Bangladesh

অনেক অপকর্মের হোতা পুলিশ কর্তারা এখনও বহাল

খুলনার তিন থানা

খুলনা মহানগর ছাত্রদলের তৎকালীন সহসভাপতি মাহামুদুল হক টিটো ও ফেরদাউসুর রহমান মুন্নাকে ২০১২ সালের ২২ এপ্রিল সদর থানার একটি কক্ষে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে বেধড়ক পিটিয়েছিল পুলিশ। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও সেই ছবি ফলাও করে প্রচার হয়।

নির্যাতনের ঘটনায় খুলনা থানার সে সময়ের ওসি এস এম কামরুজ্জামানকে প্রত্যাহার ও তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছিল। তাতে খুব একটা কাজ হয়নি। ২০ দিনের মধ্যেই তাঁকে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সোনাডাঙ্গা থানার ওসি হিসেবে পদায়ন করা হয়। দু’দফা পদোন্নতি পেয়ে এস এম কামরুজ্জামান এখন খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার হিসেবে আছেন। 

এক যুগ পর একই রকম ঘটনা ঘটে নগরীর দৌলতপুর থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইমাম হোসেনের সঙ্গে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে দৌলতপুরে পৌঁছলে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে পেটানো হয় রাতভর। 

ইমাম হোসেন বলেন, ভোরে যখন আমার চোখ খুলে দেওয়া হয়, তখন দৌলতপুর থানার ওসি প্রবীর, এসি গোপীনাথ কানজিলাল ও এসআই মুকুল উপস্থিত ছিলেন। পেটানোর সময় গোপীনাথ বলছিলেন, ‘কথা বললে শুনিস না, তোদের ফখরুলকে পিটিয়ে আসলাম, তুই তো …।’ আদালতে তোলার সময় এডিসি সোনালী সেনও তাচ্ছিল্য ভরে জিজ্ঞেস করছিলেন, ‘থার্ড ডিগ্রি’ কেমন হলো? তারা এখনও গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল তবিয়তেই আছেন।

শুধু মাহমুদুল হক টিটো কিংবা ইমাম হোসেনই নন, গত সাড়ে ১৫ বছরে খুলনার বিরোধী মতের অসংখ্য নেতাকর্মী নানাভাবে পুলিশ কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত আক্রোশের শিকার হয়েছেন। শারীরিক নির্যাতন ছাড়াও হয়েছে অনেকের বাড়ি ভাঙচুর, বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে দোকান-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। 

গুটিকয়েক পুলিশ কর্মকর্তার এসব অপকর্মের কথা সবাই জানতেন। তবে পরিবেশ এতই ভীতিকর ছিল, এসব বিষয় গণমাধ্যমে প্রকাশ বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানোর সাহস পাননি কেউই। আবার অভিযোগ দিয়েও ফল না পাওয়ায় নির্যাতন সহ্য করেছেন মুখ বুজে। ওই সময় কিছু ঘটনায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিবাদ জানিয়েছিল বিএনপি। তবে পুলিশ কর্মকর্তারা সেসব অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। এখন পট পরিবর্তনের পরও ওই পুলিশ কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল আছেন। এতেই ক্ষুব্ধ নির্যাতিত মানুষ। 

এ ব্যাপারে সচেতন নাগরিক কমিটি খুলনার সভাপতি কুদরত-ই-খুদা বলেন, অতি উৎসাহী কিছু কর্মকর্তার জন্য পুরো পুলিশ বাহিনী ঝুঁকির মুখে পড়েছে। অপকর্ম ঢাকতে এখন অনেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশকে দায়ী করছেন। তবে তদন্ত করলে দেখা যাবে, তাদের ব্যক্তি আক্রোশ এবং দলবাজি এসবের পেছনে দায়ী। তাদের অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১২ মার্চ ইমাম হোসেনের মতো ৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবদল সভাপতি ফয়েজ আহমেদ দীপুকে তুলে নেওয়া হয়। দীপু বলেন, ‘ওই দিন ছিল প্রথম রমজান। ওসির কক্ষে নিয়ে কয়েকজন আমার মাথা দেয়ালে ঠেসে ধরে পেছনে পেটাতে থাকে। ওসি প্রবীর, এসআই মুকুলও সেখানে ছিলেন। সারাদিন রোজা রেখে মার সহ্য করতে না পেরে আমি ফ্লোরে পড়ে যাই।’

