Hot

অনলাইন জুয়ায় পাচার হাজার কোটি টাকা

আইপিএল, বিপিএল, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপসহ জনপ্রিয় সব খেলা সম্প্রচারকালে ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে অনলাইন জুয়া বা বিভিন্ন বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন । এসব বেটিং সাইটের মাধ্যমে ই-মানি হয়ে বছরে হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে। এসব সাইটে এমনভাবে লগারিদম করা থাকে যে, একজন জুয়াড়ি ১০ বার খেলার জন্য টাকা বিনিয়োগ করলে সে ৬ থেকে ৮ বার জয়ী হয়। এতে জুয়াড়ির আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। এজন্য সে পরের খেলায় বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে থাকে। তবে তখন আর লাভের মুখ দেখতে পায় না। সেই লোকসানের বিনিয়োগ তুলতে গিয়ে উল্টো নিয়মিত বিনিয়োগ করে সর্বস্ব খুইয়ে নিঃস্ব হয়। 

সূত্র বলছে, এসব জুয়ার সাইট রাশিয়া, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সাইপ্রাসসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পরিচালিত হয়। কিন্তু দেশে তাদের ডিলার বা প্রতিনিধি রয়েছে। তারাই মূলত মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টদের কাছ থেকে জমা হওয়া জুয়ার টাকা সংগ্রহ করে। এরপর সেই টাকা অনলাইনভিত্তিক ‘বাইন্যান্স’ নামে অ্যাপে বিনিয়োগ করা হয়।

বিজ্ঞাপন এটি শেয়ারবাজারের মতো একটি অনলাইন অ্যাপ। সেখানে ডিলাররা টাকাকে ডলারে রূপান্তরের পর বিনিয়োগ করে। এরপর তা ক্রিপ্টোকারেন্সি বা বিট কয়েনে রূপান্তর করে জুয়ার সাইট মালিকের কাছে পাচার করে। বিট কয়েনে পাচারের বাইরে হুন্ডির মাধ্যমেও এই টাকা পাচার হয়ে থাকে। এজন্য বিদেশে আবার বাংলাদেশি প্রবাসীদের মাধ্যমে এজেন্ট গড়ে তুলেছে জুয়ার মাফিয়ারা। অনেক প্রবাসী জেনে হোক আর না জেনেই হোক এসব এজেন্টদের সেখানে বৈদেশিক মুদ্রা তুলে দিচ্ছেন। বিনিময়ে দেশে সমপরিমাণ বাংলাদেশি মুদ্রা সংগ্রহ করছে তাদের স্বজনরা। 
বেট৩৬৫, মেইলবেট, এক্সবেট, ওয়ান এক্সবেট, মাইজেট, ক্রিকেক্স, বেটইউনার, মোস্টবেটসহ বিভিন্ন নামে প্রচারিত এসব বেটিং সাইটে লগইন করার পর দেখা গেছে, সেখানে দেশীয় মোবাইল ফোন অপারেটরের ফোন নম্বর ভাসতে থাকে। দেশে এমন অন্তত ৫০ লাখ মানুষ অনলাইন জুয়ায় জড়িত রয়েছে বলে জানিয়েছেন তথ্য প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। সিআইডি’র তথ্য এই সংখ্যাটি ২০ লাখ হবে, যারা মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে মাসে ১৫০ কোটি টাকার বেশি অবৈধভাবে লেনদেন করেন। 

শিপন মাহমুদ নামে এক তরুণ বলেন, আমি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপ খেলায় অন্তত এক লাখ ৭০ হাজার টাকা খুইয়েছি। তিনি বলেন, আমি বিষয়টি সম্পর্কে প্রথমে অবগত ছিলাম না। এরপর আমার এক বন্ধুকে দেখি ওয়ান এক্সবেটে টাকা লাগিয়ে রাতারাতি আইফোনসহ অনেক কিছু কিনে ফেলেছে। সেসব দেখে আমিও লোভে পড়ে যাই। প্রথমে দুই হাজার, পাঁচ হাজার করে টাকা লাগিয়েছি। অনেক লাভও পেয়েছি। এরপর ধীরে ধীরে আমি টাকা বাড়াতে থাকি। কিন্তু লাভ আর পাইনি। তিনি বলেন, আসল আর লাভের অংশ দিয়ে পঞ্চাশ হাজার টাকা লাগিয়ে হেরে গেলাম, তখন আমার মাথায় আর কাজ করছিল না। ভাবলাম আমার মনে হয় কপাল খারাপ। এরপর ধার-দেনা করে আবারো লাভের আশায় টাকা লাগাই। কিন্তু আমার সব শেষ। দুইদিন সাময়িক মজা পেলেও এখন পাওনাদারদের ভয়ে মোবাইল বন্ধ করে বাসার বাইরে বাইরে ঘুরছি। শিপনের মতো ইস্তিয়াক, তাপস দাসও অনলাইন জুয়া সাইটের মোহে পড়ে সব হারিয়েছেন।  

