন বিদেশের ব্যাংকে ৪৪ মিলিয়ন ডলার জামানত রাখার প্রস্তাব অস্ট্রেলিয়ার প্রতিষ্ঠানটির

চুক্তি সইয়ের ১ বছরেও ‘অজ্ঞাত উৎস’ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ বুঝে পায়নি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি)। ওই ঋণ পেতে গিয়ে উলটো প্রায় ৩৯ কোটি টাকা গচ্চা গুনছে এ প্রতিষ্ঠানটি।

ওই পরিমাণ টাকা গচ্চা যাওয়ার পর অস্ট্রেলিয়ার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘এআইএস মেরিন অ্যান্ড অফশোর পিটিআই লিমিটেড’ থেকে এই ঋণ পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছে বিএসসি কর্তৃপক্ষ।

তবে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যে ‘অ্যাগ্রিমেন্ট ফর জেনারেল ইউজ’ নামক চুক্তি হয়েছে তা এখনো বাতিল করেনি শিপিং করপোরেশন। এদিকে গত ১ বছরে বিএসসির প্রায় ৩৯ কোটি টাকা গচ্চা যাওয়ার দায় এখন কেউ নিতে রাজি হচ্ছে না।

এআইএস মেরিনকে ১৩ জুনের মধ্যে ওই টাকা বিএসসিকে পরিশোধ করতে চিঠি দেওয়া হয়। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ওই টাকা বিএসসির অ্যাকাউন্টে জমা দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। আদৌ ওই টাকা পাওয়া যাবে কিনা-তা নিয়ে সন্দিহান বিএসসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্ট একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

আরও জানা গেছে, ওই ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসাবে এইচএসবিসি ব্যাংক বাংলাদেশের চট্টগ্রামের একটি শাখায় গত বছরের জুলাই থেকে ৫৬৫ কোটি টাকা ‘ক্যাশ এসক্রো অ্যাকাউন্ট অ্যাগ্রিমেন্টে’র আওতায় ব্লক করে রাখা ছিল।

চলতি বছরের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে ওই টাকা নিজেদের আয়ত্তে নিতে সক্ষম হয়েছে বিএসসি কর্তৃপক্ষ। এখন ওই টাকা বিদেশি ব্যাংকে জামানত রাখতে বলছে প্রতিষ্ঠানটি।

সম্প্রতি দেওয়া এক প্রস্তাবে যুক্তরাজ্য, সিংগাপুর বা সুইজারল্যান্ডের চারটি ব্যাংকের নাম উল্লেখ করে এর কোনো একটিতে ৪৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার জমা দিতে বিএসসিকে প্রস্তাব দিয়েছে। যদিও ওই প্রস্তাবে শনিবার পর্যন্ত সায় দেয়নি বিএসসি।

এআইএস মেরিন থেকে ১ বছরে ঋণ না পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোস্তাফা কামাল শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, অস্ট্রেলিয়ার ওই কোম্পানিটি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। আমরা প্রতিষ্ঠানের কাঠামো, তাদের সক্ষমতা দেখব এবং সমীক্ষা করব। তারপর তাদের সঙ্গে ঋণ চুক্তিতে যাওয়ার চিন্তা করব। দেশের স্বার্থ এবং ওই ঋণ যদি নিরাপদ না হয় তাহলে আমরা ওই ঋণ নেব কেন?

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ক্যাশ এসক্রো অ্যাকাউন্ট অ্যাগ্রিমেন্ট’র আওতায় ৫৬৫ কোটি টাকা বিএসসির নামে এফডিআর করেছিল। সম্ভবত ওই টাকা বিএসসি ফেরত পেয়েছে। এফডিআর করায় সেখানে সুদও পেয়েছে। এজন্য এক টাকাও নষ্ট হয়নি বিএসসির।

তবে বিএসসি ও নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের নথিপত্রে দেখা গেছে, ‘ক্যাশ এসক্রো অ্যাকাউন্ট অ্যাগ্রিমেন্ট’র আওতায় ১১ মাস ৫৬৫ কোটি টাকা ব্যাংকে ব্লক করে রাখায় সংস্থাটির প্রায় ৩৯ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। বিএসসির এফডিআর ভেঙে ২০২৩ সালের জুলাইয়ে ওই টাকা ব্লক করা হয়। টাকা ব্লক থাকায় সেখান থেকে সুদ পায়নি বিএসসি। টাকা ব্লক করে রাখার সার্ভিস চার্জ হিসাবে এইচএসবিসি ব্যাংক উলটো বিএসসির কাছে টাকা দাবি করছে।

আরও দেখা গেছে, এফডিআর হিসাবে যেভাবে ছিল, সেভাবে থাকলে গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত সুদ বাবদ ৩৭ কোটি ৭৭ লাখ ১২ হাজার ৮১৯ টাকা নিশ্চিত আয় হতো বিএসসির। টাকা ব্লক করায় ওই আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