দৌলতপুর থানার সে সময়ের ওসি প্রবীর কুমার বিশ্বাস বর্তমানে খুলনা সোয়াটে কর্মরত। 

এসআই মুকুল খান দৌলতপুর থানাতেই রয়েছেন। সোনালী সেন এখনও কেএমপির উত্তর জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার হিসেবে কর্মরত। গত ১৫ আগস্ট সোনালী সেনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন পুলিশের মারধরে নিহত বাবুল কাজীর স্ত্রী ফাতেমা বেগম। 

সহকারী কমিশনার গোপীনাথ কানজিলালকে বদলি করা হয়েছে খুলনা সদর জোনে। ৯ আগস্ট কেএমপি কমিশনারের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের মতবিনিময় সভায় গোপীনাথ কানজিলালসহ আট পুলিশের বিরুদ্ধে শাস্তির দাবি জানানো হয়। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, গত ৩১ জুলাই আন্দোলন চলাকালে নগরীর রয়েল মোড়ে শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন চেক করছেন গোপীনাথ। সেখান থেকে ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের জেরে মানুষকে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। 

সোনাডাঙ্গা থানার এসআই সোবহান হোসেন, অনুপ কুমার ঘোষ, রহিত কুমার বিশ্বাস, সুকান্ত দাস, হরষিৎ মণ্ডল ও উত্তম কুমার মিত্রের বিরুদ্ধেও ব্যক্তি আক্রোশে নির্যাতন, দোকানে তালা দেওয়া এবং ব্যবসায়ীকে হয়রানির অসংখ্য অভিযোগ ছিল। থানাটিতে কর্মকর্তারা অপরাধের একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। প্রমাণ পাওয়ায় বেশির ভাগকে পরে বিভিন্ন স্থানে বদলি করা হয়। 

২০২৩ সালের ২৬ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশের আগে খুলনায় ধরপাকড় শুরু হলে গ্রেপ্তার হন ১৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শামীম আহসান। সংসার চালাতে স্বামীর দোকান খুলে ব্যবসা শুরু করেন শামীমের স্ত্রী  রোকসানা বেগম। ওই বছরের ১১ নভেম্বর সোনাডাঙ্গা থানার এসআই সুকান্ত দাস ও উত্তম কুমার মিত্র গিয়ে ওই দোকানে তালা দেন।

মহানগর ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুজ্জামান আরিফকে কয়েক দফা বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আরিফ বলেন, প্রতিবারই বাড়িতে ঢুকে গালাগাল, ভাঙচুর এবং আমাকে মারতে মারতে নিয়ে গেছেন এসআই সোবহান হোসেন, অনুপ ও রহিত। একবার সদর থানা এলাকায় গ্রেপ্তারের পর হাত-পায়ের তালুতে পেটানো হয়। 

নগরীর বয়রা মোড়ে ভারতীয় ভিসা কেন্দ্রের সামনে দালালের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা তুলতেন উত্তম কুমার মিত্র। বিষয়টি সাংবাদিকদের জানালে নাশকতা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় ব্যবসায়ী ইয়াসির আরাফাতকে। আরাফাত বলেন, কষ্ট করে টাকা উপার্জন করি। সেই টাকা কেন দিতে হবে– বলার অপরাধে সাড়ে তিন মাস হাজতে থাকতে হয়েছে।

এসআই সোবহান হোসেন এখন ট্যুরিস্ট পুলিশে, অনুপ কুমার ঘোষ লবণচরা থানায়, রহিত কুমার বিশ্বাস খাগড়াছড়ি, সুকান্ত দাস খুলনা সদর থানায়, হরষিৎ মণ্ডল খালিশপুর থানায় এবং উত্তম কুমার মিত্র ছোট বয়রা পুলিশ ফাঁড়িতে কর্মরত। খুলনা সদর থানার সাবেক এসআই টিপু সুলতান, এসআই সুকান্ত ও এএসআই আবু সুফিয়ানের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ ছিল। 

