Hot

অনুপ্রবেশ ঠেকানো চ্যালেঞ্জ সীমান্তজুড়ে ভয়-আতঙ্ক: মিয়ানমার পরিস্থিতি

সীমান্ত লাগোয়া কক্সবাজারের উখিয়ার রহমতবিল। পাহাড়ি পথের পাশে সবুজ ধানের ক্ষেত। মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি এপারে রহমতবিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানটির প্রাচীরের বাইরে কয়েকশ উৎসুক মানুষের জটলা। ফটকে সতর্ক পাহারায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা। বিদ্যালয়ের ছোট আঙিনায় সারি করে বসিয়ে রাখা হয়েছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি), সেনা, শুল্ক ও সেনা সদস্যদের। এ সংখ্যা শতাধিক।

সেখানেই স্থানীয় কৃষক সৈয়দ আলমের সঙ্গে কথা। তিনি বললেন, ‘গুলির শব্দে ঘুমানো যায় না। বালিশে কান চেপে রাখি। অধিকাংশ বাড়ির বাসিন্দারা আশপাশে আত্মীয়ের বাসায় থিতু হয়েছে। দু-এক বাড়িতে যারা রয়েছেন, তাদেরও আতঙ্কে সময় কাটছে।’ রহমতবিল থেকে তিন কিলোমিটার দূরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম। বাংলাদেশ-মিয়ানমার মৈত্রী সড়ক হয়ে ঘুমধুমে ঢুকতে গেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাধার মুখে পড়তে হয়। পরে বিকল্প পথে ঘুমধুমের জলপাইতলী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ ঘরবাড়ি ফাঁকা। দু-একটি বাড়িতে এক-দু’জন করে পুরুষ সদস্য থাকলেও গোটা জনপদ প্রায় নারী-শিশুশূন্য। গ্রামের কয়েকটি ছোটখাটো বাজারের চায়ের দোকানে জটলা হয়ে অনেকে টেলিভিশনে সীমান্ত এলাকার খবরে নজর রাখছিলেন।

সব মিলিয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি ও উখিয়ার সীমান্তসংলগ্ন অন্তত ২০টি গ্রাম এখন আতঙ্কের জনপদ। প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে তাদের ব্যবসা ও ক্ষেত-খামারের কাজ। অনেকে নিদারুণ কষ্টে দিন পার করছেন। অপেক্ষা করছেন কখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। এমন প্রেক্ষাপটে গতকাল মঙ্গলবারও মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে আরও ১৬১ জন। সব মিলিয়ে এ সংখ্যা ২৬৭। এর আগে শুধু বিজিপি সদস্য ঢুকলেও গতকাল উখিয়ার রহমতবিল সীমান্ত এলাকা দিয়ে দেশটির সেনা, শুল্ক কর্মকর্তা ও অন্য সংস্থার সদস্যরাও ঢুকেছে।

এদিকে মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেল এসে পড়ে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের মধ্যমপাড়ায়। মর্টার শেলটি ওই এলাকার নুরুল ইসলামের বাড়ির উঠানের আমগাছে লেগে মাটির নিচে ঢুকে যায়। এতে কেউ হতাহত না হলেও বসতঘরের কাচের জানালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া গতকাল দুপুরে ঘুমধুমের তুমব্রুর পশ্চিমকুল এলাকায় মর্টার শেলের আঘাতে ছৈয়দ আলম (৩৫) নামে এক ইজিবাইকচালক আহত হয়েছেন।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, গত রাত নির্ঘুম পার করেছে মানুষ। মর্টার শেলে দু’জন নিহত হওয়ার পর আতঙ্ক দ্বিগুণ বেড়েছে। সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। অপ্রয়োজনে কাউকে বাড়ি থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

ঘুমধুমের বেতবুনিয়া বাজারের চা দোকানি সিরাজুল হক বলেন, ‘স্বাধীনতার পর কেউ এমন পরিস্থিতি দেখেনি। এলাকার একটা ঘরেও নারী-শিশু নেই। গরু-ছাগল ও বাড়িঘর দেখার জন্য কেউ কেউ প্রাণ হাতে নিয়ে পড়ে আছে। বেশির ভাগ লোকজন জান বাঁচাতে এলাকাছাড়া।’ আবদুল করিম বলেন, ‘পরিবারের সবাইকে কুতুপালংয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। মুদি দোকানও কয়েক দিন খুলছি না। মাঝে মাঝে এসে দোকান দেখে যাই। গুলিবর্ষণ, মর্টার শেল নিক্ষেপ ও বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠছে সীমান্ত এলাকা।’