এছাড়া ‘ক্যাশ এসক্রো অ্যাকাউন্ট অ্যাগ্রিমেন্ট’র প্রস্তুতি, অ্যাকাউন্ট সেটআপ ও ব্যবস্থাপনা করতে ব্যয় হয়েছে আরও ৯৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা। সবমিলিয়ে বিএসসি আয় হারিয়েছে ৩৮ কোটি ৭৩ লাখ ২ হাজার ৮১৯ টাকা।

২৮ মে এআইএস মেরিনের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে এই ৩৮ কোটি ৭৩ লাখ ২ হাজার ৮১৯ টাকা বিএসসির সিংগাপুরের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দিতে বলা হয়। ১৩ জুনের মধ্যে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হলেও ওই টাকা বিএসসিকে এআইএস মেরিন পরিশোধ করেনি বলে জানিয়েছেন বিএসসির ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থিত ‘এআইএস মেরিন অ্যান্ড অফশোর পিটিআই লিমিটেড’র চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরিফুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিএসসির চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করেন।

মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, বিএসসির সঙ্গে আমাদের যে চুক্তি হয়েছে তা অস্ট্রেলিয়ার আইন অনুযায়ী অত্যন্ত গোপনীয়। এ বিষয়ে তিনি বিস্তারিত বলতে রাজি নন। এমনকি গোপনীয় এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলে অস্ট্রেলিয়ার আদালতে এ প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ারও হুমকি দেন।

বিএসসির একাধিক কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, এআইএস মেরিনের চুক্তির যে শর্ত রয়েছে তাতে এই টাকা ফেরত পাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। প্রতিষ্ঠানটিকে ম্যানেজ করে এই টাকা ফেরত আনা হয়েছে। চুক্তিতে ১৩ মাসের মধ্যে ঋণের ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি ১২ মাসে ঋণের ব্যবস্থা করতে পারেনি। উলটো নতুন নতুন শর্ত দিচ্ছে।

তারা আরও বলেন, বিগত বছরগুলোতে ক্রমেই বিএসসির নিট লাভের পরিমাণ বাড়ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ওই ৩৯ কোটি টাকা গচ্চা যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানের আয় এবং নিট লাভ দুইই কমবে। এতে শেয়ারহোল্ডাররাও মুনাফা কম পাবেন।

বিএসসি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬৬৭ কোটি ২২ লাখ টাকা আয় ও ৪২০ কোটি ৯৩ লাখ টাকা ব্যয় করে। প্রতিষ্ঠানের নিট আয় হয় ২৪৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা। এর আগের বছর ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানের আয় ছিল ৫১৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা ও ব্যয় ছিল ২৯১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ওই বছরে নিট লাভ ছিল ২২৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা।

নিয়ম ভেঙে চুক্তি সই : জানা গেছে, বিএসসিকে ছয়টি জাহাজ নির্মাণ করে দিতে ৩০০ মিলিয়ন থেকে এক বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ঋণ এনে দেওয়ার প্রস্তাব দেয় অস্ট্রেলিয়ার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘এআইএস মেরিন অ্যান্ড অফশোর পিটিআই লিমিটেড’। প্রস্তাবে বলা হয়, ওই ঋণের সুদ হবে আনুমানিক ০.৫৫ শতাংশ। ওই প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে ঋণের টাকায় বিএসসির জন্য ৬টি কনটেইনার জাহাজ নির্মাণ হবে।

জাহাজ নির্মাণ তদারকি এবং ঋণের ৩০০ মিলিয়ন ডলার জোগান দেওয়ায় ‘ফাইন্যান্স ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড টেকনিক্যাল সার্ভিস ফি’ হিসাবে প্রকল্প ব্যয়ের ১.৩ শতাংশ কমিশন নেবে প্রতিষ্ঠানটি। অর্থাৎ ৩০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়া হলে ওই প্রতিষ্ঠানটি পাবে ৩.৯ মিলিয়ন ডলার।

আরও জানা গেছে, নিয়ম ভেঙে ২০২৩ সালের ৫ জুলাই নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ‘অ্যাগ্রিমেন্ট ফর জেনারেল ইউজ’ এবং ‘ক্যাশ এসক্রো অ্যাকাউন্ট অ্যাগ্রিমেন্ট’ সই হয়। বিএসসির তৎকালীন এমডি এবং এআইএস মেরিনের সিইও নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে চুক্তিতে সই করেন।

ওই অনুষ্ঠানে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকরা উপস্থিত ছিলেন। তবে চুক্তি সইয়ের আগে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সম্মতি নেয়নি নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়। এমনকি চুক্তির খসড়া আইন মন্ত্রণালয় থেকে ভেটিং করা হয়নি।

এছাড়া চুক্তিতে কোন উৎস থেকে এই ঋণের টাকা আসবে তা এআইএস মেরিনের গোপনীয় বিষয় হিসাবে উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ কোন উৎস থেকে ঋণ আসবে তা প্রশ্ন করা যাবে না।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d