এর মধ্যে বিএনপি নেতা মোল্লা ফরিদ আহমেদকে না পেয়ে আটক করা হয় তাঁর কলেজ পড়ুয়া ছেলে তৌকির আহমেদ স্বাধীনকে। পরে এক ব্যবসায়ী নেতা থানা থেকে তাকে ছাড়িয়ে আনেন। 

বিএনপি নেতা মিজানুর রহমান মিজু ও ইউসুফ হারুন মজনু বলেন, যে কোনো বিষয়ে অভিযান হলেই পুলিশ আমাদের বাড়ি আসত। প্রতিবারই গালাগাল ও নারীদের সঙ্গে দুব্যর্বহার করত। এসআই টিপু সুলতান ও আবু সুফিয়ান একবার আমাদের বিভিন্ন আসবাব ভেঙে তছনছ করে।

টিপু সুলতান পদোন্নতি পেয়ে পরিদর্শক হয়ে এখন কয়রা থানায়। বাকিরা সদর থানায়ই আছেন।

আওয়ামী লীগের শাসন আমলের প্রথম ১২ বছর খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি ছিলেন নজরুল ইসলাম মঞ্জু। তিনি বলেন, রাজপথে আওয়ামী লীগ মোকাবিলার চেয়ে অতি উৎসাহী পুলিশ এবং মামলা মোকাবিলায় আমাদের বেশি বেগ পেতে হয়েছে। বিশেষ করে বাড়ি ভাঙচুর, পরিবারের সঙ্গে দুব্যর্বহার মেনে নেওয়া ছিল কষ্টকর।
নগর বিএনপির সদস্য সচিব শফিকুল আলম তুহিন বলেন, আমরা অতি উৎসাহী পুলিশের তালিকা করছি। পরে এটি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে দেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে কেএমপি কমিশনার মো. মোজাম্মেল হক বলেন, শিক্ষার্থীরা কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। আরও কিছু অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
Situs Toto
toto togel
slot toto
Toto slot gacor
bacan4d
totoslotgacor
bacan4d
bacan4d slot gacor
bacan4d login
Bacan4d
bacan4d
bacan4d bonus
Toto gacor
Toto gacor
slot gacor hari ini
bacan4d toto
bacan4d toto
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d link alternatif
slot gacor bett 200
situs toto
SITUS TOTO
toto 4d
toto gacor
Slot Toto
Slot Toto
Slot Toto
Situs toto
Slot toto
Slot Dana
Slot Dana
Judi Bola
Judi Bola
Slot Gacor
toto slot
bacan4d toto
bacan4d akun demo slot
bacantogel
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacantoto
bacan4d
Bacan4d Login
slot demo
Bacan4d Toto
toto gacor
Slot Gacor
Live Draw
Live Draw Hk
toto slot
Bacan4d slot gacor
toto macau
toto slot
Toto Gacor
slot dana
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
Slot Dp Pulsa
Bacan4d Login
toto slot
Bacansports/a>
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
slot gacor
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
slot demo
toto slot gacor
bacansports Slot toto toto slot Slot toto Slot dana Slot toto slot maxwin slot maxwin toto slot toto slot slot dana
Toto Bola
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
bacan4d
ts77casino
situs toto
slot pulsa
bacansports
situs toto
slot toto
situs toto
slot toto
situs toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansports
slot toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
situs toto
situs toto
xx1toto
toto slot
xx1toto
xx1toto
slot qriss
Slot Toto
slot dana
situs toto
slot toto
slot dana
Situs Toto Slot Gacor
xx1toto
xx1toto
bacan4d
xx1toto
xx1toto
toto slot
situs toto slot gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
situs toto
Slot Toto
Toto Slot
Slot Gacor
Slot Gacor
Slot Gacor
slot toto
Toto Slot
slot gacor
situs togel
Toto Slot
bacan4d
bacan4d