জুয়ার এমন ১৮৬টি অ্যাপ ও লিংকের তথ্য পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। প্রতিটি অ্যাপ ও সাইটে লেনদেনের জন্য বাংলাদেশের প্রতিটি এমএফএস প্রতিষ্ঠানের একটি করে ৫-৬টি এজেন্ট নম্বর দেয়া থাকে। দেশে ১৩টি প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিংয়ে আর্থিক সেবা দিয়ে থাকে। এদের এজেন্ট নম্বরগুলো জুয়াড়িরা দৈনিক ভিত্তিতে এবং লাখে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা কমিশন ভিত্তিতে ভাড়া নেয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রত্যন্ত অঞ্চলের এজেন্ট নম্বর টার্গেট করে জুয়াড়িরা। এ রকম ৩ হাজারের বেশি এজেন্ট নম্বর পেয়েছে তদন্তসংশ্লিষ্ট সংস্থা। প্রতিটি এজেন্ট নম্বরে মাসে গড়ে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার অবৈধ লেনদেন হয়। দেড় হাজার এজেন্ট নম্বরে মাসে ১৫০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়। এভাবে বছরে লেনদেন হয় প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি থেকে ২ হাজার কোটি টাকা।

এসব অনলাইন জুয়া বা বেটিং সাইটের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান ও নজরদারি করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। সংস্থাটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে কতো লোক এই অনলাইন জুয়ায় জড়িয়েছে, তার সঠিক হিসাব নেই। তবে বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার ও সাইবার স্পেসে নজরদারি কার্যক্রম চালিয়ে সিআইডি’র সাইবার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট শাখার কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, জুয়ার বিভিন্ন সাইটে দেশ থেকে অন্তত ১২ লাখ নিবন্ধন রয়েছে। এরমধ্যে ৪ থেকে ৫ লাখ আইডিতে নিয়মিত জুয়া খেলা হয়ে থাকে। এসব আইডি থেকে মাসে ১০০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। দেশীয় ডিলারদের কমিশন বাদে বাকি সব টাকাই বিদেশে জুয়ার সাইটের মালিকদের কাছে চলে যাচ্ছে। এর ফলে একদিকে যেমন দেশ থেকে মুদ্রা পাচার বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে দেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে। সিআইডি বলছে, পাচারে জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়ে গত কয়েক বছরে অন্তত ৫০ হাজার এমএফএস হিসাব স্থগিত করা হয়েছে। ৫ হাজারের বেশি এজেন্টের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। এমএফএস কোম্পানিগুলোকে সন্দেহভাজন কয়েক হাজার এজেন্টের নম্বর দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে একটি কোম্পানি সজাগ হয়েছে। যদিও দেশে আরও ১২টি প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিংয়ে আর্থিক সেবা দিয়ে আসছে। 

এদিকে অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে অর্থ পাচার এবং জুয়ার ব্যাপক প্রসারের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি বলছে, সর্বোচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও অনলাইন জুয়া বন্ধে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি, উল্টো ভিন্ন মোড়কে জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অনলাইনের অবারিত দুনিয়ায় জুয়া বা বেটিংয়ের প্রসার রোধে সবার আগে এর প্রচারণা রোধ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্বপ্রণোদিত উদ্যোগ জরুরি।

এ বিষয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, অনলাইন জুয়া এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এর মাধ্যমে নিয়মিত দেশ থেকে ই-মানির মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে। কোনো একটি সংস্থার পক্ষে এই অনলাইন গেম্বলিং নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন সব সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা এখনো পিছিয়ে আছি। আমাদের টুলসের অভাব। এটা জরুরি। আমরা চাই সবাই তথ্য দেবেন, সিআইডিকে জানান, আমরা ব্যবস্থা নেবো। তিনি বলেন, সিআইডিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান পরিচালনা ও ডিভাইস জব্দসহ অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে পারতো। কিন্তু নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনে অবৈধ অর্থ পাচারের ধারায় এখন সেটি সম্ভব হচ্ছে না।

আমরা সহজে কিছু করতে পারছি না। নতুন আইন হওয়ার পর অনলাইন জুয়ার অভিযোগে কোনো মামলা হয়নি। অথচ অনলাইন জুয়ায় অবৈধভাবে অর্থ পাচার বাড়ছে। এখনই দরকার অনলাইন গেম্বলিং নিয়ন্ত্রণ আইন। সিআইডি প্রধান বলেন, আমাদের একটা ট্র্যাডিশনাল আইন আছে। প্রকাশ্যে যারা জুয়া খেলে, তিন বা চার তাস, এর শাস্তি ছিল ৫০/১০০ টাকা জরিমানা। কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে সেটি অনলাইন জুয়া, যা অনলাইন বেইজ অপরাধ। এটা নিয়ন্ত্রণে কিন্তু দেশে আলাদা কোনো আইন নেই। যে আইনটা ধরে আমরা কাজ করেছি, সেটি হলো সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট। সেটিতে বলা হয়েছে, অবৈধ ই-মানি ট্রানজেকশন। এই ধারা তখন ছিল কগনিজেবল। এখন সেটি ননকগনিজেবল করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রমাণের আগে পুলিশ কাউকে ধরতে না পারায় বিষয়টি এখন আমাদের জন্য অনেক কঠিন।  আমরা চাচ্ছি এটা দ্রুত সংশোধন করা হোক। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রস্তাবনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d