বিজিপির হামলায় আহত চার বাংলাদেশি
গতকাল সকাল ৮টার দিকে প্রথম দফায় বিজিপির ১১১ সদস্য ঢোকার চেষ্টা করলে গ্রামবাসী তাদের বাধা দেয়। এ সময় বিজিপির কয়েক সশস্ত্র সদস্য নিরস্ত্র গ্রামবাসীর ওপর হামলা করে। এতে চার বাংলাদেশি আহত হন। পরে স্থানীয়রা বিষয়টি বিজিবি ও উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরীকে জানান। উখিয়ার নিজ কার্যালয়ে সমকালের সঙ্গে আলাপকালে ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, ‘ঘটনা শুনে সকাল ৮টার দিকে রহমতবিলে যাই। গ্রামবাসীর সঙ্গে মিয়ানমার থেকে আসা লোকজনকে প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়েছি। উল্টো তাদের হামলায় কয়েকজন আহত হয়েছেন। পরে আরও কয়েকজন ঢোকে। তাদের মধ্যে চারজনের কাছে রাইফেল ও এসএমজি ছিল। ক্ষেতে কাজ করা অবস্থায় এক কৃষকের ওপর হামলা করেছিল সশস্ত্র গ্রুপটি। এমনকি বোমাও ফাটায় তারা। বিজিপি সদস্য ছাড়া যারা সশস্ত্র অবস্থায় ঢুকছে, তাদের আরসা ও আরএস কর্মী বলে ধারণা করছি।’ কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম বলেন, বিজিপির আড়ালে আরসা বা আরএসও সদস্যরা ঢুকছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হবে। অস্ত্রধারী আসলে কারা তা শনাক্ত করবে বিজিবি। 

গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিজিপির হামলায় আহত কৃষকের নাম আনোয়ারুল ইসলাম। রহমতবিলের তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, জীর্ণ ঘর, ঘরে চালা ও বেড়া ভাঙাচোরা। উঠানে হতাশ হয়ে বসে ছিলেন ৭-৮ নারী ও শিশু। আনোয়ারুলের শ্যালিকা তানিয়া বলেন, সশস্ত্র লোকগুলোর পরিচয় জানার পরপরই দুই থেকে তিনটি গুলি করা হয়। চিকিৎসার জন্য তাঁকে কক্সবাজার হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। কোনো কারণে পা কাটা পড়লে ভিক্ষা করা ছাড়া আনোয়ারুলের কোনো পথ থাকবে না।

এদিকে উখিয়ায় ঘুরে দেখা গেছে, গতকাল মিয়ানমার থেকে যারা বাংলাদেশে ঢুকেছে প্রথমে তাদের নিরস্ত্র করে বিজিবি। ওই দলে নারী ও শিশুও রয়েছে। নিরস্ত্রীকরণের পর রহমতবিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সতর্ক পাহারায় তাদের ঘুমধুমে বিজিবির চৌকিতে নেওয়া হয়। বিজিবি সূত্র জানায়, পালিয়ে আসা বিজিপি সদস্যদের অস্ত্র ও গুলি জমা রাখা হয়েছে। আশ্রয় নেওয়া সদস্যদের মধ্যে ২৩ জন আহত। তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করছে বিজিবি।

মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছেন এমন দু’জনের সঙ্গে কথা বলেছে সমকাল। তাদের মধ্যে একজন হলেন আমজাদ হোসেন। তিনি আরাকান রাজ্যে জিম্মনখালী এলাকার বাসিন্দা। আমজাদ বলেন, ৯-১০ জনের একটি গ্রুপের সঙ্গে ওপার থেকে এসেছি। কয়েক দিন ধরে জান্তা সরকার ও আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘর্ষে ওপারে টেকা কঠিন হয়ে পড়ছিল। অনেক বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিমান থেকে ফেলা হচ্ছে গোলা। লক্ষ্যভ্রষ্ট গোলার বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতরেও আতঙ্ক। তার পরও ওপার থেকে এপার এখনও অনেক নিরাপদ। পরিস্থিতি শান্ত হলেই মিয়ানমারে ফিরে যাব। 

প্রশাসনের কর্তারা সীমান্ত এলাকায়
স্থানীয় কেউ কেউ বলছিলেন শূন্যরেখায় তিনজনের লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। তবে এ বিষয়ে প্রশাসন নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেনি। গতকাল সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. শাহীন ইমরান, পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম, বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন ও পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন। সীমান্ত এলাকায় সৈকত শাহীন বলেন, বিজিবি যে ধরনের সহযোগিতা দেয়, সেটা আমরা দিচ্ছি। একজন রোহিঙ্গাও যাতে ঢুকতে না পারে সেটার ওপর জোর দিচ্ছি। বান্দরবানের জেলা প্রশাসক বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘর্ষের পর সীমান্তের এপারে যারা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছেন, তাদের জন্য দুটি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছি। মানুষ যাতে আশ্রয়কেন্দ্রে যায়, সেটার অনুরোধ করছি। সীমান্তের এপারে যেসব এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ মনে হবে, সেখানকার বাসিন্দাদের আমরা আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাব। 

সীমান্ত এলাকার মাঠ প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, যারা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছেন তাদের একটি ডেটাবেজের আওতায় নেওয়া হচ্ছে। এদের ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মিয়ানমার থেকে ভারতে যারা ঢুকেছিল তাদের দ্রুত ফেরত পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশও একই প্রক্রিয়ায় ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করবে। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d